শিক্ষার্থীদের ক্ষতিপূরণ কে দেবে?

‘সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ থেকে বৃদ্ধি করে ৩৫ করা হোক—এ আলোচনা, এ দাবি অনেক দিন ধরেই চলছে। কী কী কারণে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, সে বিষয়েও বিস্তর লেখালেখি-আলোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। এমনকি চাকরিপ্রার্থীরা নিজেদের অর্থ-সময়-শ্রম বিনিয়োগ করে এই দাবিতে মানববন্ধন, সেমিনার, স্মারকলিপি প্রদানসহ অনেক কর্মসূচি পালন করে আসছেন।
মহাজোট আমলের প্রথম মেয়াদের শেষ দিকে সরকার কিছু জনকল্যাণমূলক কাজের উদ্যোগ নিয়েছিল। সেই কাজের তালিকায় সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছিল। এর আড়ালে হয়তো তাদের নির্বাচনে সমর্থন পাওয়াই লক্ষ্য ছিল, তবু এটি করলে সত্যি সত্যি একটি ভালো কাজ করা হতো। বাংলাদেশে যেখানে শিক্ষার্থীদের স্নাতকোত্তর পাস করতেই জীবনের ২৭-২৮ বছর পেরিয়ে যায়, সেখানে ৩০ বছরেই সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা শেষ হওয়াকে কোনো অবস্থাতেই স্বাভাবিক বলা যায় না।
বাংলাদেশ হচ্ছে হরতাল-অবরোধের দেশ। প্রতি পাঁচ বছর পর নির্বাচনকেন্দ্রিক বিড়ম্বনার কারণেও শিক্ষাজীবন ব্যাহত হয়। ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ সালে হরতাল-অবরোধেও যে পরিমাণ সেশনজট তৈরি হলো, তার দায় কি শিক্ষার্থীদের নিতে হবে? সেশনজট সৃষ্টির বহুবিধ কারণের কোনোটা না কোনোটা ঘটছেই। ফলে যথাসময়ে শিক্ষাজীবন শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। যদি হরতাল-অবরোধ কোনো কিছু না-ও থাকে, তবু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট দূর করা নিকট ভবিষ্যতে সম্ভব বলে মনে হয় না। বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। এ বিশ্ববিদ্যালয়টি যেহেতু অনেকটাই শিক্ষা বোর্ডের কার্যক্রমের মতো, তাই এখানে বেশিসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রয়োজন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গড়ে ২ হাজার ৬৬০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন মাত্র কর্মকর্তা। এত স্বল্পসংখ্যক জনবল দিয়ে প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থীর সেশনজট দূর করা সম্ভব হবে না। বিভাগীয় পর্যায়ে যে কার্যক্রম চালু করা হয়েছে, তা–ও সেশনজট নিরসনের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নয়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত ১৮.৫ বছর + ভর্তি প্রক্রিয়ায় দশমিক ৫ বছর + স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ৮ বা ৯ মোট ২৭-২৮ বছর প্রয়োজন হয়। অন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েও অভিন্ন চিত্র। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বয়সী প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী পড়ালেখা করেন। এ দুই লাখ বাদ দিলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ১৬ লাখ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করেন। এই ১৬ লাখ শিক্ষার্থীর প্রায় ৮৫ শতাংশ পড়ালেখা করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বাস্তবতায় তাঁরা বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় দু-তিন বছর চেষ্টার সুযোগ পান। ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষার দেড় বছরাধিক পর ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে। এ রকম হলে একটি বিসিএস পরীক্ষার চেয়ে বেশি চেষ্টা করার উপায় নেই।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর কোর্সের চেয়ে এক বছর বেশি পড়ালেখা করতে হতো। সে জন্য তাদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা করা হয়েছে ৩২ বছর। এখন সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও স্নাতক পর্যায়ে এক বছর কোর্স বাড়ানো হয়েছে। সেই বিবেচনায় সেশনজট যদি না-ও থাকত, তবু চাকরিতে প্রবেশের সময়সীমা দুই বছর এবং গড় আয়ু বৃদ্ধির জন্য চাকরির মেয়াদ ৫৭ থেকে ৫৯ করার কারণে আরও দুই বছর বাড়িয়ে ৩৪ করা প্রয়োজন।
যদি আমরা তাত্ত্বিকভাবে হিসাব করি, তাহলে একজন শিক্ষার্থীর ১৮ বছরে উচ্চমাধ্যমিক, চার বছরে স্নাতক (সম্মান) এবং এক বছরে স্নাতকোত্তর কোর্স সম্পন্ন করতে সময় প্রয়োজন হওয়ার কথা ২৩ বছর। একজন শিক্ষার্থীর স্নাতকোত্তর শেষ করতে ২৩ বছর, এরপর প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার জন্য যে সময় বেশি প্রয়োজন হবে, সেই সময়টুকু তাঁকে চাকরির চেষ্টার জন্য বেশি সুযোগ দিতে হবে। যদি একজন শিক্ষার্থী ২৮ বছর বয়সে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন, তাহলে প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার কারণে তাঁকে সবার জন্য নির্ধারিত সময়ের সঙ্গে প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নষ্ট হওয়া আরও পাঁচ বছর সুযোগ দিতে হবে। নির্ধারিত বয়সের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার সময়টুকু দাবি করা একজন শিক্ষার্থীর ন্যায্য অধিকার। স্বাভাবিকভাবে জন্ম তারিখের সঙ্গে ৩০ বছর যোগ করে চাকরিতে প্রবেশের সময় নির্ধারণ করা হয়। এ নিয়ম চালু করলে স্নাতকোত্তর পাসের দিন থেকে সাত বছর যুক্ত করে একজন চাকরিপ্রার্থীর চাকরিতে প্রবেশের বয়স নির্ণয় করতে হবে। একজন শিক্ষার্থী যদি নিজের জন্য এক দিনও সময় নষ্ট না করে, তাহলে প্রতিষ্ঠান যে সময় নষ্ট করে দিচ্ছে, সেই সময়টুকুর দায় তো তার নয়। দায় প্রথমত প্রতিষ্ঠানের, দ্বিতীয়ত রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র যদি ব্যক্তির যেকোনো ক্ষতিপূরণ দেয়, তাহলে সময় নষ্টের ক্ষতিপূরণ কেন দেবে না?
পিএসসির একটি প্রতিবেদনে বিভিন্ন দেশের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা দেখানো হয়েছে। তার মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারি চাকরির বয়সসীমা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘চাকরিপ্রার্থীদের বয়স বাংলাদেশের সরকারি চাকরির মতো সীমাবদ্ধ নেই। অর্থাৎ চাকরিপ্রার্থীদের বয়স ২১ হলে এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলে যেকোনো বয়সে আবেদন করতে পারে।’ কানাডিয়ান সিভিল সার্ভিসে নিয়োগে বয়সসীমা ২০ থেকে ৬০ বছর। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ও ম্যারিল্যান্ডে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২০ থেকে ৫৯ বছর। আসাম পাবলিক সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, সেখানে চাকরিতে প্রবশের বয়সসীমা উল্লেখ করা হয়েছে ১৮ থেকে ৩৮ বছর। শ্রীলঙ্কায় চাকরিতে প্রবেশের বয়স ১৮ থেকে ৪৫ বছর।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন বয়সে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা লক্ষ করা যায়। তাহলে বাংলাদেশের মতো একটি দেশে যেখানে প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার কারণে শিক্ষাজীবনে প্রচুর সময় নষ্ট হয়, সেখানে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা কেন ৩৫ বছর করা হবে না?
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
[email protected]