স্মৃতি কেন এতটা ক্ষণস্থায়ী?

যুদ্ধ বা গৃহযুদ্ধ কোনোটায় শান্তি আনে না, আনে ধ্বংস ও মৃত্যু
যুদ্ধ বা গৃহযুদ্ধ কোনোটায় শান্তি আনে না, আনে ধ্বংস ও মৃত্যু

বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির লড়াই নতুন কিছু নয়। মানুষের স্মৃতিকে যারা ভুলিয়ে দিতে তৎপর, সেই দলে আছে ক্ষমতার দম্ভে দিন-রাতের হিসাব ভুলে যাওয়া মানুষ, যারা আমাদের দিয়ে এমনকি রাতকেও দিন বলিয়ে নিতে বাধ্য করানোর খেলায় তৎপর। আর অন্যদিকে স্মৃতিকে ধরে রেখে দুরন্ত হাওয়ার মধ্যে জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে নিয়ে যাঁরা পথ পার হচ্ছেন, বিত্ত আর বৈভবের হিসাবে নিতান্ত অসহায় হলেও ধরে রাখছেন সভ্যতার মশাল, তাঁরা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন, স্মৃতিকে পদদলিত করে তাৎক্ষণিক প্রাপ্তি মিললেও প্রজ্বলিত মশালের সেই আলো সঠিক পথের দেখা ঠিকই দেখিয়ে দিতে সক্ষম।
বিশ্বের একক পরাশক্তি এখন আবারও তৈরি হচ্ছে রণসাজে, আর হুংকার দিয়ে যাচ্ছে ছোট আর অসহায় এক রাষ্ট্রের প্রতি। অপরাধ, সেই পরাশক্তির মদদ আর সার্বিক সমর্থন নিয়ে হূষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠা তথাকথিত বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে দেশটির যুদ্ধ করা। যুদ্ধ চলছে দুই বছরের বেশি সময় ধরে এবং পরাশক্তি একসময় ধরেই নিয়েছিল যে তাদের পরোক্ষ সহযোগিতার মুখে দুর্বল সেই দেশটির শাসকগোষ্ঠী টিকে থাকতে পারবে না।
সম্প্রতি তথাকথিত সেই বিদ্রোহীরা পরাজিত হয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়ার মুখে হঠাৎ করেই এখন পরাক্রমশালী নেতৃত্বের বোধোদয় হয়েছে যে যুদ্ধই হচ্ছে একমাত্র উদ্ধার। আর তাই সাজ সাজ রবে শুরু হয়েছে যুদ্ধের প্রস্তুতি। তবে যুদ্ধে যেতে হলে একটি যুক্তি তো তৈরি করে নেওয়া দরকার, যে খোঁড়া যুক্তির পক্ষে তাদের অনুকূল সব সংবাদমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে জনমত তৈরি করে নেওয়াটাও কঠিন নয়। ফলে সেই কলঙ্কিত পথ ধরে দেশটির আবারও যাত্রা, যে পথে হাঁটার বদৌলতে ইরাকে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে লক্ষাধিক নারী-পুরুষ আর শিশু।
ইরাকের সেই রহস্যজনক গণবিধ্বংসী অস্ত্রের মতোই বিশ্বকে এখন শুনতে হচ্ছে সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ। আর এই প্রচার লড়াইয়ে আগের মতোই এবারও প্রথম কাতারে যোগ দিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস-এর পাশাপাশি রুপার্ট মারডকের মালিকানাধীন সব সংবাদমাধ্যম। এর ওপর বাড়তি যোগ হয়েছে ইউটিউব। সবাই এরা এখন গাইছে সেই পুরোনো গীত, যে গীত আমরা শুনেছিলাম ইরাক যুদ্ধ শুরু করার আগে চালানো পাঁয়তারার পর্বে।
সিরিয়ায় যে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি বাশার আল-আসাদের সরকারও সেই বাস্তবতা অস্বীকার করছে না।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে, কে ব্যবহার করেছে সেই অস্ত্র এবং সেই প্রশ্নের সঠিক উত্তর খুঁজে না দেখে কেনই বা যুদ্ধে যাওয়ার এই পাঁয়তারা? সিরিয়ায় বিদ্রোহীরা এখন পিছু হটার মুখে। যুদ্ধের এই গতি পরিবর্তিত হতে শুরু করে লেবাননের হিজবুল্লাহ গেরিলারা আসাদ বাহিনীর সমর্থনে ময়দানে নামার পর। হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ রাখঢাক ছাড়াই ঘোষণা করেছেন দুঃসময়ে সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথা। ফলে বিদ্রোহীদের পক্ষে দেশ-বিদেশের আল-কায়েদা অনুসারীদের সিরিয়ার যুদ্ধে অংশ নেওয়ার মতোই তাদের বিপরীতে হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের এতে অংশ নেওয়াও অজানা তথ্য নয়। ফলে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ অনেক দিন থেকেই শুধু সিরীয় ভূখণ্ডের যুদ্ধে সীমিত নেই, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৃহৎ এবং ক্ষুদ্র অনেক শক্তি ও আশপাশের বেশ কিছু দেশ, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ইসরায়েল।
সিরিয়ার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের ক্ষোভও নতুন নয়। পুরো মধ্যপ্রাচ্যে যে দেশটিকে ইসরায়েল শত্রু হিসেবে গণ্য করে, সেটি হচ্ছে সিরিয়া। সিরিয়ার গোলান মালভূমি ইসরায়েল তার দখলদারত্ব থেকে এখনো ফিরিয়ে দেয়নি এবং সিরিয়াকে ঘায়েল করার নানা রকম চেষ্টা করে যাওয়া সত্ত্বেও এর কোনোটাতেই তারা সফল হতে পারেনি। উপরন্তু সিরিয়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন লাভ করা হিজবুল্লাহ বাহিনী হচ্ছে একমাত্র বাহিনী, যার হাতে পরাজয় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীকে মেনে নিতে হয়েছে। ফলে সিরিয়ার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের গায়ের জ্বালা যে কতটা, তা সহজেই অনুমান করা যায়। সিরিয়ায় হঠাৎ করে গণতন্ত্রের নামে সৌদি আরব আর উপসাগর অঞ্চলের আমির-ওমরাহ শাসিত বিভিন্ন রাষ্ট্রের সমর্থনে পুষ্ট হয়ে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধ যে দেশটির জন্য প্রতিশোধ গ্রহণের সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে, সেই দেশটি হচ্ছে ইসরায়েল। আর তাই সিরীয় সংকটের সূচনা থেকেই ঘোলা জলে মাছ শিকারে ইসরায়েল যে নিয়োজিত থাকবে, তা তো সহজেই ধারণা করা যায়। ফলে সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টিকেও এর বাইরে থেকে দেখার সুযোগ নেই।
সিরিয়ায় আসাদের বাহিনী ভালোভাবেই অবগত যে সামান্যতম স্খলনও দেশটিকে মাথার ওপরে চক্কর দিতে থাকা শকুনের খপ্পরে ফেলে দেবে। ফলে সেই সরকারি বাহিনী জেনেশুনে বিপদ ডেকে আনবে, তা বিশ্বাস করা খুবই কঠিন। আর তাই যে হিসাব-নিকাশের দিকে আমাদের চোখ মেলে তাকানো দরকার তা হলো, সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারে লাভবান কে হচ্ছে। সেই হিসাবই হয়তো বলে দিতে সক্ষম কার হাত এর পেছনে আছে। শুভবুদ্ধির মানুষেরা বিদ্রোহীদের দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করছেন রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে মাস্তানকে ডেকে নিয়ে এসে নিজের শত্রুকে ঘায়েল করার মনোবাসনা পোষণ করার জন্য।
তবে সিরিয়াকে পরাশক্তির আঘাত হেনে ঘায়েল করা গেলে পরোক্ষে সবচেয়ে বেশি যে লাভবান হবে, সে হচ্ছে অবশ্যই ইসরায়েল। সিরিয়া শত্রুমুক্ত হওয়ার অর্থ ইসরায়েলের জন্য দাঁড়াবে হিজবুল্লাহর কোমর ভেঙে দেওয়া। অন্যদিকে ইরানও বড় সমর্থন হারিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে হয়ে পড়বে কোণঠাসা। ফলে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ঘোলা পানিতে বিশ্বের সবচেয়ে চতুর গোয়েন্দা বাহিনী মোসাদও যে মাছ শিকার করতে নামেনি, তার নিশ্চয়তা কী? তাই এই সন্দেহ অযৌক্তিক নয় যে বিদ্রোহীদের দিয়ে মোসাদই হয়তো সেই কাজটি করিয়ে নিয়েছে এক ঢিলে কয়েকটি পাখি মারতে পারার মনোবাসনা থেকে।
তবে তার পরও বিশ্বের নেতৃস্থানীয় বলে দাবিদার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম আর পশ্চিমা বিশ্বের তাঁবেদারিতে মত্ত একশ্রেণীর তথাকথিত বিদ্বান একই সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে হাজির হয়েছে সিরিয়াকে বধ করার উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে। এতে অবশ্য চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই, কেননা আমরা জানি মাত্র ১০ বছর আগেও একই খেলায় এরা নিয়োজিত হয়েছিল।
আমাদের তখন বলা হয়েছিল ইরাককে বধ করা না গেলে ভয়াবহ বিপদের মুখোমুখি বিশ্বকে পড়তে হবে, কেননা ভয়ংকর যে অস্ত্রভান্ডার সাদ্দাম হোসেন গড়ে তুলেছেন, তা সবার জন্যই আশঙ্কাজনক। তখনো সেই ইরাক বধের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল একদল বিদ্বান, আমাদের যাঁরা বলেছিলেন ইরাকে মার্কিন বাহিনী উপস্থিত হলে ইরাকিরা ফুলের মালা দিয়ে তাদের স্বাগত জানাবে।
পাঠক, কেনান মাকিয়াদের মনে পড়ে কি, যারা ছিল সেই ফুলের মালার তত্ত্বের জনক? তবে আমরা তো জানি কীভাবে মার্কিন বাহিনীকে সেই দেশটিকে স্বাগত জানানো হয়েছিল এবং কীভাবে সাদ্দামকে বাগে আনার নামে ইরাকে বধ করা হয়েছে লক্ষাধিক নিরীহ মানুষকে হত্যা করে, যার জের এখনো চলছে। এর কোনোটাই কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘন কিংবা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়নি এবং বিশ্বের স্বঘোষিত বিদ্বানদের কেউই বলেননি, মানবাধিকারের নামে জঘন্য যে খেলায় যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে নিয়োজিত, সেটাই হচ্ছে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। অনেকেই তা জোর গলায় বলছেন না। আর বলছেন না বলেই পরাশক্তি এখন ধরেই নিয়েছে যে নিজের স্বার্থ রক্ষায় লক্ষ মানুষের প্রাণ বধের আধিকার তার আছে, এমনকি সেটা মুষ্টিমেয় কিছু প্রাণ রক্ষা করার নামে হলেও।
আমাদের এই বিস্মৃতি কোন সে অন্ধকার পথে বিশ্বকে নিয়ে যাচ্ছে, তা হয়তো অনেকেই আমরা আঁচ করতে পারছি না। তবে সেই গন্তব্য যে মৈত্রীর বন্ধনকে দৃঢ় করে মানবতার পতাকা সমুন্নত রাখার কোনো গন্তব্য নয়, সিরিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাবলি তা দেখিয়ে দিচ্ছে না কি?
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।