সবাই জিতল, হারল নির্বাচনটাই!

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের লাভ-ক্ষতি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে এখন নানা হিসাব-নিকাশ চলছে। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী উভয় পক্ষ নিজেদের ‘বিজয়ী’ বলে দাবি করছে। কীভাবে করছে, সেই আলোচনায় পরে আসছি।
তার আগে বাংলাদেশের একটি স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের আগ্রহ ও উদ্বেগের বিষয়েও কিছু কথা বলা দরকার। নির্বাচনের আগে তিন মাসজুড়ে দেশে নৈরাজ্য চলছিল। অর্থনীতি হয়ে পড়ছিল স্থবির। তাই অনেকেই ভেবেছিলেন, স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনটি রাজনীতিতে সুস্থ ধারা ফিরিয়ে আনার পথ সুগম করবে। জাতিসংঘ মুখপাত্র বলেছিলেন, তাঁরা এই নির্বাচনকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে বলে আশা করছেন। এখন বলেছেন, যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অভিযোগগুলোর তদন্ত হওয়া উচিত। ভোটের চিত্র দেখে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূতদ্বয়ও হতাশা প্রকাশ করেছেন। দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা বলেছেন, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি।
নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, তিন সিটিতে গড়ে ৪৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। বিভিন্ন কেন্দ্রের ভোটচিত্রের সঙ্গে এই পরিসংখ্যান মেলে না। বিএনপির সমর্থক তিন মেয়র প্রার্থী বেলা সাড়ে ১২টার মধ্যে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়ার পরও তাঁদের ঝুলিতে নয় লাখের বেশি ভোট পাওয়া অবিশ্বাস্য। তাঁদের প্রাপ্ত ভোটের সঙ্গে বিএনপি-সমর্থক কাউন্সিলর প্রার্থীদের ভোটের হারও মেলে না। ঢাকা উত্তরে বিএনপি-সমর্থক মেয়র প্রার্থী ৩ লাখ ২৫ হাজার ভোট পেলেও কাউন্সিলর পদে জিতেছেন মাত্র একজন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচনে অনিয়ম হলে বিএনপির সমর্থক মেয়র প্রার্থীরা এত বেশি ভোট পেলেন কীভাবে? একই প্রশ্ন আমাদেরও। দুপুর ১২টার আগেই যদি তাঁরা ৯ লাখ ২৪ হাজার বা প্রদত্ত ভোটের ৩৫ শতাংশ পেতে পারেন, পুরো সময়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকলে তো তাঁদের ভোটের পরিমাণ সরকার-সমর্থক প্রার্থীদের র দ্বিগুণ হওয়ার কথা। আসলে পুরো হিসাবেই শুভংকরের ফাঁকি আছে বলে ধারণা করি।
তিন সিটিতে মেয়র পদে তিন আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রার্থী জিতেছেন ১৪ লাখ ৭০ হাজার ভোট পেয়ে। শতাংশের হিসেবে ৫৫ ভাগ। কাউন্সিলর পদেও তাঁদের ৯০ শতাংশ প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং একে হরতাল-অবরোধের বিরুদ্ধে জনগণের রায় বলে উল্লেখ করেছেন। নির্বাচনী ফল প্রকাশের পর ক্ষমতাসীনেরা বিজয়ের আনন্দে ভাসছেন। ফুলেল শুভেচ্ছায় অভিনন্দিত হচ্ছেন বিজয়ী প্রার্থীরা। মিষ্টিমুখ করার ছবিও পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। ফলে তাঁরা নিজেদের বিজয়ী দাবি করতেই পারেন।
অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ভোট গ্রহণের চার ঘণ্টার মাথায় ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। নির্বাচনে প্রার্থিতা ঘোষণা করেছিলেন আদর্শ ঢাকা আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ। আর ভোট বর্জন ও প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ। বিএনপির নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও নিজেরা ভোটকেন্দ্রে যাওয়া কিংবা পোলিং এজেন্টরা গিয়েছেন কি না, সেটি দেখার প্রয়োজন বোধ করেননি। এমনকি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়ার আগে নির্বাচন কমিশনে একটি নালিশও কেউ জানাননি। তাঁরা সম্ভবত নির্বাচনে প্রার্থীর জয়ের চেয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই যে সুষ্ঠু ও অবাধ হতে পারে না, সেটি প্রমাণ করতে বেশি উৎসাহী ছিলেন। নাহলে এভাবে আওয়ামী লীগ কর্মীদের হাতে মাঠ ছেড়ে দিতেন না। তাঁরা এখন বলবেন, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে না যাওয়া এবং নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করা সঠিক ছিল। অতএব বিএনপিও নিজেকে বিজয়ী দাবি করতে পারে। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘দুই দলই কৌশলে জিতেছে।’ আসলে এটি কৌশল নয়, অপকৌশল।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ দাবি করেছেন, তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। কোথাও অনিয়ম ও কারচুপির ঘটনা ঘটেনি। এ জন্য তিনি নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদও জানিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন, বিশেষ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনারও এ রকম একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নিজেকে বিজয়ী বলে দাবি করতে পারেন। হুদা কমিশন শত চেষ্টা করেও ঢাকা সিটি করপোরেশনে একটি নির্বাচন করতে পারেনি। অথচ রকিব কমিশন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করে দেশবাসী তো বটেই, বিশ্বসম্প্রদায়কেও তাক লাগিয়ে দিয়েছে। অন্যান্য নির্বাচন কমিশন যেখানে একটি-দুটি সিটির নির্বাচন করতেই হিমশিম খায়, সেখানে রকিব কমিশন অনেকগুলো সিটির নির্বাচন করে দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে। ২০১৩ সালে পাঁচ সিটি করপোরেশনে বিএনপির সমর্থক প্রার্থীরা জয়ী হওয়ায় স্থানীয় সরকার সংস্থায় যে রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, রকিব সাহেব তিন সিটিতে আওয়ামী লীগকে জিতিয়ে সেই ভারসাম্যও ফিরিয়ে এনেছেন। এই মহতী দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি ও তাঁর কমিশন কৃতিত্ব দাবি করতে পারে।
তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থক-শুভানুধ্যায়ী, লেখক-বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীদের নিয়ে দুটি কমিটি গঠিত হয়। বিএনপির সমর্থক কমিটির নেতৃত্ব দেন অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ আর আওয়ামী লীগ-সমর্থক কমিটির নেতৃত্ব দেন লেখক-কবি সৈয়দ শামসুল হক। সৈয়দ হকের কমিটি তাদের সমর্থিত প্রার্থীদের বিজয়ে অভিনন্দন জানিয়েছে। আর এমাজউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন কমিটি ভোট বাতিল করে নতুন নির্বাচনের কথা বলেছে। তারা দুই পক্ষই নিজেদের যুক্তি ও দাবি সঠিক মনে করে। তাই তারাও নিজেদের বিজয়ী বলে দাবি করতে পারে।
সিটি নির্বাচন উপলক্ষে সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা পুলিশ র্যা ব বিজিবি মিলে ৮০ হাজার সদস্যকে নিয়োগ করেছিল। তাঁরা সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন বলেই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ভাষায় একটি ‘সুন্দর’ নির্বাচন হতে পেরেছে। অতএব তাঁরাও নিজেদের বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করতে পারেন। সকাল ৮টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত সবার অংশগ্রহণে, এরপর থেকে চারটা পর্যন্ত বিরোধী দলের বর্জনের মুখে এবং আওয়ামী লীগের বিবদমান কাউন্সিলর প্রার্থীদের গোলাগুলি, হাঙ্গামার মধ্যে নির্বাচন করা চাট্টিখানি কথা নয়। তারা এও প্রমাণ করেছে যে সেনাবাহিনী মোতায়েন ছাড়াও বাংলাদেশে নির্বাচন হতে পারে। ভোটের সময় বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সংঘাত-সংঘর্ষ রোধে তারা শক্তি প্রয়োগ না করে তাদের বুঝিয়ে শান্ত রাখতে চেষ্টা করেছে। অনেক কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়মিত সদস্যদের পাশাপাশি অল্প বয়সী তরুণেরা আনসার ভিডিপির পোশাক পরে দায়িত্ব পালন করেছে। তাদের কেউ ছাত্র, কেউ দলের কর্মী। বাংলাদেশে পোশাকধারী ও সিভিলিয়ানদের মধ্যে সহযোগিতার এই দৃষ্টান্ত অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। ভবিষ্যতে নির্বাচন করতে হয়তো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়মিত সদস্যদেরই প্রয়োজন হবে না। তাদের পোশাকটিই কেবল কাজে লাগানো হবে। এই নির্বাচনে আনসার ভিডিপির পোশাক পরিয়ে যে শত শত তরুণকে নামানো হয়েছিল, তাঁরা সজাগ ও সতর্ক ছিল বলেই জনগণ স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে প্রত্যাখ্যান করেছে, অতএব তাঁরাও নিজেদের বিজয়ী বলে দাবি করতে পারেন।
তবে এই নির্বাচনে জয়ের দাবি করতে পারবেন না সাধারণ ভোটাররা, যাঁরা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখেছেন, তাঁদের ভোটটি দেওয়া হয়ে গেছে। অথবা ভোট দিতে গিয়ে শুনেছেন, ভাই, আপনার কষ্ট করার দরকার নেই, আমরাই আপনার ভোটটি দিয়ে দেব। এই নির্বাচনে তাঁরাও নিজেদের জয়ী দাবি করতে পারবেন না, টিভিতে ভোটকেন্দ্রের ছবি দেখে ভোটকেন্দ্রে যেতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এই নির্বাচনে তাঁরাও বিজয়ী দাবি করতে পারছেন না, যাঁরা প্রকৃতপক্ষেই একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চেয়েছিলেন। যাঁরা ভেবেছিলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনটি ভালোয় ভালোয় হয়ে গেলে, জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট বিরোধেরও শান্তিপূর্ণ মীমাংসা হয়ে যেতে পারে। এই
নির্বাচনে তারাও জয়ী হননি, যাঁরা চেয়েছিলেন, হরতাল-অবরোধ, আগুনে–বোমার পাশাপাশি পাইকারি মামলা-হামলার উৎকট মহড়া থেেকও দেশ মুক্ত হলো।
নির্বাচন হলো এমন এক ব্যবস্থা, যা ভোটারদের পছন্দসই প্রতিনিধি বাছাইয়ের সুযোগ করে দেয়। যে ব্যবস্থা ভোটকেন্দ্রে যেতে ভোটারদের উৎসাহিত করে। কিন্তু আমরা কিছুদিন পর পর এমন নির্বাচনের আয়োজন করি, যা দেখে ভোটাররা ভয় পান, বিদেশি কূটনীতিক আতঙ্কে থাকেন (সুইডিশ রাষ্ট্রদূতের অভিজ্ঞতা স্মরণ করুন)। নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র নয়; গণতন্ত্রের একটি অতি আবশ্যকীয় উপাদান। আমরা স্বাধীনতার ৪৪ বছরেও সেই নির্বাচনটি কীভাবে হবে, কাকে নিয়ে হবে, কার অধীনে হবে, সেসব বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। কেন পারিনি, সেই প্রশ্নের জবাব যাঁদের কাছে চাওয়ার, তাঁরা নিজেদের ছাড়া অন্য কারও কথা শুনতে অভ্যস্ত নন। মঙ্গলবারের ভোটের মহড়ায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন—সবাই জিতেছে, হেরেছে কেবল নির্বাচনটাই।
তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন আবার প্রমাণ করল আমরা গণতন্ত্রের যোগ্য হয়ে উঠিনি। কবে যোগ্য হয়ে উঠব?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০[email protected]