যুক্তরাষ্ট্রে ইবোলা

আবদুল এল-সায়েদ
আবদুল এল-সায়েদ

টমাস এরিক ডানকানই প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইবোলা নিয়ে আসেন। তার আগে এটা পশ্চিম আফ্রিকার একটি রোগ হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে, যদি না কেউ সেখানে স্বেচ্ছাশ্রম দিতে যায়। ডানকানের শুশ্রূষাকারী দুই নার্সও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, ফলে যুক্তরাষ্ট্র এ রোগের প্রকোপ মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত, তা নিয়ে বেশ শোরগোল তৈরি হয়েছে। দুজন নার্স সম্ভবত মেডিকেল প্রটোকল ভঙ্গ করায় এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কিছুদিন আগে এই ভাইরাস চিহ্নিত, রোগীদের পৃথক্করণ ও এর নিয়ন্ত্রণ করতে ‘ইবোলা জার’ নিয়োগ দিয়েছেন।
মেডিকেল ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জনগণকে আশ্বাস দিয়েছেন, ভয়ের তেমন কোনো কারণ নেই। সেন্টারস ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো পর্দার আড়ালে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে, তারা চেষ্টা করছে ডানকানের সংস্পর্শে এসেছে এমন ব্যক্তিদের চিহ্নিত ও যাদের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে, তাদের আলাদা রাখতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কারণে সেখানে রোগের সংক্রমণ প্রায় অসম্ভব ব্যাপার, এমনই ধারণা করা হয়েছিল।
কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের আলোকে এসব স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোকে বিশ্বাস করার কিছু নেই। বস্তুত গত কয়েক দশকে সরকার শীর্ষ কয়েকটি স্বাস্থ্য সংস্থার বাজেট কমিয়ে দিয়েছে, এর মধ্যে আছে এনডিসি, দ্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ (এনআইএইচ) ও স্থানীয় এবং প্রাদেশিক স্বাস্থ্য বিভাগ। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৫ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সিডিসির তহবিল ১৭ শতাংশ কমেছে। আর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, ইবোলার মতো জরুরি রোগের চিকিৎসায় ২০০৩ সালে যে পরিমাণ বরাদ্দ ছিল, এখন তার পরিমাণ সেটার চেয়েও এক বিলিয়ন ডলার কম।
প্রাদেশিক ও স্থানীয় পর্যায়ে আরও বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগের ২৩ শতাংশ বলেছে, জনাস্বাস্থ্য প্রস্তুতি কর্মসূচি ২০১১ সালে এসে অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে, এমনকি তা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, আর ২০১২ সালে আরও প্রায় ১৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। যে হাসপাতাল প্রস্তুতি কর্মসূচির মাধ্যমে আঞ্চলিক হাসপাতালের সঙ্গে স্বাস্থ্য বিভাগের সমন্বয়ে সম্ভাব্য জরুরি জনস্বাস্থ্য হুমকি মোকাবিলা করা হতো, শুধু ২০১৪ সালেই সে কর্মসূচির বাজেট হ্রাস করা হয়েছে ১০০ মিলিয়ন ডলার।
এসব হ্রাসের প্রভাব ইতিমধ্যে অনুভূত হতে শুরু করেছে। উল্লিখিত হাসপাতাল প্রস্তুতি কর্মসূচির মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর্মীদের ইবোলার মতো জরুরি অবস্থায় স্বাস্থ্যসেবা দিতে প্রস্তুত করা হতো। এতে যদি যথাযথ পরিমাণ তহবিল দেওয়া হতো, তাহলে যে দুই নার্স ইবোলায় আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁরা হয়তো এখনো সুস্থই থাকতেন।
এনআইএইচ অনেক কাজ করলেও সংস্থাটির তহবিল হ্রাস করা হয়েছে। গত দশকের বেশির ভাগ সময়জুড়েই সংস্থাটির বাজেট এক জায়গায় স্থির ছিল। হ্যাঁ, এর একটি ব্যতিক্রমও আছে, তবে সেটা কমের দিকে, বেশির দিকে নয়। যেমন, ২০১৩ সালে এর বাজেট নাটকীয়ভাবে হ্রাস করা হয়েছিল। ফলে অনেক কার্যকর গবেষণা ল্যাবরেটরি বন্ধ হয়ে গেছে, আর ইবোলা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের মতো জীবন রক্ষাকারী গবেষণাও বন্ধ হয়ে গেছে।
এর একটি কারণ হতে পারে এ রকম যে এসব জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলো লোকচক্ষুর আড়ালে কাজ করে, এরা সাধারণত পাদপ্রদীপের আলোয় থাকে না। তারা হয়তো কোনো রোগের প্রকোপ কমাতে পারে, কিন্তু সেটার কোনো লক্ষণ থাকে না। তারা যে পরিশ্রম করে লোকে তা চোখে দেখতে পায় না। ফলে অর্থনীতির সুসময়েও সে খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির কোনো তাগিদ থাকে না, আর হ্রাসের ক্ষেত্রে প্রথম পছন্দ হয় তারা।
কিন্তু ইবোলার মতো এই সাম্প্রতিক মহামারিতে উল্লিখিত আর্থিক অগ্রাধিকারের অসাড়তা প্রকাশ পায়। আমরা স্বাস্থ্য অবকাঠামোতে তেমন একটা আলোকপাত না করলেও ইবোলার মতো রোগ ও মৃত্যু আমাদের দরজায় কড়া নাড়লে আমরা সবাই নড়েচড়ে বসি।
হ্যাঁ, যুক্তরাষ্ট্রে ইবোলা হয়তো মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়বে না, কিন্তু তার পরও আমাদের আত্মতৃপ্তির কোনো সুযোগ নেই। পশ্চিম আফ্রিকায় এ রোগের প্রকোপ যত বাড়ছে, তার সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়ার অন্যান্য স্থানেও এ রোগের বিস্তারের আশঙ্কা বাড়ছে। আর অন্যান্য দেশ এ মহামারি রোধ করতে না পারলে সবচেয়ে ধনী ও শক্তিশালী দেশ হিসেবে তখন যুক্তরাষ্ট্রেরই উচিত হবে এ রোগ দমনে এগিয়ে আসা।
কিন্তু উল্লিখিত বাজেট হ্রাসের কারণে যুক্তরাষ্ট্র তার বাধ্যবাধকতা পূরণ করতে পারছে না, আর এর ফল ভয়াবহ হতে পারে। এই সেপ্টেম্বরের শেষ ভাগে বারাক ওবামা লাইবেরিয়ায় ইবোলা মোকাবিলায় ৮৮ মিলিয়ন ডলার ও তিন হাজার সেনা পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত দিতে তিনি অনেক দেরি করে ফেললেন, এর মধ্যে ছয় হাজার মানুষ ইবোলায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং আরও অনেকেই হয়তো আক্রান্ত হবেন।
এখন উল্টো সিডিসি ও এর নেতৃত্ব ডানকানের সেবায় গাফিলতি ও এর ফলে ইবোলা ছড়িয়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে নানা রকম প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন। এখন যে আইনপ্রণেতারা সিডিসি নিয়ে মশকরা করছেন, তাঁরা যদি আগেই বাজেট হ্রাসের পরিণাম যে খারাপ হবে সে বিষয়ে দৃষ্টি দিতেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থায় পড়তে হতো না।
জনস্বাস্থ্যের মূল বিষয় হচ্ছে, রোগ হওয়ার আগে তা প্রতিরোধ করা। তার জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করতে পারে সেখানে দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ করতে হয়। আমাদের গণস্বাস্থ্য ও ভালো থাকাটাই হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতার প্রমাণ।
সৌভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে, এই ইবোলায় হয়তো যুক্তরাষ্ট্র তেমনভাবে আক্রান্ত হবে না, আর সে কারণে গত কয়েক বছরে দেশটির ভুল বাজেটের পরিণাম তেমন একটা ভয়াবহ হবে না। কিন্তু আমরা সতর্ক না হলে কী হতে পারে, সেটা অন্তত বোঝা যাচ্ছে। পরবর্তী মহামারি হয়তো আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। আমাদের এটা নিশ্চিত করতে হবে, যে আমরা এর জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
আবদুল এল-সায়েদ: কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এপিডেমিওলজির অধ্যাপক।