শান্তির পক্ষে একযোগে কাজ করতে হবে

বার্টল্ট ব্রেখটের বিখ্যাত যুদ্ধবিরোধী নাটক মাদার কারেজ অ্যান্ড হার চিলড্রেন-এ একটি চরিত্রের সংলাপ ছিল এ রকম, ‘শান্তির সময়ে ঝামেলাটা কি জােনা? সে সময় কোনো সংগঠন থাকে না’।
ইউরোপের ৩০ বছরের যুদ্ধের পটভূমিতে এ নাটক লেখা হয়েছে। সতেেরা শতকের প্রথম ভাগে এ যুদ্ধে ইউরোপ ছারখার হয়ে গিয়েছিল। প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকদের মধ্যে ধর্মীয় বিবাদের কারণে এ যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু ক্রমেই তা বিবদমান রাজ্য ও দেশগুলো এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।
অনেকেই সংগত কারণে বর্তমান শিয়া-সুন্নি যুদ্ধের সঙ্গে এ যুদ্ধের মিল খুঁজে পাচ্ছেন। শিয়া-সুন্নি যুদ্ধে মেসোপটেমিয়ার বিশাল এলাকা ও পশ্চিম এশিয়া ছারখার হচ্ছে। অন্যদিকে ৩০ বছরের যুদ্ধে বিপুল মানুষ প্রাণ হারায়, প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে, অর্থনীতি ধসে পড়ে ও ডাইনি বলে বহু নারীকে পুড়িয়ে মারার কারণে সামাজিক অবস্থাও ঝঞ্ঝাসংকুল হয়ে ওঠে।
স্থিতাবস্থা বজায় রাখার লক্ষ্যে এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার আধা শতাব্দী আগে একটি শান্তি ঐকমত্য হয়েছিল। এতে বলা হয়েছিল, সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলো খ্রিষ্টধর্মের যেকোনো তরিকা বেছে নিতে পারবে। এই চুক্তি অকার্যকর হয়ে পড়লে এই যুদ্ধ শুরু হয়।
ইরাক, সিরিয়া ও অন্যান্য স্থানে যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছে তার আগে কি কোনো ‘শান্তি উদ্যোগ’ গ্রহণ করা হয়েছিল?
অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙে পড়লে পশ্চিমা শক্তিগুলো এ অঞ্চলের মানচিত্র নতুন করে বিন্যাস করার মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধির এক প্রকল্প হাতে নেয়—সে লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন দেশে ধামাধরা সরকার বসায়, নির্ভরশীল সরকার তৈরি করে, প্রভাববলয় তৈরি করে ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তেলক্ষেত্রগুলোর ওপর নিজেদের দখলদারি প্রতিষ্ঠা করে। তারপর তারা আরেকটি কৌশল অবলম্বন করে: মাগরেব ও লেভান্টের দেশগুলো ফিলিস্তিনবিষয়ক ইসরায়েলের মনোভাবের প্রতি কী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বা ফিলিস্তিনের নিজ রাষ্ট্রের দাবির প্রতি কী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে, তা বিবেচনায় নিয়ে এসব দেশগুলোর অবস্থান যাচাই করা শুরু করে তারা। এমনকি পশ্চিমা দেশগুলো বিভিন্ন দেশে সরাসরি হস্তক্ষেপও শুরু করে—ইরানের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেগকে তারা ক্ষমতাচ্যুত করে। আর সাম্প্রতিক অতীতে ইরাক ও সিরিয়ায় সামরিক আগ্রাসনও করে পশ্চিমা শক্তিগুলো, এর ফলে ইরাকে লাখো মানুষ মারা পড়ে।
আরব নীতিপ্রণেতা ও পণ্ডিতেরা ইউএনডিপির একটি প্রতিবেদনে বলেছিলেন, কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারব্যবস্থা, অর্থনৈতিক দুর্বলতা, বেকারত্বের ঊর্ধ্বগতি ও আত্মসত্তার রাজনীতির বাড়বাড়ন্তের মধ্যে আন্তসম্পর্ক খুঁজে পেয়েছে। এ অঞ্চলের রাজনীতি যত বেশি কর্তৃত্বপরায়ণ হয়েছে, তরুণদের বেকারত্ব যত বেড়েছে ও বাকস্বাধীনতা যত খর্ব হয়েছে, এই তরুণেরা তত বেশি চরমপন্থা ও সহিংস ইসলামের প্রতি ঝুঁকেছে। এটা এই মহান ধর্মবিশ্বাসের বিকৃতি ছাড়া কিছু নয়।
সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইসের মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নাকি বহুকাল ধরে ‘গণতন্ত্রের চেয়ে স্থিতাবস্থার ওপরই বেশি জোর দিয়েছে’, ফলে ‘কিছুই অর্জিত হয়নি’। কথাটা তিনি ঠিকই বলেছেন।
ইউএনডিপির ২০০২ সালের প্রতিবেদনে যে বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছিল, সেটা গ্রহণ করার যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ আছে। পশ্চিম এই নীতি প্রয়োগে ধারাবাহিক নয়, আবার জোর করেও তা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এমনকি এটা বাস্তবায়নে যে অর্থ ও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, তাও যথাযথভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি।
পশ্চিমের উচিত হবে তার সমস্ত শক্তি একত্র করে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সমঝোতা স্থাপনের চেষ্টা করা, শিয়া-সুন্নি বিবাদের জন্য এরাই মূলত দায়ী। পুরো এলাকা আগুনে পুড়ে যাক, এটা কেউই নিশ্চয়ই চান না। দুই দেশেরই উচিত, নিজেদের সম্পর্ক ঝালাই করে নেওয়া—মে মাসে এ সম্ভাবনা ক্ষণিকের জন্য হলেও উঁকি দিয়েছিল।
মার্কিন ও তুর্কি সহায়তায় ইরানের একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার দিকে যাওয়া উচিত, যে রাষ্ট্র শিয়া, সুন্নি ও কুর্দিদের আকাঙ্ক্ষার মূল্যায়ন করবে। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ কাগজে-কলমে সরকারে আছেন, কিন্তু তাঁর কোনো ক্ষমতা নেই বললেই চলে। তাঁর সেনাবাহিনী হয়তো এ যুদ্ধে জিতে যাবে, তবে যুদ্ধ চলতেই থাকবে। এ মুহূর্তে রোমান ইতিহাসবিদ ট্যাসিটাসের কথাটা মনে পড়ে গেল, ‘সব উজাড় করে দিয়ে তারা বলে, শান্তি এসেছে’। জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের সহায়তায় সারা দুনিয়ায় ব্যাপক হারে মানবিক কার্যক্রম চালানো উচিত, এতে লাখ লাখ সিরীয় উদ্বাস্তুর কাছে ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হবে। এই ত্রাণ না হলে তাদের চলছে না।
শেষত, ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের অশেষ দ্বন্দ্বের বিষয়টিও আমাদের ভোলা চলবে না। এর ফলে রাজনৈতিক চরমপন্থা পুষ্ট হচ্ছে। আর মানবাধিকারের প্রতি পশ্চিমের মনোভাব নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন তোলা যায়।
এ অঞ্চলের বাইরের দেশগুলোর ঘাড়ে আরেকটি অতিরিক্ত দায়িত্ব বর্তায়: ইসলামের গৃহযুদ্ধে যোগ দিতে তরুণদের অনুৎসাহিত করা। আমার নিজের দেশের জন্যও এটা একটা সমস্যা। যে মূল্যবোধ নিয়ে আজকের তরুণদের বাবা-মায়েরা যুক্তরাজ্যে এসেছিলেন, আমরা তাঁদের মধ্যে সে রকম বোঝাশোনা তৈরি করতে পারিনি।
দীর্ঘস্থায়ী ও প্রকৃত শান্তির বিষয়টি একটি দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া। পরিকল্পনা করতে হবে, আর সেগুলো বাস্তবায়নে বছরের পর বছর লেগে যাবে। এখনই শুরু করতে না পারলে আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে, যে আগুনে ধূপ হবে রাজনীতি ও ধর্ম। এই আগুনে শুধু ইরাকই পুড়বে না, আরও কত শহর পুড়বে তার ইয়ত্তা নেই।

ইংরেজি থেকে অনূদিত
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ক্রিস প্যাটেন: অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ।