ইউরোপে ইসলামবিদ্বেষ ও তার প্রতিক্রিয়া

ইসলামবিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে ইউরোপের প্র​ি​তরোধও কম জোরদার নয়
ইসলামবিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে ইউরোপের প্র​ি​তরোধও কম জোরদার নয়

আপাতদৃষ্টিতে হঠৎ করেই জার্মানিসহ ইউরোপের নানা দেশে ইসলামবিরোধী আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বলে মনে হলেও ঘটনা আদতে তা নয়। এর পেছনে রয়েছে ইউরোপের ধর্ম-বর্ণবাদী দল ও গোষ্ঠীগুলোর দীর্ঘ রাজনীতি। ইউরোপের মূলধারার ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের বিভিন্ন ত্রুটিপূর্ণ ও অর্থনৈতিক সুবিধাবাদী রাজনীতির উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে ইউরোপে বসবাসরত মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু মানুষের আচরণের প্রতিক্রিয়াও একে বলা যায়।
সেই আশির দশক থেকে আফগানিস্তান, পরে ইরাক, ইরান, লিবিয়া, সিরিয়া, আমেরিকার টুইন টাওয়ারে হামলা আর তারও আগে ফিলিস্তিনিদের নিয়ে ইউরোপীয় রাজনীতি ক্রমেই ইউরোপের সঙ্গে ইসলামি ধর্মবিশ্বাসীদের দূরত্ব তৈরি করেছে। অবশ্য আরব প্রতিবেশীদের এসব সমস্যা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের নির্লিপ্ত ধনী দেশগুলোকেও একইভাবে দায়ী করা যায়।
ইউরোপে মুসলমানদের বসবাসের ইতিহাসটা বেশ পুরোনো। ইউরোপীয় দেশগুলোর ঔপনিবেশিক রাজনীতি তথা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী অতিথি শ্রমিক হিসেবে বহু আগে থেকেই ইউরোপে মুসলমানদের আগমন ঘটেছে। অবশ্য সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, তুরস্কের ইউরোপীয় অংশ এবং বুলগেরিয়া, আলবেনিয়া, মন্টিনিগ্রো, বসনিয়া হার্জেগোভিনা ও কোসোভোতে অনেক আগে থেকেই মুসলমান জাতিগোষ্ঠী রয়েছে।
ইউরোপে ৮৫৩ মিলিয়ন (প্রায় ৮৫ কোটি) মোট জনসংখ্যার মধ্যে মুসলমান নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ৬০ মিলিয়ন (ছয় কোটি)। তবে দেশভাগে বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের বসবাসের তারতম্য আছে। নানা ধর্মবিন্যাসে ইউরোপের ৭০ শতাংশ মানুষ খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। ইউরোপে বসবাসরত বেশির ভাগ মুসলমান ইউরোপীয় সেক্যুলার চিন্তাচেতনায় প্রভাবিত। তবে এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ইউরোপে বসবাসরত মুসলমান পরিবারগুলোর নতুন প্রজন্মের বেশির ভাগ সন্তান উচ্চশিক্ষা নিতে অনাগ্রাহী এবং ৫০ শতাংশের বেশি পরিবার কর্মসংস্থানের চেষ্টা না করে বসবাসরত দেশগুলোর সামাজিক ভাতা নিয়ে চলতে অধিক আগ্রহী। এ ছাড়া লন্ডনসহ বিভিন্ন বড় শহরে দেশীয় টেলিভিশনের চ্যানেলগুলোর চাঙ্কগুলো পিক আওয়ারে ভাড়া নিয়ে ধর্মের নামে নানা অজুহাতে প্রবাসীদের কাছে চাঁদা আদায় করতে সচেষ্ট থাকে। ইউরোপে বসবাসরত মুসলমান পরিবারগুলো থেকে জিহাদি যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য বিগত বছরগুলোতে প্রায় কয়েক হাজার তরুণের ইরাক ও সিরিয়া গমনের ঘটনা নিয়ে যখন ইউরোপে বেশ সমালোচনা হচ্ছে এবং এই জিহাদি যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে যখন নিষেধাজ্ঞা বজায় হতে যাচ্ছে, তথন প্যারিসের এ ঘটনা ইউরোপে বসবাসরত মুসলমানদের আবারও নতুন করে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলল। এখানে উল্লেখ্য, ফ্রান্সসহ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশও সিরিয়ার আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে উৎসাহিত করে আসছিল।
দামেস্কে জন্মগ্রহণকারী জার্মানির গোয়েটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য অধ্যাপক ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক বাসাম মুহাম্মদ টিবি ২০০৯ সালে তাঁর ইউরো ইসলাম বইয়ে লিখেছেন, ‘ইউরোপে বসবাসরত মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি যত দিন ইসলামের শরিয়া আইন ও জিহাদি আন্দোলনের খোয়াব থেকে বেরিয়ে আসতে না পারবে, তত দিন তাঁদের এখানে বসবাসের পরিবেশ অনুকূল হবে না।’
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউরোপের নানা দেশে কট্টর জাতীয়তাবাদী, ইসলামবিদ্বেষী বা নব্য নাৎসি দলগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এদের পুঁজি কৌশলী সস্তা স্লোগান, অভিবাসীবিদ্বেষী আস্ফালন তথা ইসলামবিদ্বেষ। ইদানীং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইউরোপীয় ঐক্যের বিরোধিতা। এই কৌশল অবলম্বন করে এরা ফ্রান্স, হল্যান্ড, জার্মানি, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, গ্রিস, ইতালি প্রভৃতি দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ২০০৭ সাল থেকেই ইউরোপজুড়ে ‘ঐতিহ্য, পরিচয়, সার্বভৌমত্ব’ নামে উগ্র জাতীয়তাবাদী ফোরাম গড়ার লক্ষ্যে ইতালির সাবেক ফ্যাসিস্ট নেতা বেনিটো মুসোলিনির নাতনি আলেকসান্দ্রা মুসোলিনি, ফ্রান্সের জ্যঁ পেন, অস্ট্রিয়ার ইয়র্গ হের্ডার চেষ্টা চালান। পরে তা সাফল্যের মুখ না দেখলেও গত বছরের মে মাসে অনুষ্ঠিত ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে ফ্রান্সের কট্টরবাদী নেতা জ্যঁ পেনের মেয়ে মেরিনা লি পেন সুইডেন ডেমোক্রেটিক দলের সভাপতি জিমি আকেশন, বেলজিয়ামের ভ্লামস ব্লকের ফিলিপ ডেভেন্টার, অস্ট্রিয়ার ফ্রিডম পার্টির নেতা হাইঞ্জ ক্রিস্টিয়ান স্টার্খে ও ইতালির লিগা নর্ড দলের উমবের্টো বসির সঙ্গে আলোচনা সেরেছিলেন। এর বাইরে ব্রিটিশ ন্যাশনাল পার্টি, হাঙ্গেরির জবিক পার্টি ও জার্মানির ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক দলের সঙ্গে একযোগে জোটবদ্ধ হয়ে ইউরোপে একটি জোট গঠন করতে চেয়েছিলেন।
এ ধরনের দলগুলোর আপাতত লক্ষ্য হলো: ১. ২৮টি ইউরোপীয় দেশের সমন্বয়ে ঘটিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের শক্তিকে খর্ব করা, ২. পূর্ব ইউরোপীয় বেকার মানুষের ক্রমান্বয়ে পশ্চিম বা মধ্য ইউরোপীয় দেশগুলোতে চাকরি খোঁজার বিরুদ্ধে সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ, ৩. ইউরোপে শরণার্থীদের আগমন রোধ এবং মুসলমানদের চলাফেরা ও ধর্মীয় অনুশাসনের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে জোট বাঁধা। তবে এখন পর্যন্ত এসব দাবি বাস্তবায়নের সামর্থ্য তাদের হয়নি।
সম্প্রতি গত বছরের অক্টোবর মাস থেকে প্রতি সোমবার সন্ধ্যায় জার্মানির পূর্বাঞ্চলের শহর ড্রেসডেনে ‘পাশ্চাত্যে ইসলামীকরণের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমী ইউরোপীয়বৃন্দ’ বা পেগিডা আন্দোলনের সমর্থনে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হচ্ছেন। প্যারিসের সন্ত্রাসী ঘটনার পর ইউরোপে ইসলামবিরোধী আন্দোলনের সমর্থকেরা শোক মিছিলের নামে ১২ জানুয়ারি সোমবার ২৯ হাজার লোকের সমাবেশ ঘটাতে সমর্থ হন। যদিও ড্রেসডেনের সমাবেশের দুই দিন আগে ১০ জানুয়ারি পেগিডা আন্দোলনের বিরুদ্ধে ড্রেসডেনে ৩৫ হাজার মানুষ বিক্ষোভ করেন।
কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে শুরু হওয়া ইসলামবিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে জার্মানিতে গত সোমবার সন্ধ্যায় বিভিন্ন শহরে পেগিডা আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে প্রতিকূল আবহাওয়া ও প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে প্রায় এক লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। পেগিডাবিরোধী সব থেকে বড় সমাবেশ হয়েছে লাইপজিগের শহরে, সেখানে প্রায় ৩০ হাজার ও হ্যানোভারে ২৯ হাজার মানুষ জমায়েত হন।
মধ্য ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্সেই সব থেকে বেশি মুসলমানদের বসবাস। প্যারিসের সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী ঘটনার পরপরই প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ তাৎক্ষণিক বলেছেন, ফ্রান্সে বসবাসরত সব নাগরিকের স্বার্থ ও ঐক্য অক্ষুণ্ন রেখে এ ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের বিচার করা হবে এবং কোনোভাবেই ধর্মের নামে সমাজকে বিভক্ত করা যাবে না। অপর দিকে ফ্রান্সের ইসলামবিদ্বেষী কট্টরবাদী ফ্রন্ট ন্যাশনালের নেতা মেরিনা লি পেন ঘটনার পরদিনই এ ধরনের সন্ত্রাসীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আইন করার জন্য ভোটাভুটির দাবি করেন এবং ২০১৭ সালে তিনি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে এ আইন প্রণয়ন করবেন বলে জানিয়েছেন। জার্মানির ইসলামবিরোধী আন্দোলনের নেতা আলেকজান্ডার গাউল্যান্ড প্যারিসের এ ঘটনাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে নিয়ে আন্দোলনকে আরও জোরদার করবেন বলে জানিয়েছেন।
নতুন বছরের শুরুতেই শুভেচ্ছা বক্তব্যে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল জার্মানিতে ইসলামবিরোধী আন্দোলনের প্রচণ্ড সমালোচনা করে জার্মানির জনগণকে এই আন্দোলন থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। তিনি পুনরায় সাবেক জার্মান রাষ্ট্রপতি ক্রিশ্চিয়ান ভুল্ফের বক্তব্য স্মরণ করে বলেন, ‘ইসলাম ধর্মও জার্মানির অন্তর্গত।’ তিনি ২০১৪ সালে জার্মানিতে আসা সিরিয়ার প্রায় দুই লাখ শরণার্থীকে জার্মানিতে থাকার ব্যাপারটিও বিবেচনা করবেন বলে জানান।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে স্থানীয় সমস্যা ও ইসলামি জঙ্গিদের সন্ত্রাসী ঘটনাকে পুঁজি করে ইসলামবিরোধী আন্দোলন দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও আশার কথা যে সব জায়গায় রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে এরা প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে।
সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি।
[email protected]