ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেসের দাবি

আজকের যে অনগ্রসর, দারিদ্র্যপীড়িত ও বেকারত্বের কশাঘাতে জর্জরিত কুড়িগ্রাম জেলাকে দেখছি, যে কুড়িগ্রামকে গরিব বাংলাদেশের গরিবতম জেলা বলে জানি; ইতিহাসের দোহাই, কুড়িগ্রাম জেলা তা ছিল না। যা দেখছি তা-ই সত্য নয়, আমরা চাইলে সত্য ভিন্ন রকম হতে পারে। দেশপ্রেমিক, প্রগতিশীল, বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তার ভিত্তিতে নীতিনির্ধারণ গোটা পরিস্থিতিকে পাল্টে দিতে সক্ষম। ক্ষমতাসীন শক্তি তা করতে ব্যর্থ হলে জনগণকে দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হয়। ইতিমধ্যে গণকমিটির নেতৃত্বে সেই চিন্তা বাস্তবায়নের কাজ কিছুটা এগিয়েছে।
প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিওলজি জানিয়েছে, ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা অববাহিকায় পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নৌপথ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। যে অববাহিকা দিয়ে চীন ও ভারতবর্ষ থেকে রোমান ও আরবরা পণ্য নিয়ে যেত। কুড়িগ্রাম জেলার গুয়া থেকেই দুই হাজার বছর আগে আসামের রাজধানীর নামকরণ গুয়াহাটি হয়েছে। তারপর ভারতের সোপারা বন্দর থেকে আরব ব্যবসায়ীরা এই গুয়া সংগ্রহ করার কারণে গুয়ার নাম হয় সুপারি। ভারতের নৌবন্দরসমূহের ইতিহাস বই থেকে জানা যায়, চিলমারী একসময় জাহাজ তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিল। ব্রহ্মপুত্র আন্তর্মহাদেশীয় নদ হওয়ায় চিলমারী নদীবন্দরকে কেন্দ্রে রেখে ভারত, ভুটান, নেপাল ও চীনের সঙ্গে সুলভ বাণিজ্য–সম্পর্ক গড়ে তোলা খুবই সম্ভব।
তা ছাড়া নাগেশ্বরীর সোনাহাট স্থলবন্দর তো আছেই।এসকাপ ও ইউএনডিপির একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে, টন-কিলোমিটারে তেল খরচের ক্ষেত্রে সড়কপথে যেখানে ২১৭ টাকা লাগে, সেখানে রেলপথে মাত্র ৮৫ টাকা ও নৌপথে ২৫ টাকা। জালের মতো ছড়ানো এই রেল ও নৌ খাতকে বিদেশি পরামর্শকদের কুপরামর্শে ও ধান্দাবাজ, গণবিরোধী রাজনীতিক ও পরিকল্পকদের চক্রান্তে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে এসেছে। স্বাধীন ও আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ রাষ্ট্র নির্মাণের স্বার্থেই আমাদের প্রস্তাব। প্রকৃতি ও ইতিহাস আমাদের যা ঢেলে দিয়েছে, তা-ই আমাদের পাথেয়। বর্তমান সরকার ইতিমধ্যে চিলমারী সুন্দরগঞ্জ পয়েন্টে প্রস্তাবিত নতুন ১৪৯০ মিটার দৈর্ঘ্যের তিস্তা সেতুর প্রকল্প হাতে নিয়েছে; যা কুড়িগ্রাম চিলমারী কে সি রোড থেকে তিস্তা সেতু হয়ে গাইবান্ধা অংশে হরিপুর হয়ে ফুলছড়ি-বালাসী ঘাট পর্যন্ত পৌঁছাবে। ভবিষ্যতে বালাসী ঘাট থেকে রেল সেতুযোগে জামালপুর হয়ে তা ঢাকার সঙ্গে সংযুক্ত হবে।
আমরা খুবই নিশ্চিত, তিস্তা সেতুতে রেল-সংযোগ ও রমনা রুটে ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেস চালু হলে বিদেশি বাণিজ্য অংশীদারেরা সুলভ ও নিরাপদ হওয়ার কারণে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। তা ছাড়া ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার সঙ্গমস্থল চিলমারী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য হাজার বছর ধরে পুণ্যস্নান হিসেবে বিবেচিত। প্রতিবছর অষ্টমীর পুণ্যস্নানে দেশ-বিদেশের লাখ লাখ পুণ্যার্থীর সমাগম হয়ে থাকে। অন্যদিকে শীত মৌসুমে অতিথি পাখির কলকাকলি তো আছেই। ফলে এই অঞ্চলে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব। এর ফলে মঙ্গা ও দারিদ্র্যের কলঙ্ক দূর করে বাংলাদেশ গৌরবান্বিত হয়ে উঠবে৷ ইতিমধ্যে এই দুটি দাবিতে তিন লাখ মানুষের গণস্বাক্ষর কর্মসূচি ঘোষণা করেছে রেল-নৌ-যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি।
জেলাওয়ারি পরিসংখ্যানে, কুড়িগ্রাম জেলা থেকেই সর্বাধিকসংখ্যক শ্রমিক বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে কাজের সন্ধানে ছুটে বেড়ান। নদীভাঙন ও কর্মসংস্থানের অভাব এর প্রধান কারণ। প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে দেড় শতাধিক ঢাকাগামী কোচের চলাচল তারই প্রমাণ। এবং গরু-ছাগলের মতো অমানবিক ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবস্থায় আমরা যাতায়াত করে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল রাখি বলে আমরা মফিজ বলে পরিচিত। প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় আমাদের জেলার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ নিহত হন। অথচ বর্তমান অবকাঠামোকে ব্যবহার করেই রমনা থেকে ঢাকাগামী একটি এক্সপ্রেস চালু করা যায়, যা এই অঞ্চলের মানুষের প্রাণের দাবি।
দ্বিতীয়ত, প্রস্তাবিত চিলমারী-সুন্দরগঞ্জ তিস্তা সেতুতে রেল-সংযোগ চালু হলে কুড়িগ্রাম জেলা থেকে মঙ্গা চিরতরে হারিয়ে যাবে৷ এতে প্রথমত সংযোগ সড়কের দূরত্ব কমে আসবে, দ্বিতীয়ত একই খরচে সড়ক ও রেলপথের কাজ হবে। ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ চিলমারী নদীবন্দর ও সোনাহাট স্থলবন্দর তখন এই তিস্তা সেতুর রেল-সংযোগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রস্তাবিত দ্বিতীয় যমুনা সেতু হয়ে দ্রুত পণ্য ও যাত্রী জামালপুর হয়ে ঢাকায় পৌঁছে যাবে। ফলে কুড়িগ্রাম জেলা বাংলাদেশের যোগাযোগ ও অর্থনীতির মূল ধারায় যুক্ত হবে।
ইতিহাসের নানান সংগ্রাম এবং ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, দুধকুমার, ফুলকুমার, তিস্তা অববাহিকায় গড়ে ওঠা কুড়িগ্রাম জেলাবাসী উত্তরাধিকারের মতো বহন করে চলেছেন। এ ভূখণ্ড পলাশীর যুদ্ধের পরপরই ভূরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী, উলিপুর, রাজারহাট, চিলমারী, রৌমারী ও রাজীবপুর অর্থাৎ ব্রহ্মপুত্রের দুই পার বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার কৃষক বিদ্রোহের প্রধান ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। রাজীবপুরের জাফরগঞ্জ ও ভূরুঙ্গামারীর সীমান্তসংলগ্ন দিনহাটায় বেশ কয়েকটি কৃষকযুদ্ধ সংঘিটত হয়। ১৭৬৬ খ্রিষ্টাব্দে রামানন্দ গোসাঁঈ ও লে. মরিসনের নেতৃত্বে ফকির-সন্ন্যাসীদের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তারপর সেই যুদ্ধের পথ বেয়ে ’৭১-এ মুক্তাঞ্চল রৌমারী ও চিলমারীর যুদ্ধ ইতিহাসে হাজির হয়। সেই যুদ্ধ এখনো থামেনি। যে আকাঙ্ক্ষা সেদিন কৃষকেরা দেখেছিলেন, যে আকাঙ্ক্ষায় লাঙল ফেলে অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন; সে আকাঙ্ক্ষা মরেনি। কিন্তু এই লড়াইয়ের যে চেতনা, যে সাহস, যে শক্তি তৈরি হয়েছে; সেই অন্তঃসলিলা শক্তিতে, চেতনায়, সাহসে তৈরি হবে আমাদের পথ।
নাহিদ হাসান: রেল-নৌ-যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি কুড়িগ্রাম-এর সমন্বয়ক৷