স্নোডেন কি সত্যিই 'বিশ্বাসঘাতক'?

স্নোডেন–সমর্থকদের সমাবেশ
স্নোডেন–সমর্থকদের সমাবেশ

রুপার্ট মারডকের মালিকানাধীন ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য সানডে টাইমস গত রোববার প্রথম পাতায় একটা বড় প্রতিবেদন প্রকাশ করে পশ্চিমা সংবাদজগতে বেশ হইচই ফেলে দিয়েছে। ‘ব্রিটিশ স্পাইজ বিট্রেইয়েড টু রাশানস অ্যান্ড চায়নিজ’ শিরোনামের প্রতিবেদনটির মূল বক্তব্য হলো, রুশ ও চীনা কর্তৃপক্ষ আমেরিকান জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসএ) হুইসেল ব্লোয়ার এডওয়ার্ড স্নোডেনের চুরি করা ‘টপ সিক্রেট’ শ্রেণির বিপুল তথ্যভান্ডার হস্তগত করেছে। সেসব তথ্য থেকে তারা জেনে গেছে ব্রিটিশ ও আমেরিকান গোয়েন্দাদের নামধাম, অবস্থান এবং তাঁরা কী পদ্ধতিতে কাজ করেন। ফলে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই সিক্স তাদের গুপ্তচরদের প্রাণের নিরাপত্তার স্বার্থে শত্রু মনোভাবাপন্ন দেশে কর্মরত একাধিক গোয়েন্দা মিশন থেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে এবং সংস্থাটির গোয়েন্দা কার্যক্রমে বিরাট সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।
এই প্রতিবেদনের তথ্যগুলো সত্য হলে তার তাৎপর্য বিরাট। প্রথমত, এর মাধ্যমে প্রমাণিত হবে যে স্নোডেন তাঁর স্বদেশের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার বিপুল পরিমাণ টপ সিক্রেট তথ্য চুরি করে শত্রুপক্ষের হাতে তুলে দিয়েছেন, অথবা তথ্যগুলো শত্রুপক্ষের হস্তগত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ ইত্যাদি যেসব অভিযোগপূর্ণ অভিধায় তাঁকে আমেরিকার কর্তাব্যক্তিরা অভিহিত করে আসছেন, স্নোডেন তা-ই প্রমাণিত হবেন। ফলে স্বদেশে স্নোডেন তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা হারাবেন। যাঁরা তাঁকে নাগরিক স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সুরক্ষার পক্ষের এক লড়াকু সৈনিক ও জাতীয় বীর বলে মনে করেন, তাঁরা তাঁকে ঘৃণা করবেন। আর সবচেয়ে গুরুতর কথা হলো, তাঁর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত গুপ্তচরবৃত্তি-সংক্রান্ত আইনের অধীনে যে মামলা করা হয়েছে, তাতে তিনি দোষী সাব্যস্ত হবেন, সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হলে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হবে।
এটা হচ্ছে একটা দিক, যা শুধু ব্যক্তি স্নোডেনের পরিণতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। অন্য দিকটা এর থেকে অনেক বড়। সেটা হলো, স্নোডেনের ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ সত্য বলে প্রমাণিত হলে আমেরিকা ও ব্রিটেনের সরকার ও রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক সুবিধা হবে। স্নোডেনের তথ্য ফাঁসের পর থেকে উভয় দেশে প্রবল জনমতের চাপে গোয়েন্দা কর্মসূচি সংস্কার করার যেসব উদ্যোগ শুরু হয়েছে, সেগুলো ঠেকিয়ে দেওয়ার পক্ষে অনেকে যুক্তি খুঁজে পাবেন। তাঁরা বলতে পারবেন, সংস্কারের প্রয়োজন নেই, বরং স্নোডেনের মতো ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ যেন আর কেউ করতে না পারে, সে লক্ষ্যে গোয়েন্দা কার্যক্রম আরও প্রবল ও প্রসারিত করা দরকার।
কিন্তু সানডে টাইমস-এর প্রতিবেদনটিতে এমন কোনো সাক্ষ্য–প্রমাণ নেই, যার দ্বারা প্রমাণিত হতে পারে যে স্নোডেন সত্যিই বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে হইচই হচ্ছে প্রধানত সে কারণেই। প্রথমত, সানডে টাইমস প্রতিবেদনটিতে যেসব তথ্যসূত্র উল্লেখ করেছে, তাঁরা সবাই ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক’ ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা: কেউ ডাউনিং স্ট্রিট অর্থাৎ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের, কেউ স্বরাষ্ট্র দপ্তরের, কেউ নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর। সূত্রদের কেউ বলেছেন, রুশ ও চীনারা স্নোডেনের তথ্যভান্ডারের গোপন কোড ভেঙে (হ্যাক করে) সেগুলো হস্তগত করেছে এবং পড়েছে। কেউ মন্তব্য করেছেন, রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন বিনা প্রতিদানে স্নোডেনকে রাশিয়ায় আশ্রয় দেননি। অর্থাৎ, এই সূত্র বলতে চেয়েছে, স্নোডেন নিজেই গোপন তথ্যভান্ডারটি রুশদের হাতে তুলে দিয়েছেন এবং সে কারণেই রাশিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছেন। স্নোডেন যে আগাগোড়াই দাবি করে আসছেন তিনি তথ্যগুলো সংবাদমাধ্যমকে ছাড়া আর কাউকে দেননি এবং সংবাদমাধ্যমকে দেওয়ার পর তিনি নিজের কাছে কোনো কপিও রাখেননি—সানডে টাইমস এ কথা উল্লেখ করেনি।
সানডে টাইমস ওই প্রতিবেদনে শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের বক্তব্যই তুলে ধরেছে, তাঁদের কাছে কোনো সাক্ষ্য–প্রমাণ দাবি করেনি, তাঁদের বক্তব্যগুলোর যথার্থতা যাচাই করেনি। যে কর্মকর্তা বলেছেন, রুশ ও চীনারা হ্যাক করে স্নোডেনের তথ্যভান্ডার নিজেদের ব্যবহারযোগ্য করেছে, সানডে টাইমস-এর প্রতিবেদকেরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেননি তিনি এটা কীভাবে জানতে পেরেছেন। সানডে টাইমস দাবি করেছে, স্নোডেন মোট ১৭ লাখ গোপনীয় তথ্য চুরি করে ডাউনলোড করেছেন, কিন্তু এই দাবির পক্ষেও কোনো সাক্ষ্য–প্রমাণ দেয়নি। বরং এনএসএর পক্ষ থেকে একাধিকবার বলা হয়েছে, তারা নিজেরাই জানে না স্নোডেন কী পরিমাণ গোপনীয় তথ্য নিজের ল্যাপটপে ডাউনলোড করে থাকতে পারেন। আরেক কর্মকর্তা বলেছেন, স্নোডেনের হাতে রক্তের দাগ লেগে আছে, অর্থাৎ স্নোডেনের তথ্য ফাঁসের ফলে ব্রিটিশ বা মার্কিন কোনো গোয়েন্দা শারীরিকভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু আরেক কর্মকর্তা বলেছেন, কেউ আক্রান্ত হয়েছেন এমন তথ্য তাঁরা পাননি।
গার্ডিয়ান-এর সাবেক মার্কিন প্রতিবেদক গ্লেন গ্রিনওয়াল্ড, যিনি স্নোডেনের দেওয়া গোপন তথ্যভান্ডারের ওপর ভিত্তি করে ২০১৩ সালে ওই পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রতিবেদন লিখেছিলেন, তিনি সানডে টাইমস-এর প্রতিবেদনটিকে নিকৃষ্ট ধরনের সাংবাদিকতার দৃষ্টান্ত বলে অভিহিত করেছেন। তিনি দ্য ইন্টারসেপ্ট নামের এক অনলাইন পত্রিকায় লিখেছেন, সানডে টাইমস-এর প্রতিবেদনটি মিথ্যায় ভরপুর, এটা স্নোডেনের মুখে কালিমা লেপনের উদ্দেশ্যে মিথ্যা প্রচারণা। তিনি তাঁর দীর্ঘ লেখাটিতে সানডে টাইমস-এর ওই প্রতিবেদনের অন্তঃসারশূন্যতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। গার্ডিয়ানও সানডে টাইমস-এর প্রতিবেদনটি সম্পর্কে বেশ কয়েকটি গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করেছে, যা থেকে মনে হয়, রুপার্ট মারডকের এই পত্রিকাটি ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে যোগসাজশ করে স্নোডেনকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে তুলে ধরার অপচেষ্টা করেছে। প্রতিবেদনটির শিরোনামের মধ্য দিয়ে সানডে টাইমস স্নোডেনকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলেছে, কিন্তু এর পক্ষে জোরালো সাক্ষ্য–প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট বা গার্ডিয়ান-এর মতো কোনো সংবাদপত্র স্পষ্টতই এমন আচরণ করত না। বরং এই পত্রিকাগুলো স্নোডেনের তথ্য ফাঁসের পেছনে নাগরিক অধিকার ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সুরক্ষার তাগিদের কথাই তুলে ধরে আসছে, এবং বলার চেষ্টা করছে যে স্নোডেনের তথ্য ফাঁস একটা বড় ‘পাবলিক সার্ভিস’।

>সানডে টাইমস ব্রিটিশ সরকারের নিজস্ব প্রোপাগান্ডা মেশিনের ভূমিকা নিয়ে এডওয়ার্ড স্নোডেনের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করার যে অপচেষ্টা করেছে, তা সফল হওয়ার নয়

সানডে টাইমস-এর প্রতিবেদনটি যে দুরভিসন্ধিমূলক, এটি প্রকাশের সময়টা লক্ষ করলেও তা মনে হয়। স্নোডেন তাঁর চুরি করা তথ্যভান্ডার মস্কো পৌঁছার পরেই রুশদের হাতে তুলে দিয়েছেন এমন অভিযোগ উঠেছিল আজ থেকে অন্তত ১৮ মাস আগেই। তখন স্নোডেন এ অভিযোগ সম্পূর্ণভাবে নাকচ করে দিয়ে বলেছিলেন, সাংবাদিকদের হাতে তথ্যভান্ডারটি তুলে দেওয়ার পর তাঁর কাছে আর এমন কিছু নেই, যা তিনি রুশদের দিতে পারেন। দেড় বছর পর সানডে টাইমস আবার সেই পুরোনো অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ব্রিটেনের সরকারি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদন ফেঁদে বসল কেন?
ব্রিটেনে যাঁরা নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সুরক্ষার পক্ষে আন্দোলন করছেন, তাঁরাও এই প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ, ব্রিটেনে এখন গোয়েন্দা নজরদারিব্যবস্থার সংস্কারের দাবি উঠেছে; কিছুদিন আগেই ডেভিড অ্যান্ডারসন কিউসি নামে এক স্বাধীন পর্যালোচক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের নির্দেশে ব্রিটেনে প্রচলিত সন্ত্রাসবাদ দমনসংক্রান্ত আইনগুলো পর্যালোচনা করে প্রায় পৌনে ৪০০ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদন পেশ করেছেন, যেখানে তিনি বিদ্যমান আইনগুলোকে অগ্রহণযোগ্য ও অগণতান্ত্রিক বলে মন্তব্য করে বেশ কিছু সংস্কারের সুপারিশ করেছেন। এতে ব্রিটিশ সরকার অসুবিধায় পড়েছে, কারণ তারা আইনগুলো সংস্কার করতে চায় না। গোয়েন্দা নজরদারি বিষয়ে একটা বিল আসছে শরতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে উঠবে, তখন সংস্কারের দাবিতে প্রবল বিতর্ক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সানডে টাইমস-এর ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পেছনে দুরভিসন্ধি খুঁজে পাচ্ছেন অনেকেই।
ব্রিটেনের ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে সানডে টাইমস স্নোডেনের বিরুদ্ধে যে পুরোনো অভিযোগগুলো নতুন করে উত্থাপন করেছে, সেগুলো আমেরিকায় উঠলে একটু কম অবাক হতাম। কারণ, স্নোডেনের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা আমেরিকায় হওয়াই বেশি যুক্তিযুক্ত। তিনি ওই দেশের নাগরিক, বিশ্বাসঘাতকতা করে থাকলে ওই দেশের সরকারের সঙ্গে করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে মামলা আছে আমেরিকাতেই এবং সুযোগ পেলে তাঁকে শূলে চড়াবে আমেরিকাই। কিন্তু সানডে টাইমস-এর এই প্রতিবেদনের তথ্যগুলোর ব্যাপারে হোয়াইট হাউস এখন পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করেনি, দেশটির মূলধারার সংবাদমাধ্যমেও এটা নিয়ে তেমন হইচই নেই। সম্ভবত আমেরিকায় বেশির ভাগ মানুষ ধরে নিয়েছে, সানডে টাইমস কোনো ট্যাবলয়েড পত্রিকার মতো একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টির চেষ্টা করেছে, যার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করার দরকার নেই।
সানডে টাইমস ব্রিটিশ সরকারের নিজস্ব প্রোপাগান্ডা মেশিনের ভূমিকা নিয়ে এডওয়ার্ড স্নোডেনের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করার যে অপচেষ্টা করেছে, তা সফল হওয়ার নয়। স্নোডেন যখন হংকংয়ে অবস্থান করছিলেন, তখন নিন্দুকেরা বলেছিলেন তিনি চীনাদের গুপ্তচর, তথ্যভান্ডারটি তিনি চীনাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। তারপর তিনি যখন মস্কো ও কিউবা হয়ে একুয়েডরে যাওয়ার পথে তাঁর দেশ তাঁর পাসপোর্ট বাতিল ঘোষণা করার পরে তিনি মস্কো বিমানবন্দরে আটকে গিয়ে রাশিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলেন, তখন বলা হলো, তিনি রুশদের গুপ্তচর, ওই তথ্যভান্ডার রুশদের হাতে তুলে দেওয়ার বিনিময়ে রাশিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতে প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছে গেছেন। সুতরাং সানডে টাইমস নতুন কোনো গল্পই আর বানাতে পারেনি; সে শুধু নিজের এবং সেই সঙ্গে কিছুটা ব্রিটিশ সাংবাদিকতারও ভাবমূর্তির ক্ষতি করেছে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
[email protected]