বাংলাদেশে মিডওয়াইফ এখন স্বপ্ন নয়

সম্প্রতি স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞদের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো, বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র, আগারগাঁওয়ে। প্রথম দিন সারা দিনব্যাপী সিটিজির (যার মাধ্যমে গর্ভস্থ শিশুটি কেমন আছে, সেটা বোঝা যায়) ওপর বৈজ্ঞানিক অধিবেশন হয়ে গেল। সারা হলঘর-সম্মেলনকক্ষটি ভরে গিয়েছিল স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ও পোস্টগ্র্যাজুয়েট মেডিকেল ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, কখন তিনি আসবেন। তিনি এসেছেন সুদূর ইংল্যান্ড থেকে—অধ্যাপক স্যার সাবারতনাম আরুলকুমারন, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব গাইনোকলজি অ্যান্ড অবসটেট্রিকস–এর সভাপতি। আমার বিরল সৌভাগ্য হয়েছিল ওই অনুষ্ঠানটির সভাপতিত্ব করার। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল বাংলাদেশের নারী ও শিশুস্বাস্থ্য, মাতৃত্বজনিত সমস্যা ইত্যাদি বিষয়ে। আমি বর্তমানে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির মিডওয়াইফারি ডিপার্টমেন্টে কাজ করছি শুনে তিনি ভীষণ খুশি হলেন। উল্লেখ্য, স্যার আরুলকুমারন মিডওয়াইফারি বিষয়ে একটা পাঠ্যবইও সম্পাদনা করেছেন।
এতটা ভূমিকা দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো নারীস্বাস্থ্যের উন্নয়নে মিডওয়াইফদের অবদান এখন সারা পৃথিবীতেই স্বীকৃত। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন ২০১৫ সাল নাগাদ তিন হাজার দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফ তৈরি করার এবং এ জন্য বিশেষ প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। এই কাজে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি ডিএফআইডির অর্থায়নে আন্তর্জাতিক মানের মিডওয়াইফ তৈরি করছে, যা বাংলাদেশের মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছি।
এখন জেনে নিই মিডওয়াইফ কে এবং কী তাঁর কাজ? কোথায় তিনি কাজ করবেন? এগুলো নিয়ে সামান্য কিছু আলোচনা করতে চাই। মিডওয়াইফ হলেন এমন একজন দক্ষ ও শিক্ষিত সেবিকা, যিনি মা ও শিশুকে নিবিড়ভাবে সেবা দেবেন এবং যদি কখনো কোনো ধরনের জটিলতা হয়, সেটা বুঝতে পারবেন এবং প্রাথমিক সেবা দিয়ে সঠিক সময়ে সঠিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠিয়ে দেবেন। মা ও শিশুর সেবা ছাড়াও নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, নারী ও শিশুর পুষ্টি, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণে সহায়তা করবেন। সব মিলিয়ে মিডওয়াইফ নিজেকে গর্ভবতী মায়ের পাশে সবচেয়ে নিকটতম বন্ধু হিসেবে থাকবেন। তিনি গর্ভবতী মায়েদের বাসায় ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে উভয় স্থানেই তাঁর কর্মক্ষেত্র হিসেবে বিচরণ করতে পারবেন।
মিডওয়াইফ হিসেবে আবেদন করতে হলে তাঁকে এইচএসসি পাস হতে হবে। এসএসসি ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় কমপক্ষে ২.৫ জিপিএসহ কমপক্ষে জিপিএ-৫ হতে হবে। মোট তিন বছরের সম্পূর্ণ আবাসিক কোর্স। সেমিস্টার সিস্টেমে ছয় মাস পর পর পরীক্ষা হয়। বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফ কাউন্সিল কর্তৃক প্রণীত কারিকুলামসহ আরও কিছু মডিউল যোগ করা হয়েছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফ কোর্সে। বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল, অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) এবং ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, আফগানিস্তান ও ভারতের মিডওয়াইফদের সহায়তায় বেশ উন্নত মানের কারিকুলাম ও মোট ৪৭ মডিউল তৈরি করা হয়েছে। মিডওয়াইফারি কারিকুলাম তৈরি করার জন্য চারটি কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে।
প্রথমত, হতে হবে প্রয়োজন অনুযায়ী, দ্বিতীয়ত, ঠিক যেটুকু না শিখলেই নয়, মানে যা জানতেই হবে, তৃতীয়ত, হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন, এবং চতুর্থত, এটা কমিউনিটি ও ফ্যাসিলিটি বেইসড হতে হবে। এ ছাড়া আলাদাভাবে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
২০১২ সালে এর যাত্রা শুরু হয়। এটি পরিচালনা করার জন্য হাব এন্ড স্পোক মডেলকে অনুসরণ করা হয়েছে। যেখানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রবিন্দু (হাব) হিসেবে কাজ করছে। স্পোক হিসেবে বাংলাদেশের পাঁচটি ডিভিশনে ছয়টা এনজিওকে পার্টনার হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। যারা সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সাহায্য ও সহযোগিতা করছে। প্রতিটি পার্টনার সংস্থায় প্রথম ধাপে ৩০ জন করে ছাত্রী ভর্তি করা হয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে আরও ৩০ জন যোগ হয়ে বর্তমানে মোট ছাত্রীসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪১০-এ। এ বছরের শেষ দিকে প্রথম ব্যাচে ১৮০ জন ছাত্রী মিডওয়াইফ হিসেবে বের হবেন আশা করি। শুধু মিডওয়াইফ তৈরিই নয়, এর পাশাপাশি শিক্ষক ও ক্লিনিক্যাল প্রশিক্ষক তৈরি করা হচ্ছে। যাঁরা ছাত্রীদের পাঠদান ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। প্রতিটি সেমিস্টার শুরুর আগে দুই সপ্তাহের জন্য শিক্ষকদের ‘ইনটেনসিভ ট্রেনিং’ দেওয়া হয় যে পরবর্তী ছয় মাস ছাত্রীদের কী পাঠদান এবং কী পদ্ধতিতে দেওয়া হবে, তার ওপর। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য বাংলাদেশের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের সংস্থা (ওজিএসবি) ও আন্তর্জাতিক মিডওয়াইফরা এসে ট্রেনিং দিয়ে থাকেন।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্পূর্ণ শিক্ষা কর্মসূচি ও পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও অন্যান্য কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। সেখানে অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও নার্সরা সারাক্ষণ কাজ করে যাচ্ছেন। একাডেমিক ক্যালেন্ডার এমনভাবে পরিচালনা করা হয় যে একই দিনে একই সময়ে একই পাঠদান ও পরীক্ষাগুলো বাংলাদেশের ছড়িয়ে থাকা সাতটি সেন্টারে পরিচালিত হচ্ছে। এসব কাজ সারাক্ষণ পরিচালনা করে যাচ্ছেন সুযোগ্য ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ভিসি, উপদেষ্টা, মিডওয়াইফারি বিভাগের প্রধান, প্রকল্পের পরিচালক ও সব প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। সবচেয়ে সুখের কথা হলো, বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতাই এই শিক্ষা কার্যক্রমকে কোনোভাবেই ব্যাহত করতে পারেনি। প্রতিটি ক্লাস, পরীক্ষা নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই মিডওয়াইফরা একটি আলাদা ক্যাডার হিসেবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার মুকুটে একটি পালক হিসেবে সংযুক্ত হয়েছেন। পাঁচ-সাত বছরের মধ্যেই এর সুফল বাংলাদেশের মা ও শিশুরা পেতে থাকবে বলে আশা করি।
নতুন মিডওয়াইফরা, তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছি মাতৃসেবার এই জগতে। তোমরা হলে ‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’। তোমাদের জ্ঞানের আলো-সেবা-মেধা-শ্রমে এমন একটি বাংলাদেশ হবে, যেখানে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে কোনো মা ও শিশুর মৃত্যু হবে না। দুই দশক আগে ওজিএসবি আয়োজিত সেমিনারে আমি একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ পাঠ করেছিলাম, কমিউনিটি মিডওয়াইফ; ড্রিম অ্যান্ড রিয়ালিটি। তখন থেকেই এ দেশের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের স্বপ্ন ছিল মিডওয়াইফ তৈরি করার, এখন সেটা বাস্তবায়নের পথে। বলতে পারছি মিডওয়াইফ এখন স্বপ্ন নয় সত্যি! দ্বিধাহীনভাবে বলছি মিডওয়াইফ তোমরা এগিয়ে নিয়ে যাবে বাংলাদেশকে।
অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী: স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞ।