সবাই আমাদের ভালো চায়, আমরা নই

অঙ্কন: মাসুক হেলাল
অঙ্কন: মাসুক হেলাল

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীকে ধন্যবাদ জানাতেই হয় যে তিনি তাঁর পূর্বসূরির পথ অনুসরণ না করে বরং সত্য বলার চেষ্টা করেছেন। জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের ২৮তম অধিবেশনে মন্ত্রীপর্যায়ের এক সভায় তিনি বলেছেন, ‘পর্যাপ্ত উন্নয়ন ছাড়া সব সময় সবার মানবাধিকার রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারে না।’ নাগরিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বাড়তে থাকা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে দেশের ভেতরে-বাইরে সমালোচনা তীব্রতর হওয়ার পটভূমিতে তিনি অন্তত ঢালাও অস্বীকৃতি জানানোর পথে পা বাড়াননি। তাঁর পূর্বসূরি তো এর আগে ওই একই ফোরামে এ ধরনের সব অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছিলেন। যার ফলে তখন তিনি দেশে ফিরে দেখলেন যে দেশীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো একজোট হয়ে বিবৃতি দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে তথ্য বিকৃতির অভিযোগ এনেছিল।
জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে মাহমুদ আলীর বক্তব্যে অবশ্য আমাদের শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ, তাঁর বক্তব্যে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে যে তাঁর সরকারের দর্শনের ভিত্তি হচ্ছে উন্নয়ন আগে, মানবাধিকার পরে। তাহলে কেউ যদি ধরে নেন যে মানবাধিকার পরিস্থিতির যত অবনতিই ঘটে থাকুক না কেন, অদূর ভবিষ্যতে সেটার উন্নতির কোনো আশা নেই, তাহলে কি তিনি ভুল করবেন? কথিত উন্নয়নের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ যদি তিরোহিত হয়, যদি ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী ও পরিবারগুলোর একচ্ছত্র শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে তাকে স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছাড়া আর কী বলা যাবে? অথচ সারা দুনিয়ায় এখন উন্নয়ন দর্শনের ভিত্তি হচ্ছে—যাদের জন্য উন্নয়ন, তাদের অধিকার নিশ্চিত না করে কোনো উন্নয়ন নয়।
এরপর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে এক বৈঠকে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার জেইদ রাদ আল হুসেইন বাংলাদেশের চলমান সংঘাতময় পরিস্থিতির সমাধান খোঁজার আহ্বান জানিয়েছেন। পরে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে বৈশ্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে তিনি যেসব দেশের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। জেইদ রাদ আল হুসেইন বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি মহাসচিব বান কি মুনের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে সহিংসতা বন্ধ, রাজনৈতিক সংলাপের পথ খোঁজা এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য সব রাজনীতিকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি গণতন্ত্রের পরিধি ক্রমেই সংকুচিত হওয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন। হাইকমিশনার জেইদ ২০১৪ সালে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর অন্যায় নিয়ন্ত্রণ আরোপকারী যে কয়টি দেশের নাম উল্লেখ করেছেন, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হয়েছে মিসর, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলোর পাশাপাশি, যেসব দেশে গণতন্ত্র হয় নির্বাসিত, নতুবা স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চলছে। তিনি বাক্স্বাধীনতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছেন যে এটি শুধু উগ্রপন্থীদের দ্বারাই আক্রান্ত হচ্ছে না, বরং সরকারের দমনমূলক আচরণেরও শিকার হচ্ছে [ভাষণটির পূর্ণ বিবরণ অফিস অব দ্য হাইকমিশনার অন হিউম্যান রাইটসের (ওএইচসিএইচআর) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে]। বাংলাদেশে মানবসম্পদ উন্নয়নের নানা সূচকে অগ্রগতির কৃতিত্ব যে রাজনীতিকেরা দাবি করেন, তাঁরা গণতন্ত্রের মূল উপাদান—মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের প্রশ্নে বাংলাদেশের মর্যাদা অবনমনের দায় স্বীকার করবেন কবে?
আমাদের ঘরের ভেতরের রাজনৈতিক বিভাজন ও কলহ যে সর্বনাশা ও অন্তহীন সহিংসতার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে, তাতে
পাড়া–পড়শিদের উদ্বেগকেও আমাদের অনেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একধরনের বাড়াবাড়ি বলে মনে করেন। আমাদের একজন সাবেক সামরিক শাসক ও ক্ষমতাসীন সরকারের দ্বিতীয় প্রধান শরিক, জাতীয় পার্টির প্রধান দেশের বিদ্যমান গণতন্ত্রকে ‘সালিস মানি কিন্তু তালগাছ আমার’ ধরনের গণতন্ত্র বলে অভিহিত করেছেন। আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশ বিষয়ে যাঁদেরই আগ্রহ আছে, তাঁরা এত দিন যে ‘দুই নেত্রীর অবস্থান দুই মেরুতে’ বলে শুনে এসেছেন, তাঁদের সেই বৈপরীত্যের বাস্তব রূপ বোধ হয় এর চেয়ে প্রকট আর কখনো ছিল না। একজনের নিয়ন্ত্রণে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র-প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী, প্রচারমাধ্যম ও বিচার বিভাগ। এমনকি, প্রশাসন পরিচালনায় যাদের কোনো প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেই, এমন ধরনের প্রতিষ্ঠান-সংগঠন-সংস্থার সব কটিতেই দলীয় আনুগত্যের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ব্যক্তিদের সমাবেশ। অন্যদিকে, অপর নেত্রী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় একঘরে হয়ে থাকার পরও কথিত ‘আপসহীনতায়’ এখনো অনড়। অচলাবস্থা ভাঙার জন্য শুক্রবারের সংবাদ সম্মেলনে তিনি কিছু একটা বললেও বলতে পারেন বলে যাঁরা আশা করেছিলেন, তাঁদেরকে নিরাশ করে তিনি আবারও বলেছেন যে ‘যৌক্তিক পরিণতিতে না পৌঁছানো পর্যন্ত তাঁদের আন্দোলন চলবে’। সরকারি হিসাবে শতাধিক মানুষের প্রাণহানি, লাখো কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি, কোটি কোটি শিক্ষার্থীর জীবন নাকাল হলেও দুই নেত্রীর কারও মন গলার কোনো লক্ষণ নেই। এত সব মৃত্যু ও সম্পদহানি শুধুই পরিসংখ্যানের উপাদান। এ যেন অভূতপূর্ব আত্মহননের এক জাতীয় আয়োজন।
সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও নানাভাবে বলা হয়েছে যে সহিংসতা পরিহার এবং জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ত্যাগের ঘোষণা দিলেই বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হতে পারে। সহিংসতার দায় বিএনপি স্বীকার না করলেও তারা বলছে যে সংকট সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হলেই এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা বন্ধ হয়ে যাবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সংলাপের সম্ভাবনা আটকে আছে জামায়াতকে ছাড়া না-ছাড়ার বিষয়টিতে। এই বহুল বিতর্কিত প্রশ্নটির একটা চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান, যাঁকে আর যা-ই হোক, বিএনপি-জামায়াত ঘরানার বুদ্ধিজীবী বলে তকমা লাগানো যাবে না। তিনি বলছেন, রাষ্ট্র যেখানে জামায়াতে ইসলামীকে প্রত্যাখ্যান করছে না এবং করতেও ইচ্ছুক নয় (জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ‘কোনো দলকে সরকার নিষিদ্ধ করবে না’ এ ক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য), সেখানে বিরোধী দলের প্রতি সেই দলকে প্রত্যাখ্যান করার দাবিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক জেদাজেদি কতটা যুক্তিগ্রাহ্য? ধারণা করা যায়, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলে তাদের সমর্থকদের আশ্রয় হবে বিএনপি, যেটা আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের জন্য বরং অসুবিধাই তৈরি করবে। কিন্তু বিএনপি কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর জামায়াত সামান্য রাজনৈতিক সংস্কার মেনে নিলেই তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ার নতুন সুযোগ তৈরি হলেও যে হতে পারে, সেই সম্ভাবনাকে জিইয়ে রাখাই আওয়ামী লীগের জন্য লাভজনক।
জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন দুই নেত্রীকে যে চিঠি দিয়েছিলেন, তাতে অনেকেই ধারণা করেছিলেন, অন্তত সৌজন্যের খাতিরে উভয় পক্ষই ইতিবাচক সাড়া দেবে। আমাদের উন্নয়ন সহযোগী ও বাণিজ্যের বড় অংশীদার দেশগুলোও নিশ্চয় তেমনটি ভেবেছিল। সে কারণে তাদের বিবৃতিতেও মহাসচিবের উদ্যোগের প্রতি সমর্থনের কথা রয়েছে। কিন্তু সরকারের কৌশল সম্পর্কে যতটা আভাস মেলে, তা হলো সাধ্যমতো কালক্ষেপণ। যাঁরাই এই চলমান অচলাবস্থাকে রাজনৈতিক সংকট বলে মূল্যায়ন করেন এবং তার সমাধানে সরকারের ইতিবাচক উদ্যোগ দেখতে চান, তাঁদের কথা শোনার সময় ক্ষমতাসীনদের কারও নেই। তা তিনি বিদেশি কূটনীতিকই হোন অথবা দেশের উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ। ডিজিটাল যুগেও চিঠি যায় শম্বুকগতিতে। অনুমান করা যায় যে এর উদ্দেশ্য একটাই—মামলা, আদালত, পুলিশ ও শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে সহযোগী নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা বিএনপির নেত্রীকে হার মানতে বাধ্য করা।
গত ৬৭ দিনেও এসব কৌশল সফল না হওয়ায় ক্ষমতাসীনদের অনেকেই সম্ভবত হতবাক। মনে হয়, বিএনপি যেমন ভোঁতা হয়ে যাওয়া হরতাল-অবরোধের বাইরে কোনো কর্মসূচি ভাবতে অক্ষম, ঠিক তেমনি আওয়ামী লীগও বিএনপির নেত্রীকে হার মানানোর কোনো সৃজনশীল পথ পাচ্ছে না। আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কিংবা অফিস তল্লাশির পরোয়ানা জারিতেও খুব একটা ভয় দেখানো গেছে বলে মনে হয় না। ফলে আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের রাজনৈতিক কার্যক্রম এবং সংসদের ভেতরে-বাইরের সব বক্তব্য-বিবৃতির লক্ষ্য এখনো তাই বিএনপির নেত্রী। স্বেচ্ছায় অফিসবন্দী অথবা দপ্তর তালাবদ্ধ করে দেওয়ার রাষ্ট্রীয় কৌশল ঠেকানো—এই দুটির যেটিই সত্য হোক না কেন, বিএনপির নেত্রী যে তাঁর অফিস না ছাড়ার পণে অনড়, সেটা কারও বুঝতে বাকি থাকার কথা নয়। ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী ও এমপিদের নানা নাটকীয়তার কেন্দ্রও তাই বিএনপির নেত্রীর ওই দপ্তর। পরিবহনশ্রমিক, ছাত্রছাত্রী, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে গিয়ে কার্যালয় ঘেরাওয়ের পর সেখানে সম্প্রতি স্মারকলিপি দিয়ে এসেছেন কতিপয় চিকিৎসক-এমপি। একটি বড় দলের প্রধানকে তাঁর কার্যালয় থেকে উচ্ছেদ করলে সরকারের সাফল্যের তালিকা দীর্ঘায়িত হয় কি না, তা অবশ্য সরকারই ভালো বলতে পারে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর যে সফর ও বক্তৃতার কথা এই নিবন্ধের শুরুতে উল্লেখ করেছি, সেই বক্তৃতারই আরেকটি অংশ দিয়ে লেখাটি শেষ করব। মাহমুদ আলী তাঁর ওই বক্তৃতায় আশা প্রকাশ করেছেন, ‘মানবাধিকার পরিষদ শুধু মানবাধিকারের ইস্যুগুলো তুলে ধরবে না, বরং মানবাধিকার নিশ্চিত করতে কার্যকর পথ বাতলে দেওয়ার সংস্থায় পরিণত হবে।’ মানবাধিকার পরিষদ কিন্তু সংলাপের কথাই বলেছে। কোনো অজুহাতেই রাষ্ট্র যেন মানবাধিকার লঙ্ঘনের পথে পা না বাড়ায়, যাকে তিনি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বলে অভিহিত করেছেন, সেই বিষয়টিতে সাবধানতার কথা বলেছে। আমরা কি সেই পথ অনুসরণ করব? নাকি সারা বিশ্বের সবাই আমাদের ভালো চাইলেও আমরা আমাদের ভালো চাইব না?
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।