আওয়ামী লীগ পারে, আওয়ামী লীগ পারে না!

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

আওয়ামী লীগের ৬৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গত ২৪ জুন কয়েকটি পত্রিকায় প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রথম আলোর অনলাইনেও এটি প্রকাশ করা হয়েছে। তাঁর নিবন্ধের শিরোনাম ‘আওয়ামী লীগই পারে, আওয়ামী লীগই পারবে।’
এই লেখায় তিনি আওয়ামী লীগের গৌরবোজ্জ্বল অতীতের বিবরণ দিয়েছেন। কিন্তু কেবল অতীত গৌরব দিয়ে কোনো দল সামনে এগোতে পারে না। পারলে নির্বাচনে পাকিস্তানে পিপলস পার্টি ও ভারতে কংগ্রেসের এমন শোচনীয় পরাজয় ঘটত না।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দিয়েছে, সত্য; তবে আওয়ামী লীগই সবকিছু করেছে, তা–ও সত্য নয়। অন্যান্য গণতান্ত্রিক ও বামপন্থী দলও নিজ নিজ অবস্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। তাদের ভূমিকা অস্বীকার করলে সেটি হবে ইতিহাসকে অস্বীকার করা।
১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিলেও যুদ্ধের পরই যুদ্ধ শেষের প্রাপ্য নিয়ে দলে ভেতরে লড়াই শুরু হয়ে যায়। একপর্যায়ে দলে বিভক্তি আসে। বাহাত্তরের শেষার্ধে দলের তরুণ ও চৌকস অংশ মিলে জাসদ নামে আরেকটি দল করে আওয়ামী লীগকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দেয়। এর আগেই অবশ্য ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগসহ সব কটি সহযোগী সংগঠন বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল।
এই ভাগাভাগির সুযোগে শফিউল আলম প্রধানেরা ছাত্র নেতৃত্বে এসে অন্তর্ঘাত শুরু করেন এবং মুহসীন হলে সাত খুনের ঘটনা ঘটান। আওয়ামী লীগের এই বিভক্তি ও অন্তর্দ্বন্দ্ব পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডি পর্যন্ত চলে; সে সময় যারা বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করেছিল, যারা কুচক্রী মোশতাককে সামনে নিয়ে এসেছিল, তারা কেউই আওয়ামী লীগের বাইরের লোক ছিল না। সেদিন কে এম ওবায়েদুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, তাহেরউদ্দীন ঠাকুরেরা দলের ভেতরে থেকে যে ভূমিকা নিয়েছিলেন, বর্তমানে নেত্রীর প্রতি অতিভক্তি প্রদর্শনকারীরা ভবিষ্যতে সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন না, সে কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগই পারে।’ আওয়ামী লীগ স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, দেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করেছে। এসবই ঠিক। কিন্তু এই আওয়ামী লীগের ভেতরেই খন্দকার মোশতাক আহমদ ও শফিউল আলম প্রধানের মতো ফ্রাংকেনস্টাইন তৈরি হয়েছিল। এখনো যে ফ্রাংকেনস্টাইনরা নেই, তাই বা বলি কী করে? শেখ হাসিনার লেখায় ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্ব থেকে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন পর্যন্ত বিবৃত হলেও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি পর্ব অনুল্লেখ্যই থেকে গেছে। এটি হলো আশির দশকের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। শেখ হাসিনার দেশে ফিরে আসার কয়েক মাসের মাথায় সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করেন এবং দেশবাসীর ওপর দুঃশাসন চাপিয়ে দেন।
প্রধানমন্ত্রী ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার কথা প্রায়ই বলেন, কিন্তু ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে তাঁর জনসভায় গুলি চালিয়ে যে স্বৈরাচারী এরশাদের পুলিশ ২৪ জন মানুষ হত্যা করেছিল, সে কথা বলেন না। দুটো হামলারই লক্ষ্যবস্তু ছিলেন শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর লেখায় আওয়ামী লীগ কী কী পারে বা পেরেছে, তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ কী কী পারেনি বা করেনি, সেই তালিকাটিও বেশ দীর্ঘ। স্বাধীনতার পর দলটি শত্রু–মিত্র চিনতে ভুল করেছে। এখনো সেই ভুল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে দেশের অনেক উন্নতি হলেও যাঁদের কারণে দল ডুবেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ফলে তাদের কেউ কেউ হয়ে উঠেছেন আরও ভয়ংকর। এখন দেখা যাক আওয়ামী লীগের কথা ও কাজের মিল কতখানি? ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের কথা বলেছিল, রাখতে পারেনি। এখনো বিচারবহির্ভূত হত্যা চলছে। তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে নামার ঘোষণা দিয়েছিল। দুর্নীতি এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।আওয়ামী লীগ হত্যা, গুম, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেসব যে বন্ধ হয়নি, নারায়ণগঞ্জ, ফেনী, লক্ষ্মীপুরই তার প্রমাণ। আওয়ামী লীগ বলেছিল, মন্ত্রী–সাংসদদের সম্পদের হিসাব দেবে। কেউ দেননি। পঁাচ বছরে কারও কারও সম্পদ বেড়েছে শত গুণ।
আওয়ামী লীগ বলেছিল, দেশবাসীকে সুশাসন দেবে। এখন আওয়ামী লীগের ‘সুশাসন’ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে দলীয় কর্মীরা দলীয় কর্মীদের খুন করছে। ছাত্রলীগ কর্মীরা ছাত্রলীগকে খুন করছে। যুবলীগ কর্মীরা যুবলীগকে খুন করছে। আওয়ামী লীগ নেতারা আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে জীবন দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ি যুবলীগ নেতা দখল করছেন। যুবলীগ নেতার ব্যবসা ছাত্রলীগ নেতা হজম করছে। দেশের প্রায় প্রতিটি স্থানে সাংসদ বনাম মন্ত্রী, সাংসদ বনাম উপজেলা চেয়ারম্যানের ঝগড়া চলে আসছে। শিক্ষাঙ্গনে বিরোধী

ছাত্রসংগঠনের তৎপরতা না থাকায় ছাত্রলীগই নিজেদের কর্মীকে খুন করছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটাচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব হয় তাদের নিবৃত্ত করতে পারছেন না অথবা করতে চাইছেন না। প্রবল জনমতের চাপে বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার হলেও বেশির ভাগ আসামি পলাতক। জাহাঙ্গীরনগরের জুবায়ের, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়াদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু বকরসহ বহু হত্যার বিচার আজও হয়নি।
বিএনপি-জাতীয় পার্টি সেনানিবাসে প্রতিষ্ঠিত। তাই এই দুটি দলের কাছে আমরা গণতন্ত্রের অনুশীলন আশা করি না। দুটো দলের গণতন্ত্র এমনভাবে তৈরি, যেন সৃষ্টিকর্তার পরই তার স্থান। দলপ্রধানের মর্জির ওপরই নির্ভর করে পদে থাকা না-থাকা। কেবল মূল দল নয়, ছাত্রসংগঠন, শ্রমিক সংগঠন, যুব সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কে হবেন, তা ঠিক করে দেন দলীয় প্রধান। ৬৫ বছর বয়সী আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র সেটি অনুমোদন না করলেও সংগঠনটি কার্যত সেই ধারাতেই চলছে। প্রতি তিন বছর পর দলের কাউন্সিল হওয়ার কথা থাকলেও হয় না। কমিটি হয় না। সোয়া কোটি জন-অধ্যুষিত ঢাকা মহানগরে আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই বহু বছর ধরে। দলের কোথাও সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই। প্রতিটি বিভাগে একজন করে সাংগঠনিক সম্পাদক থাকলেও সম্ভবত তাঁদের কী কাজ, তাঁরা তা জানেন না।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর নিবন্ধে লিখেছেন ‘৬৫ বছরের এ সম্মেলন সঠিক নেতৃত্ব ও ত্যাগী কর্মী বাহিনী এবং জনসাধারণ পেরেছে বলেই গৌরবের সঙ্গে শত ষড়যন্ত্র, বাধা অতিক্রম করে বিজয় অর্জন করেছে, স্বাধীনতা এসেছে, পৃথিবীর বিপ্লবের ইতিহাসে এ এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।’
কিন্তু আওয়ামী লীগের সেই ত্যাগী নেতা-কর্মীদের এখনকার অবস্থান কী? যেখানে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজির ঘটনা, সেখানেই অনিবার্যভাবে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নাম আসছে। সাংসদদের নাম আসছে। দলের একজন সাংসদ ও সরকারের সাবেক প্রতিমন্ত্রী যখন বিরোধিতার কারণে একজন কলেজশিক্ষককে দিগম্বর করতে পারেন, সেই দলের কাছে মানুষ কী আশা করতে পারে?
আওয়ামী লীগের ৬৫তম বার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে মহাসমারোহে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। এ উপলক্ষে বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়। প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে হাতে গোনা কয়েকজন কর্মী উপস্থিত হলেও দ্বিতীয় দিন কোনো কর্মী বা সমর্থক সেখানে যাননি। প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকার কথা ছিল সজীব ওয়াজেদ জয়ের। তিনিও না। ফলে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা মঞ্চে গিয়েও বক্তৃতা না দিয়ে ফিরে যান। মহানগর আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন প্রস্তুতি বৈঠক করে শেষমেশ কর্মিশূন্য মঞ্চ উপহার দিয়েছে। দেশের সবচেয়ে ‘সুসংগঠিত’ দলে কেন এমনটি হলো? হলো এ কারণে যে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আর কেউ দল নিয়ে ভাবেন না। শৃঙ্খলা মানেন না। নেতা-নেত্রীদের কথা শোনেন না। অধিকাংশ ব্যস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য, দখলবাজি আর টেন্ডারবাজিতে। দলের অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় কই তাঁদের?
প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা সমুন্নত রাখার দায়িত্ব আমাদের। লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গেয়ে আমরাই পেরেছি বিশ্ব রেকর্ড গড়তে। আওয়ামী লীগই পারবে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন পূরণ করতে।’
প্রধানমন্ত্রীর এই আশাবাদের সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই। মিল থাকলে দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান এভাবে দলের নেতা-কর্মীরা ‘পরিত্যক্ত’ ঘোষণা করতেন না। ঢাকার বাইরের অবস্থা আরও করুণ। প্রায় প্রতিটি জেলায় গ্রুপিং, সাব–গ্রুপিং আছে। মন্ত্রীর একটি উপদল, সাংসদের আরেকটি উপদল। আর তৃতীয়টি অনিবার্যভাবে উপজেলা চেয়ারম্যানের।
তাহলে প্রধানমন্ত্রী কাদের নিয়ে সোনার বাংলা গড়বেন? যাঁরা বিদেশি বন্ধুদের দেওয়া ক্রেস্টের সোনা চুরি করেন, যাঁরা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেখিয়ে চাকরি বাগিয়ে নেন, যাঁরা বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংকসহ সব সরকারি ব্যাংকের টাকা লুট করেন, যাঁরা নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা ঘটান, যাঁরা ফুলগাজীর উপজেলা চেয়ারম্যানকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেন?
তাই প্রধানমন্ত্রীকে বলব, সোনার বাংলা গড়ার আগে দলের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা সুযোগসন্ধানী এবং কথায় কথায় তাঁর নাম ব্যবহারকারী গডফাদারদের সম্পর্কে সতর্ক থাকুন। না হলে বিদেশি মেহমানদের ক্রেস্টের সঙ্গে সোনার বাংলার স্বপ্নটাও তারা চুরি করে নিয়ে যাবে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
[email protected]