প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের পুনরুজ্জীবন

গত এক দশকে ভারতের প্রভাব কমেছে। বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপে ভারতের প্রভাব-প্রতিপত্তি যেভাবে কমেছে, তা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা উচিত৷ এদিকে বিবদমান শক্তিগুলো নিজেদের মধ্যে শক্তিশালী সামরিক সম্পর্ক তৈরি করেছে, তারা গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলোতে নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছে। আমাদের ভারত মহাসাগর মুক্তার মালার মতো ঘেরাও হয়ে আছে। আর পাহাড়ে মহাসড়ক তৈরি হয়েছে, সেগুলো আবার ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রে পরিপূর্ণ। আমরা ১৯৭১ সালে যে কৌশলগত বিজয় লাভ করেছিলাম, সেটা দুর্বল রাষ্ট্রনীতির কারণে হেলায় হারাতে হয়েছে। ক্ষীণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে জাতীয় স্বার্থ ভূলুণ্ঠিত হয়েছে৷ আমাদের স্বভাব হচ্ছে, কোনো ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা। এই তাৎক্ষণিকতা ও রাজনৈতিক সুবিধাবািদতার মধ্যে পড়ে এই বিজয়কে আমরা নস্যাৎ করেছি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পররাষ্ট্রনীতিকে বাস্তব রাজনীতি অভিমুখে পরিচালনা করবেন, তাঁর কথায় সে রকমই মনে হচ্ছে৷ তাই সময় এসেছে দক্ষিণ এশীয় বন্ধুত্বকে পুনরুজ্জীবিত করার।
কৌটিল্যের সদ্গুণ তত্ত্ব অনুসারে পররাষ্ট্রনীতির ছয়টি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। শক্তিশালী রাষ্ট্রের সঙ্গে শািন্তপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখতে হবে, প্রতিদ্বন্দ্বী যদি সমকক্ষ বা শক্তিশালী হয়, তাহলে নীরব থাকতে পারে৷ আর নিজের শক্তি কমে গেলে অন্য কারও আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে যেসব নীতি গ্রহণ করতে হবে, সেগুলো হচ্ছে: সামা (বন্ধুত্ব), দামা (উপহার), ভেদা (বিভাজন) ও ডান্ডা (শাস্তি)৷ এই প্রাচীন নীতি এখনো প্রযোজ্য।
ভুটান একরকম নিঃস্ব হয়ে গেছে। এই দেশটি একটি আদর্শ প্রতিবেশী। চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেশটিতে অনুরূপ উত্তেজনা বিরাজ করছে৷ চীন দেশটির দোকলাম এলাকা, যেটা একপ্রকার ভারতের গলার ওপর, নিজেদের বলে দাবি করছে। চীন ভুটানে ক্রমেই সড়কসহ নানা রকম স্থাপনা নির্মাণ করছে, তারা আসলে সেখানকার উচ্চতার সুবিধাটা নিতে চাইছে৷ খোলঙচুর ৬০০ মেগাওয়াট যৌথ বিদ্যুৎ প্রকল্প, চামকারচুর ৭৭০ মেগাওয়াট, ওয়াংচুর ৫৭০ মেগাওয়াট, বানুখার ১৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো শেষ হয়ে গেছে, অথচ এগুলোর অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা পর্যালোচনা এখনো ঝুলে আছে৷ ভুটানের অবকাঠামোগত উন্নয়নে আরও বেশি সহায়তা করা দরকার, আর এই বিদ্যুৎ রপ্তানির জন্য তাকে আরও বেশি টাকা দেওয়া দরকার। আর যাই হোক, ভুটানকে বন্ধুসুলভ প্রতিবেশীর খাতা থেকে বাদ দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বিশেষ সম্পর্ক থাকা উচিত৷ অবৈধ অনুপ্রবেশ, রাজ্যপর্যায়ের ক্ষীণ দৃষ্টিভঙ্গি ও পানি বিতর্ক প্রভৃতি কারণে আমাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বিদ্রোহীদের তৎপরতা ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত। ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা স্থল সীমানা প্রটোকলে ছিটমহলসংক্রান্ত বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল৷ এর ফলে আমরা ১১১টি অপ্রবেশ্য ছিটমহলের বিনিময়ে ৫১টি ছিটমহল পেয়েছি। একই সঙ্গে সীমান্ত সংঘাত কমেছে, ট্রানজিট-সুবিধা উন্মুক্ত হয়েছে এবং আঞ্চলিক আস্থা অর্জিত হয়েছে। কিছু প্রয়োজনীয় সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সীমান্ত বিরোধ বন্ধ করা গেলে উভয় পক্ষই লাভবান হবে৷ পানিবণ্টন চুক্তির সম্ভাবনা যাচাই করে পানিবণ্টনে ন্যায়পরায়ণতা নিশ্চিত করতে হবে৷ বাংলাদেশ সরকার বিশেষ ট্রানজিট-সুবিধা দিয়ে ত্রিপুরায় খাদ্য সরবরাহের যে সুযোগ সৃষ্টি করেছে, তা সিত্যই প্রশংসনীয়। নিবিড় অর্থনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমেই অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকানো সম্ভব হবে। এর ফলে কলকাতাকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কেন্দ্র হিসেবে পুনরুজ্জীবিত করা যাবে। আর িময়ানমার ও সিঙ্গাপুরে যাওয়ার প্রস্তাবিত সড়কও বাংলাদেশের মধ্য দিয়েই গেছে।
শ্রীলঙ্কা সংবিধানের ১৩তম সংশোধনী বাস্তবায়নে গড়িমসি করছে। এই সংশোধনীতে তামিলদের আরও বৃহত্তর পরিসরে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য আরও বাড়ানো উচিত। এদিকে কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্টও চূড়ান্ত হওয়ার পথে৷ এতে বিনিয়োগ ও সেবা খাতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য আরও বাড়বে। বিদ্যুৎ খাত ও অবকাঠামোতে বিনিয়োগ, রাম সেতু এলাকায়

প্রস্তাবিত সেতু ও অভিন্ন বিদ্যুৎ গ্রিড দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক আরও জোরদার করবে বলে আশা করা হচ্ছে৷ ভারতের উচ্চ হারের প্রবৃদ্ধি শ্রীলঙ্কার জন্যও সুফল বয়ে আনবে৷ আর আমাদের পর্যটকেরাও সেখানকার ক্যাসিনোতে ভিড় জমাচ্ছেন।
এদিকে মালদ্বীপে চীনারা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে৷ ইথুরু থিলা ফালহু—দেশটির রাজধানী মালের উত্তর-পশ্চিমে চীনাদের বন্দরসুবিধা দেওয়া হয়েছে৷ সেখানে জাহাজ ভেড়ানো থেকে শুরু করে নৌবাহিনীর জাহাজ মেরামতের সুবিধাও রয়েছে। এ অঞ্চলে চীনের ও ভারতের যে যৌথ স্বার্থ রয়েছে এবং আমাদের যৌথ নৌস্বার্থের কারণে ভারত এ ক্ষেত্রে একটি আদর্শ সহযোগী হতে পারে। বিমানবন্দর বাতিলকরণ নিয়ে যে ডামাডোল শুরু হয়েছিল, তার পুনরুত্থান না হওয়াই ভালো। মুক্তার মালা যদিও ক্রমে বড় হচ্ছে, ভারত মহাসাগরে ভারতের নিয়ন্ত্রণ হারালে চলবে না।
পশ্চিম ইরানকে গ্রহণ করছে, আমাদেরও তাই বসে থাকা চলবে না। পারস্য উপসাগরের অনতিদূরে যে কৌশলগত চব্বার বন্দর রয়েছে, সেখানে একটি বিশাল পেট্রোকেমিক্যাল কমপ্লেক্স রয়েছে৷ এর ফলে কান্ডলার সঙ্গে সরাসরি জাহাজ যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হবে, এলএনজি আমদানিও বাড়বে। তেহরান যে তার তেল ও গ্যাসনীতিতে পরিবর্তন আনল, সেখানে তার ভারতীয় বিনিয়োগ আমন্ত্রণ জানানো উচিত। জাতিসংঘে ভারত কোনো এক তাৎক্ষণিকতায় আক্রান্ত হয়ে ইরানের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল; ফলে একধরনের তিক্ততা রয়েই গেছে। তা সত্ত্বেও ভারত-ইরান বাণিজ্যের প্রসার হওয়া উচিত। এর জন্য ইরান মধ্য এশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের কেন্দ্র হতে পারে।
আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ভারত রক্ত ও সম্পদ উভয়ই বিনিয়োগ করেছে। যদিও হাক্কানি নেটওয়ার্ক সেখানে ভারতীয় কনস্যুলেটে ক্রমাগত হামলা চালিয়েই যাচ্ছে। ফলে ব্যাপারটা আফগানিস্তানের পক্ষে স্ববিরোধী হয়ে যাচ্ছে৷ এই তালেবান ও হাক্কানি নেটওয়ার্ক সেখানকার ক্ষমতায় এলে আফগানিস্তানে যে ভঙ্গুর গণতন্ত্র রয়েছে, সেটাকেও নস্যাৎ করে দেবে। যুক্তরাষ্ট্র সেখান থেকে পূর্ণাঙ্গভাবে সেনা প্রত্যাহার করবে, ফলে সেখানকার স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনতে অনেক দেশেরই সহায়তা লাগবে৷ ইরান ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আফগানিস্তান রুট হিসেবে কাজ করতে পারে৷ ফলে ভারতের তরফ থেকেও সেখানকার স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনতে অনেক কিছু করার আছে।
আর পাকিস্তান বরাবরের মতো একটি বিরক্তিকর প্রতিবেশী হিসেবেই থাকবে৷ নৌঘাঁটি ও করাচি বিমানবন্দরে জঙ্গিদের হামলার পর বোঝাই যাচ্ছে, সেখানে একটি ক্ষমতার লড়াই শুরু হতে যাচ্ছে। সিয়াচেন ও স্যারক্রিকে ঐকমত্য হলে দ্রুতই ফল লাভ হবে, বাণিজ্যও বাড়তে পারে। সবকিছুর সঙ্গেই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী জড়িয়ে যাচ্ছে৷ ফলে নওয়াজ শরিফের সঙ্গে আলোচনা হওয়া দরকার। বাণিজ্য ও ট্রানজিটের মাধ্যমে কিছু সীমানা মুছে ফেলতে হবে। আর কাশ্মীর, সে বিষয়ে ফয়সালা হতে আরও এক প্রজন্ম আমাদের লেগে যাবে৷
সার্ক পুনরুজ্জীবিত করতে হবে, সাফটা ও দক্ষিণ এশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আরও জোর দিতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের অভিন্ন সংস্কৃতিকে উদ্যাপনের উপলক্ষ করতে হবে। ভিসামুক্ত ভ্রমণ ও পিআইও ধরনের সুবিধার মাধ্যমে সেটা করা যেতে পারে৷ কৌটিল্যেও চার নীতির ওপর ভর করে সম্পর্কের পুনর্নির্মাণ করতে ও জাতীয় স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে শক্তিশালী নেতৃত্ব দরকার৷ এর জন্য বাস্তব রাজনীতির ধ্যানধারণাও থাকতে হবে। ভাগ্যের সহায়তায় ভারতে আবার একটি শক্তিশালী সরকার এসেছে৷ এই সুযোগ হেলায় হারানো যাবে না। ভারতের কূটনীতিকদের সংখ্যা কম। দেশটির ক্ষমতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে৷ কেন্দ্রের নতুন নীতির কারণে সেটা সঠিক পথে পরিচালিত হবে বলে আশা করা যায়।
হিন্দুস্তান টাইমস থেকে অনূদিত
বরুণ গান্ধী: বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক ও লোকসভার সদস্য।