লতিফ উপাখ্যান ও মন্ত্রী হওয়ার শর্ত

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

সম্প্রতি সাবেক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর কিছু লাগামহীন মন্তব্য সরকারকে কীভাবে বেকায়দায় ফেলেছে এবং দেশবাসীকে কীভাবে বিক্ষুব্ধ করেছে, তা পাঠকের অজানা নয়। লাগামহীন মন্তব্যের জন্য লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা ও দল থেকে বরখাস্ত করাই কি যথেষ্ট? গত কয়েক বছর দুই মেয়াদে মন্ত্রী থাকার সুবাদে সিদ্দিকী দুই মন্ত্রণালয়ে কী পরিমাণ দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, তা-ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক হতেন, তাহলে লতিফ সিদ্দিকী সম্পর্কে বিভিন্ন দুর্নীতির রিপোর্ট প্রকাশের সূত্র ধরে তাঁর বিরুদ্ধে আগেই তদন্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি বিভিন্ন সংবাদপত্রের করা প্রতিবেদন আমলে আনেননি। কিন্তু হজ ও তাবলিগ সম্পর্কে লতিফ সিদ্দিকীর মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, লতিফ সিদ্দিকীর দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার সরকারের কাছে কোনো বড় অপরাধ ছিল না। মন্ত্রীরা তো এ রকম করতেই পারেন! দুর্নীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহার বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো বড় মাপের অপরাধ নয়। অনেকে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর বিদেশে চলে যাওয়ার সুযোগ নিচ্ছেন। বিদেশে ‘সেকেন্ড হোম’ বা ‘বেগমগঞ্জ’ হওয়ার পর দুই বড় দলের মন্ত্রী-সাংসদেরা দুর্নীতি নিয়ে তেমন ভয় পান না।
সাবেক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সংবাদপত্রে তাঁর দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার (দুই মেয়াদে) সম্পর্কে যে প্রতিবেদনগুলো প্রকাশিত হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তদন্তে যে ৪৫টি অভিযোগ পাওয়া গেছে (সূত্র: প্রথম আলো), এগুলো নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কী ভাবছেন, তা আমরা জানি না। প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরে অন্তত তিনটি আনুষ্ঠানিক বক্তৃতায় লতিফ সিদ্দিকীর বক্তব্য সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। এর আলোকে তিনি শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নিয়েছেন। কিন্তু লতিফ সিদ্দিকীর দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর মুখে কিছু শুনিনি। আমরা আশা করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো তদন্তের ব্যবস্থা করবেন। এ ব্যাপারে দুদকও যথাযথ ব্যবস্থা নেবে বলে সবাই প্রত্যাশা করে। লতিফ সিদ্দিকী যদি তদন্তে ও আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হন, তাহলে ভিন্ন কথা। কারও কিছু বলার থাকতে পারে না।
এ ধরনের সমস্যার সমাধান করতে হলে আরও গভীরে যেতে হবে। আমাদের সংবিধানের অনেক ধারা ত্রুটিপূর্ণ। ১৯৭২ সালের বাস্তবতায় এই সংবিধান প্রণীত হয়েছিল। এখন ২০১৪ সাল। এখন সংবিধানের অনেক ধারা কার্যকর নয়, বাস্তবসম্মতও নয়। কাজেই এই সংবিধান আগাগোড়া পর্যালোচনার জন্য একটা ‘কমিশন’ গঠন করা দরকার। এভাবে কাজ না করলে আমরা বর্তমান সংবিধানের নানা দুর্বল ধারার জন্য বারবার পিছিয়ে যাব। কারণ নির্বাচন, সরকার গঠন, সরকার পরিচালনা ও অন্যান্য প্রধান সব সরকারি কাজ এই সংবিধানের আলোকেই পরিচালিত হচ্ছে। এই সংবিধানের জন্যই ভোটারবিহীন নির্বাচনে ‘জয়ী’ হয়ে সরকার গঠন করা যায়। প্রধানমন্ত্রী পদটি মোগল সম্রাটের চেয়েও শক্তিধর বলে মন্তব্য করেছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারেরই একজন সাবেক উপদেষ্টা। এ রকম বহু দুর্বলতায় আক্রান্ত আমাদের পবিত্র সংবিধান।
সংবিধানের একটা দুর্বলতা নিয়েই আলোচনা করব। সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে এককভাবে মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষমতা দেওয়া ঠিক হয়নি। এই একটি ধারা দিয়েই ‘প্রধানমন্ত্রী’ অতি ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছেন। (সব আমলে) তিনি, তাঁর দল ও অন্যান্য নেতা থেকেও বড় হয়ে উঠেছেন। তিনি যাঁকে-তাঁকে মন্ত্রী করতে পারেন। মন্ত্রিত্ব দেশের খুব গুরুত্বপূর্ণ পদ। এই পদে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা শুধু একজন নির্বাচিত ব্যক্তিকে দেওয়া ঠিক হয়নি। যাঁকে-তাঁকে মন্ত্রী করলে কী হয়, তার পরিণাম কি আমরা এখন দেখছি না? সংবিধানের ধারাটি যদি এমন হতো, ‘সংসদনেতা তাঁর সংসদীয় দল ও দলের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও সম্মতির মাধ্যমে মন্ত্রিসভা গঠন করবেন।’ তাহলে মন্ত্রিসভা গঠনের পদ্ধতি অনেক গণতান্ত্রিক হতো। এক ব্যক্তির ইচ্ছায় হতো না। দলের গঠনতন্ত্রেও মন্ত্রিসভা গঠনের কিছু দিকনির্দেশনা থাকতে পারে। প্রধানমন্ত্রীকে তা মানতে হতো।
দ্বিতীয় দুর্বলতা, মন্ত্রিসভার প্রধান অংশ সাংসদদের মধ্য থেকে নিতে হবে। এটাও ঠিক নয়। তাঁরা নির্বাচনে জয়লাভ করে সাংসদ হয়েছেন আইন প্রণয়নের জন্য, কোনো মন্ত্রণালয় পরিচালনার জন্য নয়। মন্ত্রণালয় পরিচালনা সার্বক্ষণিক কাজ এবং অনেক বড় কাজ। এবং বিশেষজ্ঞের কাজ। সরকারি দলের সাংসদদের মধ্যে মন্ত্রী হওয়ার মতো কিছু যোগ্য লোক থাকতেও পারেন। প্রধানমন্ত্রী ও দল নিশ্চয় তাঁদের মন্ত্রী করবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যেন সাংসদদের মন্ত্রী করতে বাধ্য না হন। পরিবার, বংশ, জনপ্রিয়তা, উত্তরাধিকার, দলের প্রতীক, ধনী লোক ইত্যাদি কারণে মানুষ সাংসদ নির্বাচিত হন। শিক্ষা, বিশেষজ্ঞ জ্ঞান, ব্যক্তিগত গুণাবলি ও দক্ষতার জন্য খুব কম ব্যক্তিই নির্বাচিত হন। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য বহু ফ্যাক্টর কাজ করে। নির্বাচনী প্রতীকের জোরে কলাগাছও নির্বাচিত হতে পারে। এই অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। দলের মধ্যে শিক্ষা, বিশেষজ্ঞ জ্ঞান, সততা ও অভিজ্ঞতায় যাঁরা শ্রেষ্ঠ, তাঁদেরই মন্ত্রী করা উচিত। দলের অন্য নেতাদের নানাভাবে পুরস্কৃত করা যেতে পারে। ‘মন্ত্রিত্ব’ যেন পুরস্কারের বিষয় না হয়। মন্ত্রিত্ব অনেক বড় কাজ। আমাদের বড় দুটি দল ‘মন্ত্রিত্বকে’ দুধ-ভাত করে ফেলেছে। এটা ঠিক নয়।
বিভিন্ন জেলা থেকে ‘মন্ত্রী’ নিতে হবে, এই ধারণাও ঠিক নয়। নির্বাচিত দল তাদের দলের প্রতি, আদর্শের প্রতি অনুগত সমাজের শিক্ষিত, সৎ, বিশেষজ্ঞ, অভিজ্ঞ ও মন্ত্রণালয়ে নেতৃত্বদানে সক্ষম ব্যক্তিদেরই মন্ত্রী করা উচিত। তাঁদের কেউ কেউ ঘটনাচক্রে সাংসদও হতে পারেন। কিন্তু সাংসদ বলেই তিনি মন্ত্রী হবেন, এমন যেন না হয়। যোগ্য, দক্ষ ও সৎ ব্যক্তিদের মন্ত্রী করতে না পারলে কোনো সরকারই সুশাসন ও উন্নয়নের নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। অযোগ্য ও দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীদের আমলারা তাঁদের হীন স্বার্থে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে পারেন। মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য প্রধানমন্ত্রী তাঁর দল ও সংসদীয় দলের সঙ্গে অবশ্যই প্রকাশ্যে মিটিং করবেন। শুধু আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে নেপথ্যে আলোচনা করে মন্ত্রিসভা গঠন করলে তার ফল কী হয়, তা তো আমরা দেখেছি।
অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের ও সংসদীয় গণতন্ত্রের উদাহরণ টেনে এই প্রস্তাব খারিজ করা যাবে না। কারণ, আমাদের দূষিত রাজনীতি, প্রশাসনে দলীয়করণ, পরিবারতন্ত্র, দুর্বল নির্বাচন কমিশন, ভোটের দুর্নীতি, টাকার খেলা, ভোটে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ, ভোটে মাস্তানি, ভোট জালিয়াতি ইত্যাদি অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে তেমন দেখা যায় না। অন্তত বাংলাদেশের মতো দেখা যায় না। আমাদের দেশের বাস্তবতায় আমাদের সংবিধান হতে হবে। যুক্তরাজ্য বা ভারতের বাস্তবতায় আমাদের সংবিধান হলে প্রকৃত ফল আমরা পাব না।
মন্ত্রিসভায় এমন একটা সিদ্ধান্ত থাকা উচিত: কোনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে বড় মাপের দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় একটি তদন্ত করবে। তদন্তের প্রাথমিক প্রতিবেদনে যদি অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয়, তাহলে সেই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের আইনি প্রক্রিয়া শুরু হবে। সেই মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে। যদি গণমাধ্যমের প্রতিবেদন মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তাহলে ক্ষমতাসীন দল বা মন্ত্রী প্রেস কাউন্সিলে মামলা দেবেন। প্রেস কাউন্সিলের রায়ে সেই পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে এবং মন্ত্রীকে কোটি টাকার অঙ্কে মানহানির ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এভাবে কাজ করলে গণমাধ্যমে অসত্য প্রতিবেদন প্রকাশ বন্ধ হবে। আর সত্য প্রতিবেদনের জন্য মন্ত্রীর সাজা হবে এবং তিনি মন্ত্রিত্ব হারাবেন। তবে সব রকম তদন্তই তিন থেকে চার মাসের মধ্যে বাধ্যতামূলক সম্পন্ন করতে হবে।
লতিফ সিদ্দিকীর মতো একজন মন্ত্রী বরখাস্ত হওয়ায় শাসন পরিস্থিতির তেমন বড় পরিবর্তন হবে না। দেশে দুর্নীতি হ্রাসে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে সংবিধানের বিভিন্ন ধারা পরিবর্তন, সরকারের কতগুলো সিদ্ধান্ত ও নীতি গ্রহণ করতে হবে, যাতে এই নীতি ও সিদ্ধান্তের জাঁতাকলে সব দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী ও সাংসদ আটকে যান। এ রকম কিছু নীতি গ্রহণ করলে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতাও প্রমাণিত হবে। একজন দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীকে বরখাস্ত করা তেমন বড় ঘটনা নয়। যদিও সরকার এ ঘটনাকে বড় করে প্রচার করতে চাইবে। আশা করি পাঠক এতে বিভ্রান্ত হবেন না।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।