সংকট নিরসনে শান্তিপূর্ণ সমঝোতা

ধর্ম
ধর্ম

জনজীবনে নিরাপত্তা, শান্তিশৃঙ্খলা, সুখ-সমৃদ্ধি, ঐক্য-সম্প্রীতি, সাম্য-মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের নিদর্শনস্বরূপ ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে পারস্পরিক স্নেহ-মমতা, শ্রদ্ধাবোধ, সহানুভূতি, সহমর্মিতা, পরমতসহিষ্ণুতা ও ধৈর্য-সহনশীলতা থাকা উচিত। সভ্য সমাজে থাকতে পারে না কোনো প্রকার দ্বন্দ্ব-কলহ, ঝগড়া-বিবাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, গোলমাল-হানাহানি, সংঘাত-সংঘর্ষ, ফিতনা-ফ্যাসাদ, সহিংসতা-উগ্রতা, নাশকতা-নৃশংসতা, হিংসা-বিদ্বেষ, অনিষ্ট ও অকল্যাণের অশুভ লক্ষণ। মানবসমাজে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী অন্যায় ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপকে ইসলাম সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছে এবং পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের পর এতে তোমরা বিপর্যয় ঘটাবে না।’ (সূরা আল-আরাফ, আয়াত: ৫৬)
বিভিন্ন দলমতের কলহ-বিবাদ ও ফিতনা-ফ্যাসাদ সামাজিক অনাচার, জুলুম-নির্যাতন, দমন-নিপীড়ন ও অন্যায়-অত্যাচারের অন্যতম কারণ। দ্বন্দ্ব-কলহ মানুষের জীবনে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা ঘটায়। মানবতার ঐক্য ও জাতীয় সংহতিতে ভাঙন সৃষ্টি করে সেখানে বিভেদ, অনৈক্য ও বিভক্তি নিয়ে আসে। ফিতনা-ফ্যাসাদের ফলে পরস্পরের মধ্যে মারাত্মক হিংসা-বিদ্বেষ, শত্রুতা-বৈরিতা ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা সৃষ্টি হয়। অনেক সময় সামান্য তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে জাতি-গোত্রে তুমুল ঝগড়া-বিবাদ ঘটে এবং ফিতনা বড় আকারের সামাজিক বিশৃঙ্খলায় রূপ ধারণ করে মানবসমাজে অহেতুক হত্যাযজ্ঞের মতো মহাপাপ সংঘটিত হয়ে থাকে। তাই পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘ফিতনা হত্যা অপেক্ষা গুরুতর।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯১)
ঝগড়া-বিবাদ ও ফিতনা-ফ্যাসাদের কারণে সমাজে পরচর্চা, পরনিন্দা, কুৎসা রটনা, ঠাট্টা-বিদ্রূপ, হিংসা-বিদ্বেষ, অপবাদ, মিথ্যা দোষারোপ প্রভৃতি নানা ধরনের নিন্দনীয় কর্মকাণ্ডের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এতে মানুষের সৎকর্ম বিনষ্ট হয়ে যায়। সাধারণত পারস্পরিক গালিগালাজ, ঝগড়া-বিবাদ, দ্বন্দ্ব-কলহ, অশ্লীল ও আশালীন কথাবার্তার মাধ্যমে ফিতনা-ফ্যাসাদ শুরু হয়। এ অবস্থায় মানুষ ইমানদার থাকা তো দূরের কথা, পশুর চেয়েও নিম্নস্তরে নেমে যায়। তাই সমাজ থেকে এসব অসদাচরণ অবশ্যই বর্জন করা দরকার। রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা অন্যের দোষ-ত্রুটি অন্বেষণ করবে না, গুপ্তচরবৃত্তি করবে না, পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়া-ফ্যাসাদ করবে না, পরস্পরের সঙ্গে হিংসা-বিদ্বেষ করবে না, পরস্পরকে ঘৃণা করবে না এবং পরস্পরের ক্ষতিসাধন করার জন্য পেছনে লাগবে না। আর তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দা হিসেবে ভাই ভাই হয়ে যাবে।’ (বুখারি ও মুসলিম) সমাজে মিথ্যা দোষারোপ ও তর্ক-বিতর্ক জনজীবনে দুঃখ-কষ্ট বয়ে আনে এবং মানুষের গোপন রহস্য বা দোষ-ত্রুটি ফাঁস করে দেয়। ফিতনা-ফ্যাসাদের বিরুদ্ধাচরণ করে নবী করিম (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘তুমি তোমার ভাইয়ের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হবে না।’ (তিরমিজি)
ইসলামে মুসলমানদের ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব-সংঘাত, সংঘর্ষ-সহিংসতা, নাশকতা-নৃশংসতা, নির্মমতা-বর্বরতা ও কলহ-বিবাদের মতো ঘৃণ্যতর কাজ থেকে বিরত থাকার দিকনির্দেশনা রয়েছে। কোনো মুমিন বান্দা যে পর্যন্ত দ্বন্দ্ব-কলহ বর্জন না করবে, সে পর্যন্ত তার ইমানের বাস্তব রূপের পরিপূর্ণতা বিধান করতে পারবে না। তাই ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে প্রত্যেক মানুষের অভ্যন্তরীণ কলহ-বিবাদ ও উদ্ভূত সংকট সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে দ্রুত নিরসন করা উচিত।
ইসলাম মানুষের ঝগড়া-বিবাদ ও দ্বন্দ্ব-কলহকে সবচেয়ে নিম্নস্তরের আমল বিনষ্টকারী বলে গণ্য করেছে। ধর্মপ্রাণ মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো, কলহ-বিবাদ যতই হোক, বিপদে-আপদে, শত্রু-মিত্র বাছ-বিচার না করে মানবিক কারণে বিপদগ্রস্তের উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়া। কলহ-বিবাদকারীরা সমাজের লোকের কাছে অপছন্দনীয়। বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের যেমন সাধারণ মানুষ ঘৃণা করে, তেমনি আল্লাহ তাআলাও অপছন্দ করেন। তাই বলা হয়েছে, ‘তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে না, নিশ্চয়ই আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৭৭)
পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা তখনই সব সংকট নিরসন ও সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়, যখন উভয় পক্ষের মধ্যে ফলপ্রসূ সংলাপ বা সলাপরামর্শ সত্য অনুসন্ধান, বাস্তবতা অন্বেষণ ও গঠনমূলকভাবে তা প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে সম্পন্ন হয়। লোকেরা যদি আলোচনার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরে যায় এবং উভয় পক্ষ একগুঁয়েমি ও অন্য পক্ষের ওপর ক্ষমতার দাপট প্রতিষ্ঠা করার ওপর অটল থাকে অথবা প্রতিপক্ষকে নিজের বক্তব্য গ্রহণে বাধ্য করার জন্য বিতর্কে লিপ্ত হয়, তখন শত্রুতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এ অবস্থায় সমাজজীবনে দুই দলের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ হলে সংকট নিরসনে ইসলামের বিধান অনুসারে মীমাংসা করে দিতে হবে। যদি একদল মীমাংসা করতে রাজি না হয়, তাহলে সমাজের নেতৃস্থানীয় জনগণ ওই দলের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে এবং মীমাংসা মেনে নিতে বাধ্য করবে এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে উভয় দলের মধ্যে সন্ধি ও শান্তিপূর্ণ সমঝোতা করে দিতে হবে। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘মুমিনদের দুই দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবে। অতঃপর তাদের একদল অন্যদলকে আক্রমণ করলে তোমরা আক্রমণকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। যদি তারা ফিরে আসে, তবে তাদের মধ্যে ন্যায়ের সঙ্গে ফয়সালা করে দেবে এবং সুবিচার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিচারকারীদের ভালোবাসেন।’ (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ৯)
পারস্পরিক সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও সামাজিক সম্প্রীতি অটুট রেখে জাতি-ধর্ম-বর্ণ–দল–মতনির্বিশেষে সব মানুষের শান্তিপূর্ণ সমঝোতার মাধ্যমে স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতার অবসান ঘটানো যায়। দেশে বিরাজমান সংঘাতময় পরিস্থিতিতে বিবদমান দুই পক্ষের অবশ্যকর্তব্য হলো নিজেদের ঝগড়া-বিবাদ ও সংকট নিরসন করা, কলহ মিটিয়ে ফেলা এবং সন্ধি-সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টি করা। এ ক্ষেত্রে সমাজের নীতিমান শান্তিপ্রিয় লোকদেরও দায়িত্ব রয়েছে। তাই সমাজের দুই দল, ব্যক্তি বা জাতি-গোষ্ঠী-সম্প্রদায়কে হানাহানি বা দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত দেখে অন্যরা দূরে সরে থাকতে পারে না। বরং দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে জননিরাপত্তার তাগিদে নিরাপদ ও শান্তিময় জীবনের জন্য দেশকে অবরোধমুক্ত করতে কলহ-বিবাদ যত দ্রুত সম্ভব মিটিয়ে দেওয়া উচিত।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]