ধর্ষণ কি অপ্রতিরোধ্য?

বাংলা বর্ষবরণে টিএসসিতে নারী নির্যাতন ও মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের শিশু নির্যাতনের ঘটনা থেকে শুরু হয়ে মাস খানেক ধরে যেন ধর্ষণ-সংবাদের সুনামি চলছে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বাসে-মিনিবাসে-ট্রাকে-স্কুলে-মাঠে-পাহাড়ে ধর্ষণ-সংবাদ পাচ্ছি। গত কয়েক দিনের কিছু সংবাদ শিরোনাম: ঠাকুরগাঁওয়ে তরুণীকে ধর্ষণের পরে হত্যা, কিশোরগঞ্জে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী ধর্ষিত, পিরোজপুরে ছেলের বউকে ধর্ষণের অভিযোগে শ্বশুরের বিরুদ্ধে মামলা, মিরপুরে পাঁচ বছরের এক স্কুলশিশুকে ধর্ষণের দায়ে শিক্ষকের যাবজ্জীবন, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির পরে ছাত্রীকে জুতাপেটা, মসজিদে আরবি পড়তে গিয়ে ইমাম কর্তৃক ধর্ষিত তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। আদিবাসী নারী, প্রতিবন্ধী নারী, চার বছর বয়সী শিশু থেকে শুরু করে ৫৫ বছরের নারী, এমনকি মৃত শিশুও। এসব ধর্ষণ-সংবাদ, ধর্ষকদের ব্যাপারে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারার ব্যর্থতা এবং নতুনতর ধর্ষণ-সংবাদের মধ্য দিয়ে সমাজে প্রচলিত ধর্ষণের অপ্রতিরোধ্যতার মিথটিই যেন শক্তিশালী হচ্ছে। আমি শুধু বুঝতে চেষ্টা করছি, ধর্ষণ কি সত্যিই অপ্রতিরোধ্য?

দুই.
ধর্ষণ বিষয়ে একাডেমিক পড়াশোনা করতে গিয়ে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে, ধর্ষণ জৈবিক নয়, বরং সাংস্কৃতিক প্রশ্রয়ে নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত পুরুষতান্ত্রিক সহিংস অপরাধ। ১৯৬৯ সালে ১৫৬টি সমাজে ধর্ষণপ্রবণতার ওপর গবেষণা করে নৃতাত্ত্বিক প্যাগি স্যান্ডি দেখান যে ধর্ষণ কোনো অবশ্যম্ভাবী বিষয় নয়, বরং তাঁর গবেষণাধীন ৪৭ শতাংশ সমাজে ধর্ষণ নেই। ধর্ষণমুক্ত মডেল সমাজ হিসেবে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার আশান্তি, মবুতি পিগমি সমাজের উদাহরণ টেনেছেন। ধর্ষণমুক্ত সমাজে নারী-পুরুষ মানুষ হিসেবে সমান মর্যাদাবান, অর্থনৈতিক সাম্য আছে, আছে সামাজিক স্থিরতা, যেখানে পুরুষের দৈহিক শক্তিকে অপরিহার্য মনে করার মিথ প্রচলিত নয়। আশান্তি সমাজে নারীরা প্রভাবশালী সদস্য, সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে নারী পুরুষের মতোই সমানভাবে অংশ নেন। মবুতি সমাজের কোনো সদস্যই কারও ওপর প্রভুত্ব করে না, এমনকি জঙ্গলের ওপরেও না। নারীর সন্তানধারণ ও লালন করার ক্ষমতাকে দেওয়া হয় সর্বোচ্চ সম্মান। মূলত মাতৃতান্ত্রিক সমাজে ধর্ষণের ধারণাই অনুপস্থিত, যেমন সাম্প্রতিক সময়ে গারো নারী ধর্ষণের প্রতিবাদ সমাবেশে সঞ্জীব দ্রং জানিয়েছেন, গারো ভাষায় ধর্ষণ শব্দটি নেই।
পাশাপাশি ধর্ষণপ্রবণ সমাজের বৈশিষ্ট্য হলো সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেওয়া, শৈশব থেকেই পুরুষদের উগ্র, প্রতিযোগী হতে শেখানো, জনপরিসরে বা ধর্মীয় বিষয়ে নারীর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা না থাকা, নারীর বাস্তব-বুদ্ধি বিষয়ে পুরুষের প্রকাশ্য উপহাস, নারীর কাজকে অবমূল্যায়ন করা এবং এমনকি যৌন সম্পর্কে সম্মত না হলে জোর করাকেও পৌরুষ হিসেবে মহিমান্বিত করা। স্যান্ডি শেষ করেছেন এই বলে যে ধর্ষণ পুরুষ প্রকৃতির অনিবার্যতা নয়, তবে পুরুষ প্রকৃতির যে ইমেজ নির্মিত হয়েছে, তার ফলাফল। নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য করার এই ইমেজ প্রতিষ্ঠা করে সমাজ, সংস্কৃতি এবং ক্ষমতাকাঠামো।

তিন.
নারীর প্রতি সংঘটিত যেকোনো যৌন নির্যাতনের জন্য নারীকেই দায়ী করা আমাদের সংস্কৃতিতে প্রোথিত। বর্ষবরণে টিএসসির ঘটনায় নারীর সাজগোজ ও পোশাককেই দায়ী করেছেন শফী হুজুর। প্রিপারেটরি স্কুলে প্রথম শ্রেণির ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগের মুখে স্কুলের অন্যতম প্রভাবশালী কর্মকর্তা বলেছেন, ‘ফুল থাকলে মৌমাছি আসবে।’ আর সবশেষ উদাহরণ দেখা গেল হলিক্রস বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ধর্ম বিষয়ের প্রশ্নপত্রে। বৈশাখী মেলাসহ বিভিন্ন মেলায় ‘গেঞ্জি ও জিনসের প্যান্ট’ পরে যাওয়ার জন্যই যে মেয়েরা নানা ধরনের অসুবিধায় পড়ে এবং এ বছর বৈশাখী মেলায় ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো এড়ানোর উপায় হিসেবে পোশাক পরিচ্ছদে শালীনতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়ার মাধ্যমে বৈশাখে সংঘটিত ঘটনার জন্য নারীর পোশাক পরিচ্ছদকেই দায়ী করা হলো।
আমাদের রোমান্টিকতার ধারণা তৈরি হয়েছে অনিচ্ছুক নারীর পেছনে পুরুষের জোরপূর্বক অনুসরণের দৃশ্যসহ ‘চুমকি চলেছে একা পথে, সঙ্গী হলে দোষ কী তাতে’–জাতীয় গানের মাধ্যমে। গ্রামের মাতবরসমাজ ধর্ষিতকেই দোররা মারার বিধান চালু রাখে বলে ১৪ বছরের ধর্ষিত হেনাকে গ্রাম্য সালিসের দোররায় মরে যেতে হয়। ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষিতাকে বিয়ে দেওয়াকে সামাজিক সমাধান মনে করা হয়। আর রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত বাহিনী শুধু যে যৌন নির্যাতন বন্ধে ব্যর্থ হয় এমন নয়, বরং তাদের নির্যাতকের ভূমিকায় দেখার অজস্র উদাহরণ রয়েছে। ইয়াসমিনকে পুলিশ ধর্ষণ ও হত্যা করে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল, জেলের নিরাপত্তাবেষ্টনীতে ধর্ষণ করে হত্যা করেছিল সীমাকে, এবারের টিএসসির ঘটনায় পুলিশের সব পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়া এবং গুরুত্ব লঘু করার সব উদ্যোগ নিয়েছেন। যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের, বিশেষ করে ইসমত জাহানকে, নির্মমভাবে পিটিয়েছে এবং সবশেষে পুলিশের আইজি বর্ষবরণে টিএসসির যৌন নির্যাতনকে তিন-চারটি ছেলের ‘দুষ্টামি’ বলেছেন।

চার.
আমাদের রাজনীতি, সামাজিক ও আইনি ব্যবস্থা ধর্ষককে সুরক্ষা দেওয়ার সংস্কৃতি লালন করে চলেছে। অর্থনৈতিক বণ্টনসহ নারীর প্রতি নানা অবিচারের কাঠামো যে ব্যবস্থায় নিহিত, সেখানে ধর্ষণ অনিবার্য। এই সংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যান করে নতুন সংস্কৃতি নির্মাণ করা সম্ভব না হলে এক-আধটি বিচার নামের প্রহসন দিয়ে এই সর্বমাত্রিক যৌন সহিংসতাকে দমন করা যাবে না। ধর্ষণ কেউ সাক্ষী রেখে করে না, ফলে সামাজিক নিন্দার বাধা অতিক্রম করে কেউ ধর্ষণের বিচার চাইলেই বর্তমান বিচারকাঠামোতে ন্যায্য বিচার পাওয়া সম্ভব না–ও হতে পারে। প্রয়োজন সামাজিক প্রতিরোধ।
ছাত্রদের প্রতিরোধ জারি ছিল বলেই টিএসসির ঘটনাটিকে সম্পূর্ণভাবে চেপে যাওয়া সম্ভব হয়নি পুলিশের পক্ষে, সম্ভব হয়নি প্রিপারেটরি স্কুলের ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়া। প্রতিরোধ ছিল বলেই গারো নারীকে ধর্ষণকারীদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে রাষ্ট্র বাধ্য হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আদিবাসী ছাত্রীকে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত ছাত্রদের বহিষ্কার করতে বাধ্য হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। প্রতিরোধের কারণেই হলি ক্রস স্কুল কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েছে দুঃখ প্রকাশ করতে। গারো মেয়েটির ঘুরে দাঁড়ানোও একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। যে দুজনকে ধরা গেছে এবং নিজেরা অপরাধ স্বীকার করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
প্রতিরোধ চলুক ধর্ষণ আইনে যেসব ফাঁক রয়েছে, সেসব সংশোধনের জন্য। প্রতিরোধ হোক শিক্ষা কার্যক্রমের যেখানেই নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক ধারণা বহাল রয়েছে, সেসব পাল্টে দেওয়ার। সামাজিক সচেতনতা তৈরিতে গণমাধ্যম বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ধর্ষণ বিষয়ে ‘নারীর সর্বস্ব হারানো’র পুরুষতান্ত্রিক মিথটিকে পাল্টে ‘ধর্ষকের রক্ষা নাই’ মর্মে বিকল্প মিথ নির্মাণের মধ্য দিয়েই ধর্ষণকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। এই প্রতিরোধে রাষ্ট্রের কোনো এজেন্সি বিরোধিতা করলে পাল্টা আঘাত সেখানেও হোক।
ধর্ষণ অপ্রতিরোধ্য নয়, অপ্রতিরোধ্য হলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষের জাগরণ। এই জনপদে ধর্ষণ সব সময়েই ছিল, খবরে কম আসত। ধর্ষণের খবরগুলো প্রকাশিত হচ্ছে, এটি প্রথম প্রতিরোধ। ধর্ষিত নারী রুখে দাঁড়াচ্ছেন, এটি পরবর্তী প্রতিরোধ। নারী-পুরুষনির্বিশেষে সোচ্চার হচ্ছেন, এটিই চূড়ান্ত প্রতিরোধ। ভেঙে যাচ্ছে ধর্ষণের অপ্রতিরোধ্যতার মিথ।
ড. কাবেরী গায়েন: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।