ছেঁড়াখোঁড়া ডায়েরির অংশ

তখন পড়ি ক্লাস সেভেনে। দেশে গণভোট হবে। গণভোটের নিয়ম অভূতপূর্ব। কোনো সিল-ছাপ্পড় মারতে হবে না। দুটো বাক্স থাকবে পোলিং বুথে। একটাতে লেখা থাকবে ‘না’। আরেকটাতে থাকবে সামরিক পোশাক পরা জেনারেল জিয়াউর রহমানের ছবি। সেটাতে লেখা ‘হ্যাঁ’। ব্যালট পেপারে কোনো মার্কাটার্কা থাকবে না। একেবারে ধবধবে সাদা কাগজ। প্রতিটা ভোটার একটা করে ব্যালট পেপার পাবে। তারপর সেই কাগজ ঢোকাতে হবে। ‘হ্যাঁ’ বাক্সেও ঢোকানো যাবে। ‘না’ বাক্সেও ঢোকানো যাবে। সেই ভোটের সময় চলে গেলাম গ্রামের বাড়িতে। গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ থানায়।
ভোট দেখতে মাইল খানেক দূরের স্কুলের মাঠে যাই।
যেই ভোট দিচ্ছেন, তাঁকেই একটা করে বিড়ি দেওয়া হচ্ছে।
বিড়ির লোভে অনেক কিষান মাঠ থেকে এসে ভোট দিয়েওছিলেন। তবে নারীরা আসেননি। আসার দরকার ছিল না। কারণ, নারীদের বিড়ি দেওয়া হয়নি। যদিও মাঝেমধ্যেই রব উঠছিল ভোট দিতে না এলে ধরে নিয়ে যাওয়া হবে। ছেলে-ছোকরার দল, যাদের ভোট নেই, তারা বেশ মজা পেয়েই গেল। বিড়ি নেয়। আর ভোটকেন্দ্রে যায়। দুইটা ভোট ‘হ্যাঁ’ বাক্সে ফেলে। দুইটা ভোট ‘না’ বাক্সে ফেলে। তারপরেও ভোটারের উপস্থিতি শতকরা ৫ শতাংশের বেশি হয় না। তার মধ্যে আবার অনেক ভোট বেয়াদব পোলাপানে ‘না’ বাক্সে ফেলেছে।
প্রিসাইডিং অফিসার ছিলেন আমাদের পরিচিত। বিকেল পাঁচটা বাজতে না-বাজতেই তিনি সব ব্যালট ছিঁড়লেন। তারপর সব ভরে ফেললেন হ্যাঁ বাক্সে। না বাক্সেরগুলোও ঢাললেন। সেসবও ভরলেন হ্যাঁ বাক্সে।
সেই ভোটের সরকারি ফল ছিল ৮৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। হ্যাঁ পেয়েছে প্রায় ৯৯ শতাংশ। না পড়েছে ১ শতাংশ।
সে আজ থেকে ৩৮ বছর আগের কথা। সেসব দিন কবেই গত হয়েছে। এখন এই দেশে ভোট কেমন হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মতো করে আমাদেরও অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ জনমতের প্রকৃত প্রতিফলনের ভোটের জন্য আমাদের নিজেদেরই অভিনন্দন জানাতে হবে। একটা লাশ পড়েনি। একটা বুথে আগুন দেওয়া হয়নি। এত সুন্দর, এত সুষ্ঠু, এত শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সাম্প্রতিক কালে আর হয়নি। অভিনন্দন নির্বাচন কমিশন। একটি আদর্শ শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মডেল হিসেবে ২৮ এপ্রিল ২০১৫-এর নির্বাচনকে সোনার ফ্রেমে বেঁধে রাখতে হবে। অভিনন্দন, গণতন্ত্র। গণতন্ত্র জয়ী হয়েছে। ৩-০ ব্যবধানে গণতন্ত্র বিজয়ী হয়েছে। বিরোধীরা বাংলাওয়াশ হয়েছে।
সিটি নির্বাচনে ভোট দিতে আমিও গিয়েছিলাম। আমি দক্ষিণের ভোটার। সকাল সকালই কেন্দ্রে গিয়ে হাজির হয়েছি। আমার ভোট একটা স্কুলে। আমার স্ত্রীর ভোট আরেকটা স্কুলে। গিয়ে দেখি, কোথাও বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের কোনো পোস্টার নেই, কোনো কর্মী নেই। ইলিশ মাছ মার্কার নেতা হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন। করমর্দন করলেন। তাঁর কর্মীরা আছে। তারা টেবিল নিয়ে বসে ভোটারদের বুথ-কেন্দ্র ইত্যাদি খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। কিশোর বয়সী ছেলেরা এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে ফটোও তুলল। আমি বললাম, প্রতিদ্বন্দ্বীরা কোথায়। ওরা বলল, আসেনি।
আমি ভেতরে গিয়ে নিজের ভোট দিলাম। তিনজন বয়স্ক ভদ্রলোক পোলিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করছেন। ভেতরে ঢাকা-বিশেষজ্ঞ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক প্রধান নজরুল ইসলাম স্যারকেও পেলাম, ভোট দিয়ে বেরিয়ে আসছেন। তাঁকে বললাম, সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ভোটের বুথে এসে ঢাকা-বিশেষজ্ঞর সাক্ষাৎ পাওয়া খুব ভালো লক্ষণ। কিন্তু বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের এজেন্ট দেখলাম না। কর্মী দেখলাম না। ইলিশ মাছের এজেন্টদের জিজ্ঞেস করলাম, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর এজেন্ট কোথায়? ওরা বললেন, আসেনি।
প্রিসাইডিং অফিসারও এলেন। সৌজন্য সাক্ষাৎ করে গেলেন। এখান থেকে আমরা গেলাম আরেকটা কেন্দ্রে। আমার সহধর্মিণী সেখানে ভোট দেবেন। নির্বাচন পর্যবেক্ষক দুটো দলের সঙ্গে দেখা হলো সেখানে। পুরো ভোটকেন্দ্র ফাঁকা। কোথাও কোনো লাইন নেই। বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের কোনো কর্মী, স্বেচ্ছাসেবক, এজেন্টের দেখা পেলাম না।
২০০৮ সালে একই কেন্দ্রে ভোট দিয়েছি। সকালবেলা এসে দেখি ভিড়। সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। সবার মুখ হাসি-হাসি। আর চেহারা দেখলেই বোঝা যাচ্ছে কোন মার্কায় তারা ভোট দিতে যাচ্ছেন। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমরা গল্প-গুজব-আড্ডাতেও মেতে উঠলাম। অথচ আজকে জায়গাটাকে শোকের বাড়ি মনে হচ্ছে কেন?
সকাল নয়টা পর্যন্ত আমার দেখা দুটো কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ ছিল শান্তিপূর্ণ। কিন্তু ভোটারের উপস্থিতি ছিল নগণ্য।
পর্যবেক্ষকদের জিজ্ঞেস করলাম, সকাল নয়টা বাজে, ভোটকেন্দ্রে ভোটারের ভিড় নেই কেন?
একজন বললেন, মানুষের আগ্রহ নেই। কোন পক্ষ জিতল বা হারল তাতে নগরবাসীর কিছু যায়-আসে বলে মনে হয় না। মানুষ খুব হতাশ।
জানি না তিনি ঠিক বললেন কি না।
ঘরে ফিরে এসে বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা দেখার জন্য টিভি অন করলাম। বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে শান্তিপূর্ণ সুষ্ঠু অবাধ সিল মারার খবর আসছে, টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সেসব প্রচার করছে।
সন্ধ্যা নাগাদ আমরা জানি ভোট পড়েছে ৪০ শতাংশের মতো। দুজনেই ভালো ভোট পেয়েছেন। আমার সেই ৩৮ বছর আগের বিকেলটা মনে পড়ছে।
সেদিন আমাদের গ্রামের প্রিসাইডিং অফিসার যখন না ভোটের বাক্স থেকে হ্যাঁ ভোটের বাক্সে সব ব্যালট ভরে দিচ্ছিলেন, তখন একজন পোলিং অফিসার বলছিলেন, স্যার, কাজটা কি ঠিক হইতেছে?
তখন প্রিসাইডিং অফিসার জবাব দিয়েছিলেন, আপনার কি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং তাঁর নীতি ও কর্মের প্রতি আস্থা নেই?
হ্যাঁ, আছে।
আমরা তো সেই আস্থাই দেখাচ্ছি।
দেশ এগোচ্ছে। গণতন্ত্র এগোচ্ছে। এখন কেবল না-কে হ্যাঁ বানালে হয় না, কিছু না-তেও রাখতে হয়। আগে চক্ষুলজ্জা ছিল না। এখন আছে কি না জানি না, তবে স্মার্টনেস বেড়েছে। দক্ষতা বেড়েছে।
নেপালের ভূমিকম্প বেশ বড় ছিল। তারপরেও কিন্তু ৯০ শতাংশ ভবন অক্ষত আছে। কারণ, ভালোভাবে নকশা করা, ভালোভাবে নির্মিত ভবন সাধারণত ভূমিকম্পেও ভাঙে না। প্রকৌশল একটা বিশেষ বিদ্যা। এটা অর্জন করতে হয়। হাজার বছর ধরে জ্ঞান অর্জন করে সেটাকে বিশেষজ্ঞরা এই বিদ্যার ভান্ডারে সঞ্চয় করে রেখেছেন।
তবে নতুন নতুন বিভাগ ও বিষয় খুলতে হচ্ছে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। আমাদের চোখের সামনে হলো কম্পিউটার কৌশল বিভাগ। এটা আগে ছিল না।
এবার একটা নতুন বিভাগ খুলুন—ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। ইঞ্জিনিয়ারিং কাজটা ভালো হলে ভবন ধসে পড়ে না, মিছিলকারীরা ঝাঁকি দিলেও না। ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং ভালো হলে সরকার পড়বে না।
কিন্তু যে প্রশ্নের জবাব মিলছে না, তা হলো বিএনপি সব কেন্দ্রে এজেন্ট দিল না কেন? অন্তত ১০০ জন স্বেচ্ছাসেবক প্রতিটা কেন্দ্রে ভোটারদের এগিয়ে নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকল না কেন? তাহলেও লাখ লাখ কর্মীকে সেদিন মাঠে দেখা যেত। তাদের এজেন্টকে বের করে দেওয়া হচ্ছে, এই খবর ছড়ালে তারা নির্বাচন কমিশনের দিকে যেতে পারতেন। ভোটারদের কোনো আগ্রহ নেই, দলীয় নেতা-কর্মীদেরও আগ্রহ নেই? আশ্চর্য!
স্মার্টনেস আসলেই বেড়েছে। প্রকৌশলবিদ্যাও এগোচ্ছে। ভোটের অধিকার, ভাতের অধিকার নিশ্চিতকরণ চলছে বটে। বটে!
কিন্তু বিএনপির হলোটা কী?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।