শিক্ষিত বা শিক্ষাহীন বেকার - কোনোটাই নয়

.
.

একটি কাগজের প্রথম পৃষ্ঠার খবর, ‘দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে’। অন্য একটি কাগজের পেছনের পৃষ্ঠার সংবাদ, ‘রাজধানীতে অবাধে ঢুকছে ইয়াবার চালান’। প্রথম খবরটিকে গুরুত্ব দিলেও খুব বেশি জায়গা দেয়নি, কাগজটি এর কলাম কয়েক ইঞ্চিতেই তা শেষ করে দিয়েছে। দ্বিতীয় খবরটি অবশ্য সে তুলনায় একটুখানি দীর্ঘ, তবে তাতে নানান পরিসংখ্যানের পাশাপাশি ইয়াবার চালান কাদের জন্য আসছে, সে সম্বন্ধে প্রতিবেদকের অনুসন্ধানী মন্তব্য রয়েছে। তাঁর মতে, প্রধানত হতাশাগ্রস্ত তরুণেরাই এই মাদকের শিকার, বিশেষ করে শিক্ষিত বেকারেরা।
খবরের কাগজগুলোর কাছে সংবাদের একটা সংজ্ঞা থাকে, শিরোনাম হওয়ার জন্য কোনো ব্যক্তি বা ঘটনাকে সেই সংজ্ঞার ভেতরে পড়তে হয়। যত সদ্য হবে সংবাদ, তত আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারবে। যত তাৎক্ষণিক হবে এর অভিঘাত, তত তার মূল্য। সেই বিচারে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ নয়। এটি গতকালও ঘটেছে, আজকেও ঘটছে, আগামী দিনেও ঘটবে। এটি নতুন কিছু নয়। এই সংবাদ মানুষের মনে আলোড়ন তুলবে না। ইয়াবার প্রবাহ বেড়ে যাওয়াটাও সেই অর্থে নতুন কোনো সংবাদ নয়। যেদিন ওই অদ্ভুত নামের মাদকটি প্রথম ঢুকল আমাদের দেশে, আমি শুনেছি মিয়ানমার থেকে, সেদিন থেকেই এটি পুরোনো সংবাদ। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে আমরা সমুদ্রযুদ্ধে জয়ী হয়েছি, এমনটিই ধারণা দিচ্ছে আমাদের সরকার ও মিডিয়া, কিন্তু মিয়ানমার আমাদের নুলো করে দিচ্ছে ইয়াবা দিয়ে। ভারত ফেনসিডিল দিয়ে।
এ জন্য অবশ্য এই দুই দেশের মাদক ব্যবসায়ীদের চেয়ে অনেক বেশি দায় বর্তায় আমাদের দেশের কিছু মানুষের ওপরই। যারা এসব আনছে দেশের ভেতর, বিপণন করছে, তারা বাংলাদেশেরই মানুষ। তাদের অনেকেই রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, তাদের পিঠে আছে আরও গুরুত্বপূর্ণদের হাত। এই যে অবাধে ইয়াবা ঢুকছে রাজধানীতে, তার পেছনে সক্রিয় একটি বিশাল চক্র। এই চক্রে যারা আছে, তারা প্রতিদিন হাসতে হাসতে দেশি-বিদেশি ব্যাংকে যায়। অথচ এদের লোভের কাছে বলি হচ্ছে অসংখ্য তরুণ। যাদের একটি অংশ শিক্ষিত বেকার।
শিক্ষিত বেকার শব্দ দুটিতে একটা কষ্ট ও হাহাকার আছে, গ্লানি ও লজ্জা আছে। সেটি প্রতিমুহূর্ত অনুভব করে যারা বেকার তারা; এবং তাদের আপনজনেরা।আমরা যারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের পড়িয়ে, পরীক্ষা নিয়ে তাদের হাতে একটা সনদ ধরিয়ে দিয়ে জীবনযুদ্ধে পাঠাই, তারা হয়তো কিছুটা এই কষ্ট, দুঃখ, গ্লানি বুঝতে পারি, কিন্তু আমাদের সাধ্য সীমিত। চাকরির বাজারে তাদের ঠেলে দেওয়ার পর তাদের আর কোনো কাজে আমরা আসি না। আমাদের আরও বড় ব্যর্থতা, যে শিক্ষা পেলে এরা প্রত্যাশামতো চাকরি পেত, নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারত, আত্মকর্মসংস্থান করতে পারত, সেই শিক্ষা আমরা দিতে পারছি না। প্রতিবছর আমরা অসংখ্য তরুণকে শিক্ষা শেষের সনদ দিচ্ছি এবং এই সংখ্যায় এখন ঊর্ধ্বগতি, কিন্তু যে মানের শিক্ষা তাদের আমরা দিচ্ছি, তা আন্তর্জাতিক তো দূরের কথা, আঞ্চলিক পর্যায় থেকেও পিছিয়ে আছে।
আমাদের দেশের তৈরি পোশাক খাত শুরু করে বড় বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোতে এখন কাজ করছেন এক বিরাটসংখ্যক ভারতীয় ও শ্রীলঙ্কান এক্সিকিউটিভ।বড় বড় বেতন দিয়ে তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কেন এই বিদেশি–নির্ভরতা, যেখানে আমাদের দেশে ব্যবসা ব্যবস্থাপনা, প্রকৌশলবিদ্যা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের অভাব নেই? এই প্রশ্নটি আমি করেছিলাম একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কাছে, যিনি নিয়োগ বাজারের ভালো খবর রাখেন। যোগ্যতার অভাব, তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন।আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে শিক্ষা দেয়, তা সনদমুখী, জীবনমুখী নয়। তিনি বললেন, প্রতিটি পেশায় সর্বোচ্চ সক্ষমতা অর্জনের যে জ্ঞান থাকার কথা, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তা দিতে পারে না। আমাদের স্নাতকদের ভাষাজ্ঞান, বিশেষ করে ইংরেজির ওপর দখল মোটেও পর্যাপ্ত নয়।‘বাজার খুব হৃদয়হীন একটা জায়গা’, তিনি জানালেন, ‘যোগ্যতা না থাকলে বাজার-দর্শনের কাছে আপন ভাইও কল্কে পায় না।’
তাঁর যুক্তি আমাদের মানতেই হয়। মুক্তবাজার অর্থনীতি, যার চাবুক ছুটিয়ে নিচ্ছে আমাদের বাজারের ঘোড়া, একটা ‘বৈশ্বিক’ মান চাপিয়ে দেয় আমাদের

ওপর। যারা সেই মানে পৌঁছে যায়, তারা তার আশীর্বাদ পায়।তবে পাশাপাশি একধরনের ডারউইনীয় অদৃষ্টবাদও এখানে কাজ করে—সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট—সবচেয়ে যোগ্যরাই এখানে টিকে থাকে।
অথচ শিক্ষার সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মান অর্জনের দিকে না গিয়ে আমরা যে শুধু শিক্ষার পরিমাণ বাড়াতেই ব্যস্ত এবং এ জন্য প্রতিবছর যে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা, এ বিষয়টা নিয়ে আমরা ভাবি না।আমি তো মনে করি, শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়া একটি জাতীয় লজ্জা এবং এর নিরসনে সব উদ্যোগ নেওয়াটা হওয়া উচিত জাতীয় একটি অগ্রাধিকার।সর্বোচ্চ পর্যায়ের অগ্রাধিকার।
কীভাবে এই সমস্যাটির সমাধান করা যায়? প্রশ্নটি আমি এক অর্থনীতিবিদ বন্ধুকে বলেছিলাম।বন্ধু জানালেন, দেশের প্রবৃদ্ধি যদি ৮-৯ শতাংশে পৌঁছানো যায়, যদি কৃষি থেকে নিয়ে যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি থেকে নিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ, সব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়ানো যায় কয়েক গুণ, যদি নতুন নতুন প্রবৃদ্ধি ও অভিঘাত ক্ষেত্র (তাঁর ভাষায় গ্রোথ এবং থ্রাস্ট সেক্টর) তৈরি ও সেগুলোর বিকাশ সাধন করা যায়, তাহলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা নূ৵নতম পর্যায়ে নামিয়ে আনা যায়।
আমি অর্থনীতিবিদ নই—এসব কীভাবে সম্ভব তা আমার ধারণায় তেমন স্পষ্ট হয় না। তবে এটুকু বুঝতে পারি, এই বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করার জন্য সরকারের যেমন সদিচ্ছা এবং স্পৃহা থাকতে হবে, তেমনি থাকতে হবে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের। অভাবটা এখানেই, যদিও বেসরকারি উদ্যোক্তারা তাঁদের মতো করে সক্রিয়, তাঁদের চিন্তায় থাকে বাজারমন্ত্র। কিন্তু লাভটা শুধু ব্যক্তিগত হলে চলবে না, লাভটা হতে হবে দেশের। তৈরি পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের বেতন ৩০০ টাকা বাড়ানোর কথা উঠলেই যেখানে মালিকদের একটা বড় অংশ বেঁকে বসেন, তাতে বেসরকারি খাতের ওপর ভরসা রাখা যায় না। তার পরও অনেক তরুণ উদ্যোক্তা এগিয়ে আসছেন। একদিন এ ক্ষেত্রেও একটা পরিবর্তন আসতে পারে কে জানে।
তবে সত্যিকারের পরিবর্তনটা হতে পারে শিক্ষা দিয়েই। আমরা যদি শিক্ষার ক্ষেত্রে একটা ব্যাপক গুণগত পরিবর্তন করতে পারি, তাহলে অন্য অনেক কিছুই আপনা থেকে বদলে যাবে। যদি সংস্কৃতির এবং নীতির শিক্ষা পায় কেউ, তার পক্ষে ইয়াবার ব্যবসা করাটা গর্হিত মনে হবে। সেই শিক্ষা যে উদ্যোক্তা পাবেন, তিনি নিজের লাভ কমিয়ে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়াবেন। একসময় আমাদের শিক্ষকেরা এই শিক্ষাই দিতেন, যদিও এর অভিঘাত থাকত সীমিত, যেহেতু শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা ছিল কম, দেশের জনগোষ্ঠীর ১০ থেকে ১৫ শতাংশের মাত্র সাক্ষরতা ছিল।
আমি বিশ্বাস করি, আমাদের বাজেটের ২৫ শতাংশ এবং জাতীয় উৎপাদনের ৬-৮ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ দিয়ে আমরা তা করতে পারি। তারপর ক্রমান্বয়ে এই বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। প্রতিটি গ্রামে একটি মানসম্পন্ন প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে, প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও তাঁদের সামাজিক মর্যাদা কয়েক গুণ বাড়িয়ে, তাঁদের ক্রমাগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে, পাঠ্যপুস্তক আকর্ষণীয় করে। পাঠদান আনন্দময় করে, গ্রন্থাগার-কম্পিউটার সুবিধা ইত্যাদি নিশ্চিত করে শিক্ষার্থীদের এক বেলার আহার দিয়ে, পর্যাপ্ত বৃত্তি দিয়ে, তাদের খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও সৃজনশীলতা বিকাশের পথ নিশ্চিত করে আমরা যাত্রা শুরু করতে পারি। শিক্ষা যে একটি জাতিকে উৎকর্ষের শক্তি জোগাতে পারে, তা তো পৃথিবীর যেকোনো উন্নত দেশের দিকে তাকালেই দেখা যাবে। মালয়েশিয়া অথবা দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি পঞ্চাশ-ষাটের দশকে আমাদের থেকে বেশি এগিয়ে ছিল না। অথচ শিক্ষায় বিনিয়োগ করে এখন তারা কোথায় গেছে, আর আমরা কোথায়! এখন প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে, উচ্চশিক্ষায় দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগ উঠলে দ্রুত
তা অস্বীকার করা হয়। অথচ শিক্ষিত বেকার তৈরির পেছনে এ দুই ব্যাধির প্রভাব অনস্বীকার্য।
কোনো দেশে শিক্ষিত বেকার থাকতে নেই, শিক্ষাহীন বেকারও। আমাদের দেশটা তো সব সম্ভবের দেশ। নানা অসম্ভব অপকর্মকে আমরা সম্ভব করেছি। এখন সত্যিকার কিছু সুকর্মকে সম্ভব করে বেকারত্ব নিরসন করার প্রতিজ্ঞা নিলে কেমন হয়?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।