দুই পক্ষের 'রাজনীতি' ও প্রতারিত ভোটার

প্রার্থী-ইশতেহার এসব দেখে তিন সিটির ভোটাররা ভোট দেবেন, নাকি ‘রাজনৈতিক’ বিবেচনাই বড় হবে, সে প্রশ্ন রেখেছিলাম আগের এক লেখায় (প্রথম আলো, ২০ এপ্রিল)। ধারণা ছিল, আগের মতো রাজনৈতিক বিবেচনাই এই নির্বাচনগুলোতে মূল হয়ে উঠবে। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় সেই হিসাব-নিকাশ এখন আর করা যাচ্ছে না। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে এক বড় ‘রাজনীতিই’ হয়ে গেল! যেখানে নিজেদের মতো করে দুই পক্ষই জিতল।
হঠাৎ করে সরকারের সিটি নির্বাচনের সিদ্ধান্ত ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক। সাংগঠনিকভাবে বিশৃঙ্খল ও অপ্রস্তুত বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলা ও ৫ জানুয়ারি ভোট বর্জনের মতো আবার কোনো ভুল করে কি না, সেই ফাঁদে ফেলা। অন্যদিকে বিএনপিও তখন একটি কৌশলগতভাবে ভুল, ব্যাপক সমালোচিত (পেট্রলবোমানির্ভর অবরোধ) ও ব্যর্থ আন্দোলন থেকে বের হওয়ার অছিলা খুঁজছিল। এই নির্বাচনকে বিএনপি সেই সুযোগ নিয়েছে। এ ধরনের স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলো সব সময়ই বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির জন্য সুবিধাজনক। কারণ, এসব নির্বাচনে পরাজিত হলে সরকারের বিরুদ্ধে সহজে কারচুপির অভিযোগ তোলা যায়, আর বিজয়ী হলে জনগণ সরকারের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছে, সে দাবি করা যায়। এ কারণেই এসব নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, কোনোটাই সরকারের জন্য খুব স্বস্তি নিয়ে আসে না।
এই নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকেই অনেক অভিযোগ বা সব প্রার্থীর জন্য সমান মাঠের নিশ্চয়তা নিয়ে শঙ্কা থাকলেও জনমনে তা একটি উৎসাহের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। অনেক তরুণ ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির প্রার্থী এবারের মেয়র নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। প্রার্থী, তাঁদের ইশতেহার, শহর নিয়ে তাঁদের পরিকল্পনা, কীভাবে তাঁরা শহরের সমস্যাগুলো দূর করবেন—এসব নিয়ে এবারের গণমাধ্যমে যত মাতামাতি হয়েছে, আগে কখনো তা হয়নি। প্রার্থীরা একই সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, গোলটেবিল বা বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। এগুলোর পরিবেশ ছিল খুবই সৌহার্দ্যপূর্ণ। এসবই আমাদের নাগরিকদের মনে আশা জাগিয়েছিল। সেই নির্বাচন কেন এমন পরিণতি পেল? এমনকি ভোটের দিন সকালেও ভোটারদের মধ্যে যে আগ্রহ ও উৎসবের পরিবেশ বজায় ছিল, তা-ও কিন্তু এমন একটি নির্বাচনের ইঙ্গিত দেয়নি।
একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করে সরকারি দলের প্রার্থীদের পরাজিত হওয়ার অর্থ হচ্ছে খালেদা জিয়ার ‘নীরব প্রতিশোধের’ স্বীকৃতি মেলা, যা সরকারের জন্য বড় রাজনৈতিক পরাজয় হিসেবেই বিবেচিত হতো। আর সরকারে থাকার নানা সুযোগ নিয়ে নির্বাচনী জয়ী হওয়ার ফল হচ্ছে নির্বাচনে কারচুপি ও অনিয়মের সমালোচনার মুখে পড়া। গত ২৮ এপ্রিল যে নির্বাচন হলো, তাতে এটা পরিষ্কার হয়েছে যে সরকার শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় পথটিকেই বেছে নিয়েছে। কিন্তু সরকারে থেকে নির্বাচনে সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার ও তা ব্যবহার করারও তো একটা মাত্রা থাকে, রাখঢাক থাকে, কৌশল থাকে। বোঝা যায়, শেষ সময়ে এসে সরকার একেবারে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে।
নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী দলের প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থক বা সম্ভাব্য এজেন্টদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বা দলের লোকজনের মাধ্যমে ভয় দেখানো, হুমকি দেওয়া বা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশির অভিযোগ উঠেছে। পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে প্রতিবেদন হয়েছে। তবে সরকারের এ ধরনের অপকর্মের সত্যতা থাকলেও কাগজে-কলমে প্রমাণ করা কঠিন। কিন্তু ২৮ এপ্রিলের নির্বাচনের দিন বুথ দখল, ব্যালট পেপার ছিনিয়ে গণসিল, সরকারি দল-সমর্থকদের যা খুশি তা-ই করার সুযোগ দেওয়া এবং এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়কের ভূমিকা পালন ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের নিষ্ক্রিয় বা অসহায় দশার বিষয়গুলো তো আর লুকানো বিষয় ছিল না।
নির্বাচনের দিন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের দুটি ওয়ার্ডের সাতটি নির্বাচনী কেন্দ্রে ঘুরেছি। কোনো কেন্দ্রের সামনে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের ক্যাম্প বা লোকজন না দেখে ধারণা হয়েছিল যে তাঁরা হয়তো খালেদা জিয়ার আহ্বানে ‘নীরব প্রতিশোধ’ নেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। আর বিএনপির নেতা-কর্মীরা যেহেতু প্রকাশ্যে মাঠে নেই, তাই তাঁদের ওপর হামলা বা প্রকাশ্যে হুমকি-ধমকির ঘটনাও চোখে পড়েনি (অন্তত আমার দেখা সাতটি কেন্দ্রে)। প্রশ্ন হচ্ছে, এ অবস্থায় ভোটকেন্দ্র দখল বা গণসিল মারার দরকার হয়ে পড়ল কেন? সকালের দিকে দৃশ্যত যে শান্ত পরিস্থিতিতে ভোট শুরু হয়েছিল, তা বেলা ১১টার পর পাল্টাতে শুরু করল কেন?
আমার দেখা সাতটি কেন্দ্রের মধ্যে দুটি কেন্দ্রে বুথ দখল ও গণসিল মারার ঘটনা ঘটেছে। দুটি ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আগে-পরে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। দুটি ঘটনাই ঘটিয়েছেন স্থানীয় কাউন্সিলর প্রার্থীদের সমর্থকেরা। সিটি নির্বাচন যে শুধু মেয়র নির্বাচন নয়, ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কাউন্সিলরও যে নির্বাচিত হবেন এবং স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী এসব প্রার্থীরা যে অঘটন ঘটানোর ক্ষমতা রাখেন, সেটা সম্ভবত খুব একটা বিবেচনায় ছিল না।
ভোটের দিন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারি দলের সমর্থন পাওয়া কাউন্সিলর প্রার্থী ও সমর্থন না পাওয়া বিদ্রোহী বা প্রভাবশালী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থকেরা সংঘর্ষ, ভোটকেন্দ্র দখল বা ব্যালট পেপারে গণসিল মারার মতো অপকর্মগুলো ঘটিয়েছেন। নির্বাচনী ফলাফলে দেখা গেল আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের ব্যাপক দাপটের মুখেও প্রায় ২০ জন বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের অনুপস্থিতিতে সরকার-সমর্থক প্রার্থীদের মধ্যে এ ধরনের ঘটনাগুলোকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেন অনেকটা ‘ফ্রেন্ডলি ফাইট’ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে নিষ্ক্রিয় থেকেছে। নির্বাচনী কর্মকর্তারও মনে হয় একই কারণে কোনো পদক্ষেপ নিতে উৎসাহী হননি। ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদপ্রার্থী অনেক আগেভাগেই স্থানীয় থানা-পুলিশকে হাত করে রেখেছেন বলে অনেকের কাছ থেকে অভিযোগ শুনেছি।
ভোটের পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে এভাবেই, এ ধরনের ঘটনার মধ্য দিয়েই। সাংবাদিকদের ক্যামেরা নিয়ে ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দেওয়ার ফলে বুথ দখল বা ব্যালট পেপারে গণসিল মারার মতো ঘটনাগুলো ঘটানো সহজ হয়েছে। পুলিশ ও সরকারি দলের লোকজন বিভিন্ন কেন্দ্রে সাংবাদিকদের সঙ্গে যে আচরণ করেছে, তাতে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে পরিকল্পনা করেই কাজগুলো করা হয়েছে। উদ্দেশ্য, গণমাধ্যমে যাতে ভোটের কোনো অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা না যায়। কিন্তু মহল্লাকেন্দ্রিক নির্বাচনের এসব অনিয়ম ও সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা চাপা থাকেনি। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতির ওপর এসব ঘটনা প্রভাব ফেলে।
ভোটকেন্দ্রে ঘোরার সময় বেলা সাড়ে ১১টার দিকেই নানা জন প্রশ্ন করতে থাকেন, বিএনপি নাকি নির্বাচন বর্জন করেছে? এর ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই যখন বিএনপির আনুষ্ঠানিক ভোট বর্জনের ঘোষণা আসে, তখন নির্বাচনটি আর নির্বাচনই থাকল না। আওয়ামী-সমর্থকদের অনেকেও মনে করলেন, দলের প্রার্থীকে জেতাতে তাঁদের আর কষ্ট করে ভোট না দিতে গেলেও চলবে। ভোটকেন্দ্রগুলো দৃশ্যত ভোটারশূন্য হয়ে পড়ে। এরপর কাউন্সিলর প্রার্থীরা যে যার শক্তি অনুযায়ী নিজেদের পক্ষে ভোট নেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন। ততক্ষণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা নির্বাচনী কর্মকর্তারাও যেন নির্বাচনটিকে ছেড়ে দিয়েছেন।
নির্বাচন শুরু হতে না হতেই বিএনপি কেন নির্বাচন বর্জন করল? আওয়ামী লীগের অভিযোগ, আগাম পরিকল্পনা করেই এ কাজ করেছে বিএনপি। বাস্তবতা হচ্ছে, অদৃশ্য অনেক জবরদস্তি ও অনিয়মের অভিযোগের মধ্যেও সকালের দিকে ভোটের পরিস্থিতি ও ভোটারদের মধ্যে উৎসাহই দেখা গেছে। কিন্তু তাতে ছেদ ধরায় কাউন্সিলর প্রার্থীদের শক্তি দেখানোর মহড়া, বিভিন্ন কেন্দ্রে বুথে ঢুকে গণসিল মারা এবং এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়ক ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালনের মতো দৃশ্যমান ঘটনাগুলো। যেকোনোভাবে নির্বাচনে জেতার নীতি নিয়ে সরকার ও সরকারি দলের উদ্যোগে নির্বাচনকে নষ্ট করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়, তা চূড়ান্ত পরিণতি পায় বিএনপির নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে।
তিন সিটির নির্বাচনে সমতল মাঠ নিশ্চিত হবে বা ভোটের আম্পায়ারিং নিরপেক্ষ হবে, এমন আশা করে নিশ্চয় বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। কোনো খেলায় পক্ষপাতিত্ব হলে নিয়ম হচ্ছে খেলা শেষে অভিযোগ করা। নির্বাচনী খেলায় এই অভিযোগ তোলা যায় জনগণের কাছে। কিন্তু পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনে খেলার মাঝখান থেকে সরে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে খেলাটিকে ‘পরিত্যক্ত’ করা। বিএনপি আসলে খেলাটিকে পরিত্যক্ত করার পথই নেয়। যে ‘রাজনৈতিক কৌশলের’ অংশ হিসেবে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল, এর লক্ষ্যটি সম্ভবত ছিল তিন সিটির এই নির্বাচনটিকে পচিয়ে দেওয়া। বিএনপি এ ক্ষেত্রে অনেকটাই সফল হয়েছে। যেভাবেই হোক তিন তিনটি মেয়রের পদ পেয়ে সরকারি দল যেমন খুশি, তেমনি নির্বাচনটিকে অনেকটা ‘পরিত্যক্ত’ হিসেবে রূপ দিতে পেরে বিএনপিও বড় তৃপ্ত।
‘অরাজনৈতিক’ এই নির্বাচন নিয়ে দুই দলের ‘রাজনীতি’ ভালোই জমল! কিন্তু ২৮ এপ্রিল অনেক আশা আর উৎসাহ নিয়ে যাঁরা সকাল সকাল ভোট দিতে গেলেন, তাঁদের কাছে ব্যাপাটা এখন কেমন ঠেকছে? নিজেকে প্রতারিত মনে হচ্ছে না!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
[email protected]