কেমন মেয়র চাই?

.
.

শহর কাঁদে; ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে; মেট্রোপলিস থেকে এই ঢাকা ক্রমেই যেন রূপান্তরিত হচ্ছে নেক্রোপলিসে—সিটি অব ডেথ—মৃতের শহরে; জীবন্ত মানুষের ভাগাড়ে; এ শহর যেন এক নোংরা ময়লা রুমাল। এর প্রাণ কোথায়? যেন ইস্পাত-কঙ্কাল; কবি যে বলেছেন, ‘যত বড় রাজধানী, তত বিখ্যাত নয় এ-হৃদয়পুর’।
সপ্তদশ শতকেও ঢাকা ছিল পৃথিবীর প্রধান দশটি শহরের একটি—গুরুত্ব ও সৌন্দর্যের বিচারে। অখণ্ড ঢাকা আজ দ্বিখণ্ডিত। আকাশ ধূমায়িত, মাটি প্রায় অবলুপ্ত। মানুষ এই নগরে থাকে কিন্তু তাদের নেই কোনো নাগরিক মর্যাদা; নেই নাগরিক অধিকার ও সুবিধা। বিভিন্ন জরিপ আর আন্তর্জাতিক সূচকে ঢাকা শহর এখন পৃথিবীর বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর অন্যতম। পৃথিবীর সব শহরেরই নিজস্ব একটি সংস্কৃতি রয়েছে। ইচ্ছা করলেই এক সিটির মতো আরেক সিটি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। ঢাকার নিজস্ব সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে। ঢাকার সৌন্দর্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দিকে আছে কি কারও মনোযোগ? এ এক স্থবির শহর। ২০ মিনিটের পথ মানুষকে দুই ঘণ্টায় পাড়ি দিতে হয়। গাড়ি চলে না। মানুষ তাই চলমান, আলোকিত আর গতিশীল ঢাকা চায়। দুর্নীতিমুক্ত আর সংকীর্ণ দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত সিটি প্রশাসন চায়।
দেড় কোটি মানুষের ঢাকা নগর কেবল সমস্যায় জর্জরিত। আমলা প্রশাসক দিয়েই এর পরিচালনা চলেছে। ফলে কোনো জবাবদিহি নেই। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ শোনার জন্যও কেউ নেই, সমাধান তো দূরের কথা। দীর্ঘদিন ধরে অনির্বাচিত প্রশাসক ঢাকার দেখভাল করছেন। জনপ্রতিনিধি হলে অন্তত কিছুটা জবাবদিহি থাকত; কিন্তু সরকার ইচ্ছা করেই দীর্ঘদিন ধরে জনপ্রতিনিধিহীন করে রেখেছে রাজধানীকে। অনেক বছর পর আবার নির্বাচন হতে যাচ্ছে। মানুষের আশা-প্রত্যাশা বেড়ে গেছে। মান্যবর মেয়র প্রার্থীরাও স্বপ্ন দেখাচ্ছেন বিস্তর।
প্রধানতম সমস্যা যানজট থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে চায় নগরবাসী। ট্রাফিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। রাজধানীতে সহজ যাতায়াতের সুব্যবস্থা থাকতে হবে। দ্রুত কম খরচে ঢাকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাওয়ার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া সব থেকে জরুরি। ঢাকার পরিবেশ দূষিত হয়ে পড়েছে বর্জ্য-আবর্জনায়। এখানে মানুষ নিশ্বাস নিতে কষ্ট পায়। প্রতিদিন কয়েক হাজার টন বর্জ্য রাস্তায় খোলা জায়গায় ফেলা হচ্ছে। পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা খুবই করুণ। পরিবেশদূষণ ভয়াবহভাবে প্রভাব ফেলছে ঢাকাবাসীকে।
প্রার্থীরা বলছেন, ঢাকাকে মানবিক নগর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। মানুষ নির্বাচিত ব্যক্তির কাছে একটি নিরাপদ ঢাকা চায়। সবাই চায় একটি গ্রিন ঢাকা, চায় ক্লিন ঢাকাও। পরিষ্কার ও বর্জ্যমুক্ত ঢাকা। তরুণেরা রাস্তায় সাইকেল চালাতে চান। বয়স্করা স্বাভাবিকভাবে সড়কে হাঁটতে চান। নারীরা নিরাপদ ট্রান্সপোর্ট চান। ঢাকায় কয়েক লাখ পোশাককর্মী নারী। বাসে উঠতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় নারীদের। বর্ষা নিয়ে বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। সর্বস্তরের মানুষের জন্য বিনোদনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকাবাসীর মধ্যে চরম নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে। সবাই নির্ভাবনার ঢাকা চায়। নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তা একটি অন্যতম বিষয়। কী খাচ্ছি আমরা? সবকিছুই বিষে ভরা। এর কি প্রতিকার হবে?
অনেক জায়গায় গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই। একজন দক্ষ মেয়র এসব সমস্যা সমাধান করতে ভূমিকা রাখতে পারেন। ওয়ার্ডগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন রকমের সংকট রয়েছে। খেলার মাঠ কিশোর–কিশোরীদের দাবি; কিন্তু ঢাকা থেকে খেলার মাঠ হারিয়ে যাচ্ছে। কয়েক লাখ লোক কাজের জন্য রাস্তায় নেমে পাবলিক টয়লেট পায় না। প্রাকৃতিক পরিবেশ ঢাকায় হারিয়ে গেছে। এই রুক্ষতা থেকে ঢাকাবাসী মুক্তি চায়। এ থেকে মুক্তি পেতে ঢাকাকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। সবার জন্য বাসযোগ্য নগর গড়ে তুলতে হলে আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার জরুরি। কয়েক লাখ বস্তিবাসীর জন্য কী করা যায়, আলাদা করে ভাবতে হবে তা নিয়েও। মশা-মাছির উপদ্রব থেকে রক্ষা, ধুলোবালুমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে সবুজ ঢাকা গড়ারও ইচ্ছার কথাও অনেকে বলছেন।
কোনো কোনো প্রার্থী বলছেন, সেবার মনোভাব নিয়ে কাজ করলেই ঢাকার উন্নয়ন সম্ভব। ঢাকাকে উন্নত বিশ্বের শহরগুলোর মতো সব শ্রেণি-পেশার মানুষের বাসযোগ্য করে তুলতে সেবার মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। ঢাকার নাগরিকেরা নিয়মিত কর পরিশোধ করছে। অথচ তারা নাগরিকসেবা সঠিকভাবে পাচ্ছে না। ডিসিসিতে নানা সমন্বয়হীনতা রয়েছে। এগুলো দূর করতে হবে। ঢাকার উন্নয়নে ভোটারদের প্রতি জনপ্রতিনিধিদের ‘বিশ্বাসযোগ্য ‘কমিটমেন্ট’ থাকতে হবে। ডিসিসির সেবা খাতগুলো জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডের মৌলিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আধুনিক নগরায়ণের জন্য দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শকে গুরুত্ব দিতে হবে।
এখনো বিশ্বমানের নগর হিসেবে ঢাকাকে গড়ে তোলা সম্ভব। রাস্তাঘাট, পানিনিষ্কাশন, পয়োনিষ্কাশন, জলাবদ্ধতা, মাদক সমস্যা, জন্ম-মৃত্যুর সনদ, ট্রেড লাইসেন্স, চারিত্রিক সনদ প্রাপ্তির সমাধানসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানে দ্রুত কাজ করতে হবে। বৃদ্ধদের জন্য ওল্ডহোম গড়ে তোলা দরকার। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। হাতিরঝিলের মতো আরও কয়েকটি দৃষ্টিনন্দিত এলাকা সৃষ্টি করতে হবে। রাজধানীর চারপাশের নদীগুলোকে খনন করে পানিপথে চলাচলের সুযোগ তৈরি করাও জরুরি। পর্যাপ্ত পার্ক নেই। সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণে ভাড়াটিয়া আইন কার্যকর করতে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। সিটির সব প্রাথমিক বিদ্যালয়কে আধুনিকায়ন করা দরকার। নগর ভবনে অনিয়মের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। সিটি করপোরেশনের প্রতিটি শাখায় নাগরিক সেবার জন্য ওয়ানস্টপ সার্ভিস সেন্টার চালু করা যেতে পারে।
রাজধানী বছরের পর বছর অবহেলায়-অযত্নে আছে। রাজউক, ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, ডেসকো, ডেসা, তিতাসসহ ঢাকার সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমন্বয় করে কাজ করাতে হবে। এখন টেলিফোন তারের জন্য একবার রাস্তা খোঁড়া হয়। আবার একই রাস্তা বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইনের জন্য পৃথক পৃথক সময়ে কাটা হচ্ছে।
সেবামূলক কাজগুলোর মধ্যে একটি সমন্বয় থাকা প্রয়োজন। নগর সরকারব্যবস্থা হলে এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করে একবারে এসব কাজ করা যাবে। দখলবাজদের হাত থেকে যেমন মুক্ত করতে হবে, তেমনি সিটি করপোরেশনকে কেন্দ্রীয় সরকারের আজ্ঞাবহতা ও আমলাতান্ত্রিকতা থেকে মুক্ত করে কার্যকর নগর সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জননিরাপত্তা, নারী-শিশুর নিরাপত্তা, সন্ত্রাসমুক্ত নগর, শিশুর বিকাশের উপযোগী পরিবেশ, পার্ক, খেলার মাঠ, সবুজায়ন, ফুটপাতে দোকান, অপরিকল্পিত মার্কেট বায়ু-বর্জ্য-শব্দদূষণমুক্ত নগর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিক্ষা-স্বাস্থ্য এগুলো নাগরিকের অধিকার। পুনর্বাসন ছাড়া বস্তি, হকার, রিকশা উচ্ছেদ না করা, খাল-জলাশয় দখল ও দূষণমুক্ত করারও আইনি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। প্রয়োজনমতো স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, স্কাই ট্রেন, পাতাল ট্রেন চালু ও কর্মসংস্থান প্রতিষ্ঠা করা দরকার। পার্কগুলো উদ্ধার করা দরকার। বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করে বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত করা দরকার।
নির্বাচিত মেয়রের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত নগরবাসীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। পরিবর্তন সম্ভব, নগরজীবনের
তাই পরিবর্তন আনতে হবে। ঢাকাকে সুন্দর ও বসবাসযোগ্য করতে নতুন মেয়রকে নিরলস কাজ করে যেতে হবে। জ্ঞানীর বচনে পাই: ‘ঘোড়ায় চড়ে রাজ্য জয় করা সহজ কিন্তু রাজ্য শাসন করতে হয় ঘোড়া থেকে নেমে, আর এটাই সব থেকে কঠিন কাজ।’ কেউ না কেউ তো নির্বাচিত হয়ে আসবেন, সেটা সহজ, কিন্তু আসল কাজ নির্বাচিত হওয়ার পর। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা গগনচুম্বী। মাননীয় মেয়ররা কি পারবেন পূরণ করতে?
রোবায়েত ফেরদৌস: সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]