ঈদের খাবারে সতর্কতা প্রয়োজন

এই সেমাই কতটা ভেজালমুক্ত?
এই সেমাই কতটা ভেজালমুক্ত?

ঈদে জর্দা খাওয়ার জন্য জাফরানি রং কিনতে গিয়ে আপনি ঠকবেন, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। কারণ, জাফরানি রং অত্যন্ত দামি বলে ১০-২০ টাকার জাফরানি রং কোনো দোকানির পক্ষে বিক্রি করা সম্ভব নয়। জাফরানি রং বলে অসাধু দোকানদার আপনাকে দিতে পারে একই রকম দেখতে টেক্সটাইল রং। একই রকম দেখতে ফুড কালার অবশ্য আছে, যা কম ক্ষতিকর, তবে এর দাম কিছুটা বেশি। দোকানির দেওয়া রংটি ফুড না টেক্সটাইল রং, তা চেনার সহজ উপায় হলো, একটুখানি রং হাতে নিয়ে ঘষুন, এরপর পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। ফুড কালার হলে হাতে লেগে থাকবে না। তাই ঝুঁকি না নিয়ে রংহীন জর্দা খাওয়ার অভ্যাস করুন। নিতান্তই জর্দাকে রঙিন করতে হলে গাজর বা বিটের কুচি বা কমলার খোসা পিষে রসটুকু ব্যবহার করা যেতে পারে। একই কারণে পোলাও, বিরিয়ানি বা শরবতেও কৃত্রিম রঙের ব্যবহার বর্জন করা ভালো। পোলাও-বিরিয়ানি বা কোর্মায় ঘি ব্যবহার না করাই ভালো। ভেজালের দৌরাত্ম্যে বাজারে আসল ঘি প্রায় পাওয়াই যাচ্ছে না, তবে ঘিয়ের গন্ধযুক্ত অন্যান্য জিনিস পাওয়া যায়। ঘি পরিহার করে তাই সয়াবিন দিয়ে রান্না করাই ভালো। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কমার পাশাপাশি রক্তে কোলেস্টেরল জমার আশঙ্কাও কমবে।

ইদানীং কেউ কেউ খাঁটি সরিষার তেলের পোলাও-বিরিয়ানি রান্না করছেন। এর স্বাদও চমৎকার। তবে সরিষার তেলটি খাঁটি কি না, তা নিশ্চিত হতে হবে। কারণ, বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির বিজ্ঞাপিত ও প্রচুর বিক্রীত অনেক  সরিষার তেলের অস্বাভাবিক ঝাঁজ দেখেই বোঝা যায় যে এগুলো নকল সরিষার তেল। স্বাভাবিক সরিষার তেলে এত ঝাঁজ থাকবে না। এলাইল আইসোথায়োসায়ানেট নামের রাসায়নিক উপাদান সরিষার তেলের ঝাঁজের জন্য দায়ী। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঝাঁজওয়ালা এসব তেল শরীরের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের বাজারের অধিকাংশ হলুদ-মরিচ-ধনে-জিরার পাউডারে ভেজাল পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে, হলুদ ও মরিচের গুঁড়ায় পাওয়া গেছে যথাক্রমে সুদান রেড ও লেড ক্রোমেট। সুদান রেড ক্যানসার তৈরি করে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক কয়েক দশক ধরে নিষিদ্ধ। আর লেড ক্রোমেট লিভারের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এবং হেভি মেটাল পর্যায়ভুক্ত বলে শরীর থেকে সহজে বেরিয়ে না গিয়ে জমে থাকে এবং দীর্ঘকাল ধরে ক্ষতি করে। এসব নকল মসলা দিয়ে রান্না করা তরকারিতে স্বাভাবিক স্বাদ থাকে না, আবার তরকারিও হয় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি রঙিন। শহুরে জীবনে শিল-নোড়ার ব্যবহার অসুবিধাজনক বলে ভেজাল গুঁড়া মসলার বিকল্প হিসেবে আস্ত মসলা কিনে মেশিনে ভাঙিয়ে নেওয়া বা ব্লেন্ডারে গুঁড়া করা আপনার সতর্কতার একটি অংশ হতে পারে। টেক্সটাইল কালারের কারণে বাজারের অধিকাংশ সস ও আচার খাওয়ার অযোগ্য। ক্ষতিকর এই রং আমাদের দেশে চকলেট-আইসক্রিম-দই-মিষ্টি ইত্যাদি তৈরিতে এখনো দেদার ব্যবহূত হচ্ছে। আমাদের দেশে শরবত তৈরিতে ব্যবহূত প্রায় সব পাউডার—গ্রানিউলস বা কনসেনট্রেটে খাদ্য-নিষিদ্ধ টেক্সটাইল কালার রয়েছে। এগুলো ব্যবহারে তাই সাবধান হওয়া উচিত। আমাদের সচেতন হওয়া উচিত যে দই কখনো হলুদ রঙের হতে পারে না। যত গাঢ় দুধ দিয়েই তা তৈরি হোক না কেন, দই সাদাই থাকবে। তাই স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনা করে হলুদ রঙের দই বর্জন করুন, সাদা রঙের দই কিনুন। মিষ্টির বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য, স্বাস্থ্যরক্ষার কারণে কৃত্রিম রংহীন মিষ্টি খাওয়ার অভ্যাস করুন। আম-কমলার তথাকথিত জুসগুলো মূলত কৃত্রিম, কিন্তু প্যাকেটের গায়ে ‘কৃত্রিম জুস’ কথাটি লেখা থাকে না। এগুলোতে আম-কমলার উপযুক্ত উপস্থিতি নেই। এগুলোতে এমন সব কৃত্রিম রং ব্যবহার করা হয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ নয়। বিজ্ঞাপনের মোহে পড়ে, বিশেষ করে বাচ্চারা যেন এসব তথাকথিত জুস অতিরিক্ত খেতে শুরু না করে সে বিষয়ে সতর্ক হোন। কারণ, বাচ্চাদের লিভার-কিডনি-অস্থিমজ্জা-ফুসফুস সবই অপরিণত বলে ক্ষতিকর রংগুলো বড়দের চেয়েও বাচ্চাদের ক্ষতি করে বেশি। ঈদে নিশ্চয়ই প্রচুর কোল্ড ড্রিংকস খাওয়া হবে। মাঝেমধ্যে কোল্ড ড্রিংকস খাওয়া ক্ষতিকর নয়, তবে বেশি পরিমাণে বা নিয়মিত খাওয়া ক্ষতিকর। বিকল্প হিসেবে আপনি বরফ মিশিয়ে লেবুর শরবত খান। ডায়াবেটিস থাকলে লবণ মিশিয়ে লেবুর শরবত খাওয়া যেতে পারে। তবে উচ্চ রক্তচাপ থাকলে লবণও বাদ দিতে হবে। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ, নিরাপদতম ও উপকারী কোল্ড ড্রিংকস হলো বরফ মেশানো লেবুর শরবত। আমাদের দেশে ইদানীং লেবুর প্রচুর ফলন হচ্ছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ১০ টাকা দিয়ে এক ব্যাগ লেবু পাওয়া যায়। আসুন, কোল্ড ড্রিংকসের বদলে লেবুর শরবতে অভ্যস্ত হই। বাজারে বেশ কিছু এনার্জি ড্রিংকস বিভিন্ন নামে পাওয়া যাচ্ছে। মনে রাখবেন, এগুলো বাচ্চাদের জন্য নয়, প্রবীণদের জন্যও নয়। কারণ, এগুলোতে থাকে অতি উচ্চমাত্রার সুগার ও ক্যাফেইন। নিষিদ্ধ কোনো উত্তেজকও এগুলোতে মেশানো হয় কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। তাই এগুলো শুধু তরুণেরাই পরিমিত মাত্রায় খেতে পারে, কিন্তু বৃদ্ধ ও বাচ্চারা কখনোই নয়।

কেউ যদি ভেবে থাকেন যে আমাদের দেশে তৈরি পণ্যগুলোতেই শুধু ভেজাল থাকে, অতএব এগুলোর বদলে বিদেশি খাদ্যসামগ্রী ব্যবহার করাই ভালো, তাহলে ভুল করবেন। আমদানিকৃত অনেক খাদ্যসামগ্রীতেও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এসব উপাদানের মধ্যে ক্ষতিকর রং, ক্ষতিকর টেস্টিং সল্ট এবং ক্ষতিকর কৃত্রিম মিষ্টিকারক প্রধান। অনেক সময় এগুলোতে উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ থাকে না, ব্যবহূত সব উপাদানও তারা অনেক ক্ষেত্রে উল্লেখ করে না। আমাদের দেশে কোনো কেন্দ্রীয় খাদ্যমান নিয়ন্ত্রণ সংস্থার অনুপস্থিতির কারণে বিদেশি খাদ্যসামগ্রী কেনার সময়ও সতর্কতার সঙ্গে দেখেশুনে কেনার কোনো বিকল্প নেই। শরীর আপনার। শরীরের ভালোমন্দ দেখার দায়িত্বও প্রধানত আপনার। আমাদের মতো গরিব দেশে রাষ্ট্র ও সরকারের সচেতনতা আপনার-আমার সচেতনতার পরিপূরক মাত্র। যত দিন পর্যন্ত খাদ্যের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা বিষয়ে উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় পরিবেশ তৈরি না হচ্ছে, তত দিন আপনাকে-আমাকে নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই খাদ্যের ভেজাল ও ক্ষতি বিষয়ে সচেতনতা ও সতর্কতার বোধকে আরও শাণিত করতে হবে। আসুন, আমরা এ সতর্কতাকে নিয়মে ও অভ্যাসে পরিণত করি। সবার জন্য ঈদ হোক অসীম আনন্দের ও সুস্বাস্থ্যের।

আ ব ম ফারুক: অধ্যাপক, ওষুধপ্রযুক্তি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।