অর্থনীতি নয়, সমস্যা রাজনীতি

.
.

চরম রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্য দিয়ে ঘোষিত হলো বছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি। এ পরিস্থিতিতে যা হওয়ার কথা, তা-ই হলো। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে কোনো উচ্চাভিলাষ নেই এ মুদ্রানীতিতে। দেশের এমন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা অধিক বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। এতে আমরা যে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির কথা বলছি, তা অর্জন করা আদৌ সম্ভব হবে না। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাষ্যমতে, ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে বিনিয়োগ-জিডিপির অনুপাত ৩৫ শতাংশ হওয়া বাঞ্ছনীয়। বর্তমানে যার পরিমাণ ২৯ শতাংশ।
এদিকে চলমান অবরোধে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের অবস্থা তথৈবচ। বাজারে ভয়াবহ মন্দা, অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী দিনে হিসাবের খাতাও খুলতে পারছেন না বলে জানা গেছে। আর সামনে আসছে সরকারের নবম পে–স্কেল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, বিগত তিনটি পে–স্কেল ঘোষণার পর দেশে মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে। এবার পে–স্কেল ঘোষণার পর আরেক দফা মূল্যস্ফীতি হবে বলেই ধারণা করছেন অনেকে। ফলে সব মিলিয়ে আমাদের জন্য সুসময় অপেক্ষা করছে বলে মনে হয় না।
তার পরও দেশের প্রবৃদ্ধির হার ৬-এর কোটায় রয়েছে। এমনকি ২০১৩ সালে ও রকম টালমাটাল পরিস্থিতিতেও প্রবৃদ্ধির হার ৬-এর ঘরে ছিল। এটা আমাদের অর্থনীতির রেজিলিয়েন্স বা ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও যদি হয়, তাহলে এই সক্ষমতা কত ঘাত সহ্য করতে পারবে, সেটাও ভেবে দেখার বিষয়। ব্যবসায়ীরা এ নিয়ে ইতিমধ্যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। দেশের বড় বড় ব্যবসায়ীর ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়। কিছুদিন আগেও এক দফা তা করা হয়েছে। কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের অবস্থা তো ত্রাহি মধুসূদন, আগেও যা বলেছি। ফলে বৈষম্য ব্যাপক পরিমাণেই আছে। কৃষকদের অবস্থা তো বলার মতো নয়। টানা অবরোধ-হরতালে তাঁরা এবার সবজির দাম পাননি। তাঁরা সাধারণত সবজি বিক্রির টাকাই বোরো ধানে বিনিয়োগ করেন। ফলে স্বাভাবিকভাবে স্থানীয় পর্যায়ে ঋণ নিয়ে তাঁদের এবার বোরো চাষে নামতে হচ্ছে। গত কয়েক বছরের মতো যদি এবারও তাঁরা ধানের যথাযথ দাম না পান, তাহলে তা হবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা–এর মতো। কিন্তু এই কৃষকদের বারবার ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কোনো দীর্ঘমেয়াদি প্রণোদনা দেওয়ার পরিকল্পনা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি পরিকল্পনায় নেই। তবে জানুয়ারিতে কৃষিঋণের সুদের হার ২ শতাংশ কমিয়ে ১১ শতাংশ করা হয়েছে। এটা ইতিবাচক, তবে কৃষিঋণের সুদের হার ৫ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়।
অনেকেই বলছেন, ২০০৯-১১ সালের মুদ্রানীতির কারণে শেয়ার ও জমির দাম ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। বিনিময় হারে ব্যাপক চাপ পড়ে। আর ২০১২ সাল থেকে মুদ্রানীতিতে সংশোধন আনার ফলে স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। কিন্তু ব্যাপারটি কি এতটা সহজ-সরল? দেশের ব্যাংকব্যবস্থায় হল-মার্ক/বিসমিল্লাহর মতো বড় বড় দুর্নীতি হওয়ায় ব্যাংকগুলো তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে স্বাভাবিকভাবেই সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। এমনকি সরকারকে বেইল আউটও করতে হয়েছে। জনগণের করের টাকায় এ বেইল আউট হয়েছে। ব্যাংকগুলো মুনাফা কমাতে নারাজ। স্প্রেডের নির্ধারিত হারও কেউ মানেনি সে সময়। শিল্পঋণের সুদের হার ২০ শতাংশের কাছাকাছি চলে যায়। পরিণামে ব্যবসায়ীরা স্বল্প সুদে বিদেশি ঋণের প্রতি ঝুঁকেছেন। লিবরসহ এই ঋণের সুদের হার পাঁচ শতাংশের মতো। ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকলে তা ঋণগ্রহীতাদের জন্য আরও সুবিধাজনক হয়। কথা হচ্ছে, সরকার এখন পর্যন্ত এই ঋণ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার করতে পারেনি। সোনালী ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হলেও কোনো পরিচালককে গ্রেপ্তার করা হয়নি। ফলে সমস্যাটা যত না অর্থনৈতিক, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক।
শেয়ারের দাম বাড়ার জন্য যত না দায়ী মুদ্রানীতি, তার চেয়ে বেশি দায়ী বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেটগুলো, এটা তো এখন উন্মুক্ত রহস্য। জমির দাম বাড়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সরকারের যদি বাজার নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা না থাকে, তাহলে মূল্যস্ফীতি বাড়তেই থাকবে। এটার সঙ্গে যেমন মুদ্রানীতির সম্পর্ক আছে, সেটা ঠিক। বাজারে চাহিদা সৃষ্টির পেছনে মুদ্রানীতির বড় ভূমিকা থাকে। যেমন একসময় ফ্ল্যাট কেনায় ব্যাংকগুলো প্রচুর পরিমাণে ঋণ দিত। এতে ফ্ল্যাটের চাহিদা বেড়ে যায়, ফলে তার দামও বাড়ে। দুনিয়ার অনেক দেশেই মুদ্রানীতির কারণে সম্পদমূল্যের বুদ্বুদ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেটগুলোই মূলত এর জন্য দায়ী। সেই মানুষেরা আবার রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত, নানাভাবেই। তাদের রোখার কেউ নেই। ফলে এই মূল্যবৃদ্ধি যতটা না অর্থনৈতিক শর্তের কারণে ঘটেছে, তার চেয়ে বেশি ঘটেছে রাজনৈতিক কারণে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ ই স্টিগলিৎজের কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য: ধনীদের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হলেও শ্রমিকের মজুরি বাড়ছে না। এটা বাজার অর্থনীতির সাধারণ সূত্রও নয়। বাজার কীভাবে কাজ করে বা কীভাবে কাজ করা উচিত, সেটা কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা রয়েছে আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থায়, এই ব্যবস্থা প্রতিযোগিতামূলক বাজার নিশ্চিত করতে পারেনি। উল্টো এমন নিয়ম করে রাখা হয়েছে, যা এই বিকৃত বাজারব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখছে, যে বাজারে করপোরেশন ও ধনী মানুষেরা সবাইকে শোষণ করছে। টমাস পিকেটি তাঁর সাড়াজাগানো গ্রন্থ ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরিতে এই বৈষম্যের ব্যাপারটি আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু প্রবৃদ্ধিতে নজর না দিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিতে নজর দেওয়ার কথা বলছে, এটা ভালো কথা। একই সঙ্গে দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে অর্থায়নের কথা বলছে।
অন্যদিকে দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট—এফডিআই) আকৃষ্ট করার মতো আইন থাকলেও গ্যাস-বিদ্যুৎসহ অন্যান্য অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে না পারায় দেশে এফডিআইয়ের পরিমাণ উত্তরোত্তর কমছে। দেশি বিনিয়োগ না বাড়ার পেছনে এগুলো অনুঘটকের কাজ করে। সঙ্গে আছে লাগামহীন চাঁদাবাজি। এ বস্তুটি ছাড়া এ দেশে কিছু হয় না!
আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের (আইএলও) তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। বেকারত্বের এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০১৫ সালে মোট বেকারের সংখ্যা ছয় কোটিতে দাঁড়াবে। শিক্ষাব্যবস্থা যুগোপযোগী না হওয়াও এর অন্যতম কারণ। তবে সামগ্রিকভাবে বেকারত্ব হ্রাসের জন্য সামষ্টিক অর্থনীতির সম্প্রসারণের বিকল্প নেই। তার জন্য দরকার বিনিয়োগ। আর সেই বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে পারে যথাযথ মুদ্রানীতি। সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি দিয়ে হয়তো মূল্যস্ফীতিতে লাগাম দেওয়া যাবে। ব্যাংক সুদের হার কমানো যাবে। কিন্তু পণ্যের কোনো চাহিদা না থাকলে সুদের নিম্ন হারের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগে উৎসাহী হবে না। মানুষ ব্যক্তিপর্যায়ে ধার করেও ক্রয়ে উৎসাহী হবে না, যদি তারা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হয় (যেটা তাদের হওয়া উচিত)। রাজনৈতিক পরিস্থিতির উত্তরণ না ঘটলে এই উদ্বেগ কাটবে না, সেটা স্বাভাবিক। ফলে এই সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির কারণ শুধু অর্থনৈতিক নয়, এর কারণ রাজনৈতিক। স্টিগলিৎজ যথার্থই বলেছেন, আমাদের মূল সমস্যা ‘নির্বোধ রাজনীতি’। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাষ্যমতে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর কারণে প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ বজায় রয়েছে।
প্রতীক বর্ধন: সাংবাদিক ও অনুবাদক।
[email protected]