'ইতরপনা কার্য আমার'

পেট্রলবোমায় নিহত স্বজনদের এই কান্না আর কত দিন?
পেট্রলবোমায় নিহত স্বজনদের এই কান্না আর কত দিন?

আরও অনেকের মতোই আমারও ইচ্ছা করে সারাক্ষণ প্রচণ্ড চিৎকারে ভেঙে খান খান করি এই সময়ের চারপাশ। প্রবল ঘূর্ণিঝড় হয়ে অচলায়তন ভাঙি। তীব্র কশাঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে দিই সমাজ ও রাষ্ট্রের নাদুসনুদুস রাক্ষসমতো চেহারাটাকে। সব গিলে খেয়েছে সে, খাচ্ছে অবিরাম। আমাদের শুভবোধ, মানসিকতা, যুক্তিবাদ, সৃজনশীল উদ্যম, ভালোবাসা—সবকিছু উদগ্র উল্লাসে গিলে গিলে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে এই দুঃসময়। কালো রাত কাটছে না। কালো কালো রাতে যাঁরা দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে যাচ্ছেন, তাঁদের জন্য ওত পেতে থাকছে পেট্রলবোমার আগুনে মৃত্যু ও শঙ্কা, নিম্ন আয়ের মানুষের আয়-উপার্জন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে প্রায়, শিক্ষার্থীরা জিম্মি হয়ে অবসাদগ্রস্ততায় ডুবিয়েছে তাদের রংধনু মস্তিষ্কের কোষ; গৃহবাসীর অপেক্ষা প্রতিদিনের শুধু নয়, প্রতিক্ষণের। তার ভাবনা, যে আছে বাইরে, সে ফিরবে তো ঠিকঠাক? নিরাপদে?
এর নাম জীবনযাপন? এর নাম সমাজ? স্বদেশ?
মোটেও নয়। এটা তৈরি করা হয়েছে। আমাদের মতোই দেখতে কিন্তু ভাবনায় ভিন্ন কিছু মানুষ এই সর্বনাশা সময় তৈরি করেছে। জানুয়ারির শেষ দিকে একদিন কথা বলেছিলাম বিশিষ্ট গবেষক, প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে, চারপাশের বহমান সময় নিয়ে। তিনি বলছিলেন, ‘যে বাংলাদেশ আমরা এখন দেখছি, এটা প্রকৃত বাংলাদেশ নয়। রাজনীতি করে যারা নিজেদের সম্পদশালী ও ধনী করতে চায়, এ রকম কয়েক হাজার মানুষ তাদের অপকর্ম দিয়ে দেশকে এত নিচে টেনে নামিয়েছে।’
হরেক রকম অপকর্ম, যা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য; সবাই চলছে প্রতিরোধহীন। যুদ্ধাপরাধী জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি তার ২০-দলীয় জোটের সর্বস্তরের মানুষের ‘না-চাওয়া’ হরতাল-অবরোধ-সহিংসতা চালাচ্ছে। আর ক্ষমতাসীন ১৪-দলীয় জোট, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব থেকে উদ্ভূত দমন-পীড়নের নানামুখী পদক্ষেপ অচলাবস্থাকে করছে দীর্ঘায়িত। জানমালের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব সরকারের। তা এখন শূন্যের কোঠায় পৌঁছে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে হাসছে। তবু আমরা কেউ জ্বলছি না। টলছি না। দেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে যাঁরা প্রায়ই গম্ভীর মুখ করে টেলিভিশনের ‘টক শো’তে গিয়ে মিষ্টি মিষ্টি আশাবাদের কথা বলেন, তাঁদের বিশ্লেষণে চারপাশের এই নির্লিপ্ততার কোনো কার্যকারণ জানা যাচ্ছে না। দেশটা কি তবে মেধাহীন পোশাকি কপট মানুষে ভরে গেল? কবে হলো এই সর্বনাশ? কীভাবে হলো? কেন হলো?
ভাবনাহীনতা ও প্রশ্নহীনতার এই কালে কয়েকটি প্রশ্ন খুবই সহজ ও সরল। সবারই জানা। যেন ঠোঁটের ডগায় ঝুলে আছে। কিন্তু উত্তর? জানা নেই। তা-ই কি? নাকি জানা আছে, বলা বারণ? বারণ কেন? বললে কী হবে? সরল উত্তর, অসুবিধা হবে। কী অসুবিধা? ব্যক্তিগত অসুবিধা। ধর্ম নয়, ধর্মতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলে যুক্তিহীন মৌলবাদের রোষে লেখক তসলিমা নাসরিন অনিচ্ছুক পরবাসী হয়েছেন। তখন যদি আমরা প্রশ্ন তুলতাম, তাহলে পরবর্তী সময়ে কবি শামসুর রাহমানের বাসা আক্রান্ত হতো না। ধারাবাহিকভাবে মৌলবাদের চাপাতি একে একে ঝাঁপিয়ে পড়ত না হুমায়ুন আজাদ, রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়সহ আরও অনেকের ওপর। আমাদের ফিসফিস কথাগুলো মৌনতার নামান্তর। মৌনতা বিজ্ঞানমনস্ক করে না মানুষকে।
দেশের বিবদমান হিংসুটে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটানোর জন্য কেউ কেউ উদ্যোগ নিলেও আমাদের তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাজনীতিকেরা ‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি’ প্রবাদটি অক্ষরে অক্ষরে মানছেন। দেখেশুনে যে কেউই বুঝবেন যে তাঁদের কাছে দেশ বা দেশের উন্নয়ন এমনকি মানুষের জীবনও কোনো দাবি তৈরি করছে না। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে চিরবিনাশ করতে চাইছে, নির্মূল করতে চাইছে। যারা ক্ষমতায় আছে, তারা একাধিপত্য বিস্তার করছে। প্রতিপক্ষের অনুপস্থিতির বাসনায় স্বৈরতান্ত্রিক মন গড়ে তুলছে নিজেদের ভাবনার জগতে। এটা একটা অশনিসংকেত। সবার জন্যই। এটা বুর্জোয়া রাজনীতির দৌরাত্ম্য ও দেউলিয়াত্বও বটে। আর এই দেউলিয়াপনার উৎকট চেহারা দেখে দেশের সার্বভৌমত্বের গালে চপেটাঘাত করে নাক গলাচ্ছেন জাতিসংঘ ও ভিনদেশি কূটনীতিকেরা। প্রতিষ্ঠান ও দেশ হিসেবে যাদের নিজস্ব চেহারা বিশ্বময় খুবই লজ্জার, সেসব স্বার্থান্বেষী মহলকে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মতামত দেওয়ার অবস্থাটা আমাদের লোভী রাজনীতিকেরাই তৈরি করে দিয়েছেন। তাঁদের ‘লজ্জা’তে ফরমালিন দেওয়া কি?
আমরা যে স্বৈরতন্ত্র ও সন্ত্রাসী সময়ে বেঁচে থাকছি, এমন মন্তব্যে কেউ কেউ রুষ্ট হতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে কি তা-ই নয়? দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে বিএনপি-জামায়াত জোটের পাশবিক পেট্রলবোমা-মার্কা ক্ষমতায় যেতে চাওয়ার আন্দোলনে যারা অগ্নিদগ্ধ হয়ে পুড়তে পুড়তে মারা যাচ্ছে প্রায় প্রতিদিনই, তাদের কাছে কি রাজনীতি কোনো গণতান্ত্রিক বার্তা পৌঁছাচ্ছে? এই আন্দোলনের কোনো কর্মসূচিতে কি দেশের অধিকারহীন ব্যাপকসংখ্যক মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা উচ্চারিত হয়েছে? মীমাংসিত অপরাধী মানবতাবিরোধী অপশক্তি প্রতিক্রিয়াশীল জামায়াত-শিবিরকে এখনো বিএনপি ছাড়তে পারল না। পারে না, কারণ নিজেদের নীতিহীন, আদর্শহীন লুটেরা রাজনীতির বর্ম হিসেবে এদের ধর্মকে ব্যবহার করতে হয়। দুর্ভাগা ও গরিব সাধারণ মানুষকে মানবেতর জীবনের জন্য অদৃষ্টনির্ভর বানাতে হয়। অবৈজ্ঞানিক, কুসংস্কারগ্রস্ত, ব্যক্তিগত জীবনযাপনে তুমুল বিলাসী ও লোভী এসব নানা পরিচয়ের ধর্মীয় গোষ্ঠীকে আশ্রয় করে জোট বেঁধেছে বিএনপি। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও সমানভাবে পাল্লা দিচ্ছে। কখনো হেফাজতকে প্রশ্রয়, কখনো নিজেদের ওলামা সংগঠনের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নিজেদের ধার্মিক পরিচয়টি উজ্জ্বল করতে চেয়েছে। যে ইসলাম ধর্মের অনুসারী হিসেবে তারা নিজেদের দাবি করে, সেই ধর্মে নিষেধ থাকলেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছিল সিলেটের হজরত শাহজালালের মাজার থেকে। নির্বাচনী স্লোগানে আল্লাহকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করেছে। আওয়ামী লীগ বলেছে, ‘নৌকার মালিক তুমি আল্লাহ’। ‘ধানের শীষে বিসমিল্লাহ’ বলেছে বিএনপি। আর জামায়াতের সব খুনি গোষ্ঠী বলেছে, ‘ভোট দিলে পাল্লায়, খুশি হবে আল্লায়’। ধর্মকে এরা নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়ার কাজে ব্যবহার করতে চেয়েছে। এই জায়গায় এরা সবাই মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিরুদ্ধে এককাট্টা। শুধু দলের নাম আলাদা। উদ্দেশ্য এক।
যত দিন যাচ্ছে, রাষ্ট্রের অকার্যকর ও স্বৈরতান্ত্রিক চেহারা উৎকট হয়ে উঠছে। অভিজিৎ রায়কে খুন করার প্রতিবাদে ৩ মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্র জোটের মিছিলে ছাত্রফ্রন্ট ও ছাত্র ফেডারেশনের নেতা-কর্মীদের হুমকি দিয়ে মতিহার জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার বলেছেন, ‘ক্যাম্পাসে শুধুই ছাত্রলীগ মিছিল করতে পারবে, আর কেউ না (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম, ৪ মার্চ)। বোঝা যাচ্ছে, পুলিশও যেন আওয়ামী লীগ করছে এখন।
কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস সম্ভবত বৈশ্বিক রূপ নিয়েছে। পদ্মা সেতুর নির্মাতা চীনা প্রকৌশলী প্রতিষ্ঠান সেতুর পাইলিংয়ের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করার দিনে কালো রঙের গরু-ছাগল বলি দিয়ে এদের রক্ত পদ্মা নদীতে ঢালল এই প্রত্যাশায়, নির্মাণকাজ যেন নির্বিঘ্নে শেষ হয়। হায় কমরেড মাও সে তুং! আপনি বেঁচে থাকলে কি এদের কুৎসিত গালে কষে থাপড় মারতেন? কিছুদিন আগে পবিত্র হজ পালন করে আসা বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির শীর্ষ নেতা বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন ছাত্রমৈত্রীর সম্মেলনে ভাষণ দিয়ে বলেছেন, ‘ছাত্রসমাজের সংগ্রামী রূপ ম্লান হয়ে গেছে।...ছাত্রসমাজ আগের মতো জাগ্রত থাকলে অভিজিৎ হত্যার মতো ঘটনা ঘটত না। ভেবেছিলাম অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর অন্তত ছাত্রসমাজ ফুঁসে উঠবে। কিন্তু সেখানেও ঘাটতি রয়ে গেল’ (প্রথম আলো, ৪ মার্চ)।
কেন এমন হলো মেনন ভাই? আপনিও জানেন না?
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
[email protected]