ভোট জালিয়াতির নতুন পন্থা

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

২৬ জুন, ২০১৪ অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ-৫ (সদর-বন্দর) আসনের উপনির্বাচন যে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়নি সেটা এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই নির্বাচনে সরকার-সমর্থিত জাতীয় পার্টির প্রার্থী সেলিম ওসমান প্রায় ১৬ হাজার ভোট বেশি পেয়েছেন বলে ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচনের আগে থেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আমি জাতীয় পার্টির প্রার্থী, তাঁর ভাই শামীম ওসমানের লোকজনের নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ করে আসছিলাম। সুনির্দিষ্ট ১০টি অভিযোগ জানালেও একটি বাদে কোনো অভিযোগই পাত্তা পায়নি রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে।
নারায়ণগঞ্জের বিশেষ পরিস্থিতির কথা সবাই জানেন। অব্যাহত চাঁদাবাজি, ছিনতাই, অপহরণ, খুন ও সন্ত্রাসের পেছনে ভূমিকার জন্য যে পরিবারটির দিকে সবাই আঙুল তোলেন, সেই পরিবারের এক প্রভাবশালী সদস্যের বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকেই নানাভাবে আমাকে বসিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা শুরু হয়। দিন যতই ঘনিয়ে আসতে থাকে, নির্বাচনকে প্রভাবিত করা ও ভোটারদের বিভ্রান্ত করার অপতৎপরতা জোরালো হয়ে ওঠে। পার্শ্ববর্তী আসনের সাংসদ শামীম ওসমানের বিধি লঙ্ঘনের খবরও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। তার পরও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে তঁার অডিও টেপের বক্তব্য সরাসরি নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘনের শামিল হলেও সবাইকে হাত গুটিয়ে থাকতে দেখা গেছে। এসব দেখে নির্বাচনের আগেই আমি যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম, পরবর্তী ঘটনাবলি তার সত্যতা প্রমাণ করেছে।
নির্বাচনের দিন ও পরবর্তীকালে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত খবর থেকেই নির্বাচন কেমন হয়েছে সেটা জানার কেউ বাকি আছেন বলে আমি মনে করি না। ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি এবং গণনাকৃত ভোটের সংখ্যা নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন উঠেছে। কমপক্ষে ৫০টি কেন্দ্রে অনিয়ম, ভোট জালিয়াতি, আমার পোলিং এজেন্টকে বের করে দেওয়া, কেন্দ্র দখল করে ভোট কারচুপির মতো ঘটনা সরেজমিন প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে।
ভোটকেন্দ্র দখলে বাধা দেওয়ায় কর্তব্যরত একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাকে যেভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছে, সেটা থেকেই বাস্তব পরিস্থিতি অনুমান করা যায়। যাঁরা পুলিশকে এভাবে ভয়ভীতি দেখাতে পারেন, তাঁরা সাধারণ ভোটারদের মনে কতটা আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিলেন—সেটা না বললেও চলে। ইতিমধ্যে পত্রপত্রিকার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এবং বিশ্লেষণধর্মী লেখালেখিতে বিভিন্ন কেন্দ্রের নামসহ অনিয়মের ঘটনা কারও কাছেই গোপন নেই। আমি এখানে সেসবের পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। এমনকি নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংগঠনগুলোর গ্রুপ ইডব্লিউজির প্রকাশিত রিপোর্টেও তথ্য–প্রমাণসহ শতকরা ৩০টি কেন্দ্রের অনিয়মের কথা বলা হয়েছে। এর বাইরেও রাজধানীর নাগরিক নেতারা বিশেষ করে ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ অন্যরা নারায়ণগঞ্জের উপনির্বাচন নিয়ে নির্বাচনের আগে যে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের চিঠি দিয়েছেন, সেটাও সবার জানা। এসবই নির্বাচনকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়ার জন্য যথেষ্ট বলে আমি মনে করি। এখানে আমি নতুন কিছু বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই।
ভোট জালিয়াতির অভিনব পন্থা: ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা নিয়ে নির্বাচন কমিশন ও সরকারের কৃতিত্বের দাবি এই নির্বাচনে ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েছে। প্রথমত, ভোটার তালিকার ছবি অস্পষ্ট। এ থেকে ভোটারদের চেহারা মিলিয়ে দেখাও অসম্ভব। তারপর যদি এর ফটোকপির ফটোকপি থেকে মেলানোর চেষ্টা করা হয় তাহলে বলার কিছুই থাকে না। জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটো সম্পর্কেও একই কথা বলা হয়।
নারায়ণগঞ্জ উপনির্বাচনে আমার প্রতিপক্ষ ভোটার স্লিপের কোনো ব্যবস্থাই করেননি। এর বদলে তাঁরা নির্বাচনের কয়েক দিন আগে থেকেই এলাকায় এলাকায় ক্যাডার পাঠিয়ে ভোটারদের কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেছেন এবং সেগুলোর ফটোকপি তৈরি করেছেন। জাতীয় পরিচয়পত্র যে হস্তান্তরযোগ্য নয়, এখানে তার কার্যকারিতা থাকেনি। তাঁরা নগদ অর্থ প্রদান এবং নির্বাচিত হওয়ার পর সরকারি ত্রাণ ও ব্যক্তিগত দান বিতরণ করার কথা বলেই পরিচয়পত্র নিয়েছেন।
অভিযোগ আছে, ফটোকপি করার কাজ শেষ হয়ে গেলে মূল পরিচয়পত্র ফেরত দেওয়ার সময় নগদ অর্থও দেওয়া হয়েছে। ভোটের দিন কেন্দ্রে যাওয়া নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, ক্ষেত্রবিশেষে হুমকিও দেওয়া হয়েছে। ফলে ভোটের দিন আবহাওয়ার উন্নতি ঘটলেও ভোটার উপস্থিতি বেশি হয়নি কোথাও। যদিও গণনার পর প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা দেখা গেছে অনেক বেশি। ভোটার তালিকায় অস্পষ্ট ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি সঙ্গে নিয়ে ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকায় ভোটের দিন আমার প্রতিদ্বন্দ্বীর সমর্থক, এমনকি পোশাক কারখানার শ্রমিকদেরও ভোটার হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে। কৌশলে ভোটকেন্দ্র দখল ও পোলিং এজেন্টদের অনুপস্থিতির সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগানো হয়েছে। তা ছাড়া ভোটার তালিকা প্রণয়নের সময় আগের মতো বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের তালিকা করার বদলে নির্দিষ্ট স্থানে এসে ছবি তোলা ও কম্পিউটারে নাম, ঠিকানা লেখানোর ব্যবস্থা একটা জটিল অবস্থার সৃষ্টি করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই বাড়ির একই পরিবারের সদস্যদের নাম তালিকায় বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এটাও ভোট কারচুপির সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় বিভিন্ন দলমতের ও সাধারণ মানুষের সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সরকার-সমর্থক ও পেশিশক্তির অধিকারী হওয়ায় সাধারণ ভোটারদের মতো আমার পোলিং এজেন্টদেরও ভয়ভীতি প্রদর্শন বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থের বিনিময়ে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। কম্পিউটারে

কম্পোজ করে ভোটার স্লিপ তৈরি করলেও সেগুলো ঠিকমতো কাজে লাগানো যায়নি। অনেক কেন্দ্রে নিজেদের লোককে আমার মার্কা আনারসের ব্যাজ লাগিয়ে আমার এজেন্ট হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছে। কেন্দ্র দখল করে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেই ভোটের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। ফলে ভোটার উপস্থিতির চেয়েও ভোট প্রদানের হার অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। বাস্তব কারণে বিষয়টি ঠিকমতো চ্যালেঞ্জ করাও সম্ভব হয়নি। পোলিং কর্মকর্তারাও বিষয়টি ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে অবহেলা করেছেন। তাঁরা সুষ্ঠু ভোটের চেয়েও ভোট প্রদানের সংখ্যা বাড়ানোই তাঁদের কৃতিত্ব মনে করেছেন। হয়তো ওপরের নির্দেশও এ ক্ষেত্রে কাজ করেছে।
ফলে দু-একটি কেন্দ্র ছাড়া তেমন সহিংসতা করে কেন্দ্র দখলের প্রয়োজন হয়নি। খুবই সুপরিকল্পিতভাবে বেশ কিছু কেন্দ্র দখল করে ইচ্ছেমতো ভোট দেওয়া হয়েছে। ৫০টির বেশি কেন্দ্রে ভোট গণনার হিসাব দেখলেই কারচুপির বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা যাবে। তা ছাড়া ভোট জালিয়াতির জন্য প্রতিপক্ষ যে পাঁচ-সাতটি এলাকা বেছে নিয়েছিলেন, সেগুলোতে প্রদত্ত ভোটের পরিসংখ্যান থেকেও বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। এলাকাগুলো হচ্ছে আলিরটেক ইউনিয়ন, গোগনগর ইউনিয়ন, বন্দর ইউনিয়ন, মূসাপুর ইউনিয়ন, মদনপুর ইউনিয়ন এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১১, ১২, ১৩ ও ১৪ নম্বর ওয়ার্ড। এসব এলাকার কেন্দ্রগুলোতেই প্রধানত জবরদখল ও ভোট জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে।
এর ফলে নারায়ণগঞ্জ উপনির্বাচনের ঘোষিত ফলাফল কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। ফলাফল ঘোষণার পরপরই আমি সংবাদ সম্মেলন করে তা প্রত্যাখ্যান করেছি এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশন ও সরকারের অধীনে সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন যে সম্ভব নয়, সেটাও জোরের সঙ্গে উল্লেখ করেছি। এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে (সিইসি) লিখিতভাবেও জানিয়েছি। আমার বক্তব্যের সমর্থনে দেশের বিশিষ্ট নাগিরক হিসেবে ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্না, আইনজীবী সুব্রত চৌধুরীও সিইসিকে চিঠি দিয়েছেন। আমরা সবাই ফলাফলের গেজেট প্রকাশ স্থগিত করে পুনর্নির্বাচনের দাবিও জানিয়েছি। এসবই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
এই উপনির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি কিছু প্রস্তাব রাখতে চাই। প্রথমত, অস্পষ্ট ছবিযুক্ত ভোটার তালিকায় বিদ্যমান ত্রুটিগুলো সংশোধনের ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে জালিয়াতি বন্ধের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। তৃতীয়ত, কেন্দ্র দখল ও ভোট কারচুপির বিরুদ্ধে নির্বাচন কর্মকর্তাদের পক্ষপাতমূলক ভূমিকা এবং প্রার্থীদের পক্ষ থেকে যেকোনো ধরনের অগ্রহণযোগ্য পদক্ষেপের খবর পাওয়ামাত্র তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
বিদ্যমান অবস্থায় দায়িত্ব পালনরত সরকারি কর্মকর্তাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে নারায়ণগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) বশিরউদ্দীনের সাহসী ভূমিকার প্রশংসা না করে পারা যায় না। চতুর্থত, নির্বাচনে অবাধে অর্থ ও পেশিশক্তির ব্যবহার বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে পুরো ভোট ব্যবস্থাকে ডিজিটাল করা উচিত।
তবে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন, শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিত করা না হলে এসবের কিছুই ফলদায়ক হবে না। কোনো নির্বাচনই গ্রহণযোগ্য হবে না।
এস এম আকরাম: সাবেক সাংসদ এবং নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের উপনির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থী।
[email protected]