স্বস্তির সময়ে 'বিশেষ আইন' কেন?

অলংকরন: মাসুক হেলাল
অলংকরন: মাসুক হেলাল

সেই ২০১০ সাল থেকে বিদ্যুৎ খাতের জন্য একটি বিশেষ আইন কার্যকর রয়েছে। এ পর্যন্ত দুই দফা এই আইনের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৪ সালে বাড়ানো হয়েছে আরও চার বছরের জন্য। ভারতের দুটি কোম্পানির সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যাপারে সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার পর এই ‘বিশেষ আইনের’ বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে। ভারতীয় কোম্পানি দুটির সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে এই আইনের আওতায়। প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, এ ধরনের বিশেষ আইনের আওতায় তা করা যায় কি না। বা এর চেয়েও মৌলিক প্রশ্ন—এখন এই আইনের আদৌ দরকার আছে কি না।
২০০৯-১০ সালে দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি কী ছিল, সেটা আমাদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। যেভাবেই হোক, বিদ্যুৎ উৎপাদনের এমন একটি অবস্থান থেকে সরকার ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) বিল, ২০১০’ সংসদে উত্থাপন করে। লক্ষ্য হচ্ছে, ‘কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও গৃহস্থালি কাজের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ ও জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করিবার লক্ষ্যে উহাদের উৎপাদন বৃদ্ধি, সঞ্চালন, পরিবহন ও বিপণনের নিমিত্ত দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের সুবিধার্থে এবং প্রয়োজনে বিদেশ হইতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি আমদানি করিবার পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন এবং জ্বালানি-সম্পর্কিত খনিজ পদার্থের দ্রুত আহরণ ও ব্যবহারের নিমিত্ত অনুসরণীয় বিশেষ বিধান’ প্রণয়ন। সংসদে তা পাস হয়। তখন আইনটি হয়েছিল দুই বছরের জন্য।
যেকোনো ‘দ্রুত’ ও ‘বিশেষ’ আইনের নানা বিপদ থাকে। এ ধরনের আইনে দায়মুক্তির যে বিষয় থাকে, তা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির নীতির সঙ্গে মেলে না। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি বা ভাগ-বাঁটোয়ারার আশঙ্কা থাকে জোরালো। বিদ্যুৎ খাতের এই বিশেষ আইনে ‘সরকার ও সরকারি মালিকানাধীন বা নিয়ন্ত্রণাধীন সব প্রতিষ্ঠান, এই আইনের অধীন বিদ্যুৎ বা জ্বালানির দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি, সঞ্চালন, পরিবহন ও বিপণন-সংক্রান্ত যেকোনো পরিকল্পনা গ্রহণ বা বিদেশ হইতে বিদ্যুৎ বা জ্বালানি আমদানি ও উহার সঞ্চালন, পরিবহন ও বিপণন-সংক্রান্ত যেকোনো পরিকল্পনা গ্রহণ ও উহার দ্রুত বাস্তবায়নের নিমিত্ত যেকোনো প্রস্তাব গ্রহণ’ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে বলা আছে, ‘এই আইনের অধীনে কৃত বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্য, গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোনো আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতের নিকট প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’ বা সবকিছুকেই ‘সরল বিশ্বাসে কৃত’ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। ‘এই আইন বা তদাধীন প্রণীত বিধি, সাধারণ বা বিশেষ আদেশের অধীন দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে কৃত বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্যের জন্য কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো প্রকার আইনগত কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না।’
এ ধরনের বিধানসহ ২০১০ সালে বিলটি যখন সংসদে ওঠে, তখন আইনজীবী শাহদীন মালিক এ ধরনের বিধানকে সামরিক আইনের বিধিবিধানের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘এটা দুঃখজনক যে আমাদের সংসদ সামরিক আইনের মডেলে আইন প্রণয়ন করছে।’ (দ্য ডেইলি স্টার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১০)। দুই বছরের জন্য পাস হওয়া সেই আইন প্রথম দফায় আরও দুই বছর বেড়েছে, দ্বিতীয় দফায় বেড়েছে আরও চার বছর। শুরুতে এই আইনের আওতায় ছোট ছোট ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়েছে। আর এখন চার হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের সমঝোতা স্মারক সই হচ্ছে!
‘বিশেষ’ আইন করা হয় বিশেষ পরিস্থিতিতে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এই আইন যখন করতে হয়েছিল, তখন আসলেই ‘বিশেষ পরিস্থিতি’ বিরাজ করছিল। কমবেশি সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে সর্বোচ্চ উৎপাদনক্ষমতা ছিল তিন হাজার ২০০ মেগাওয়াট। রাজধানী ঢাকায় তখন ১২ ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের রেকর্ড আছে। এমন পরিস্থিতিতে এই বিশেষ আইনের লক্ষ্য ছিল দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন। সমালোচনা থাকলেও এই আইন কাজে দিয়েছে। সরকারের পক্ষে দ্রুত অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়েছে। সেই দুঃসহ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেছে।
আগেই বলেছি, ‘দ্রুত’ ও ‘বিশেষ’ আইনের কিছু বিপদ থাকে। দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গেলেও বিশেষ আইনের সুযোগ নিয়ে অনেক অযোগ্য উদ্যোক্তা বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ পেয়েছেন। নিয়ম মেনে ও নির্দিষ্ট সময়ে তাঁরা বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেতে পারেননি। ফলে ‘দ্রুত’ উৎপাদনে যাওয়ার লক্ষ্যও সব ক্ষেত্রে পূরণ হয়নি। পরিস্থিতি বিবেচনায় এসব ‘বিপদ’ মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। এসবের বিনিময়ে আমরা লোডশেডিং থেকে মুক্তি পেয়েছি। এই যে স্বস্তির পরিস্থিতি, এর কৃতিত্ব নিশ্চয়ই সরকারের। কিন্তু অবস্থা যদি সত্যিই ‘স্বস্তির’ হয়, তবে ‘বিশেষ’ আইনটির এখন কী দরকার!
বিশেষ আইন বা ব্যবস্থা সব সময়ই স্বল্পমেয়াদি বিষয়। বিদ্যুৎ খাতের ২০০৯-১০ সালের সেই ‘বিশেষ পরিস্থিতি’ এখন আর নেই। ফলে দফায় দফায় এই আইনের মেয়াদ বাড়ানো এবং এখনো সেই আইন কার্যকর রেখে বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির ক্ষেত্রে তা কাজে লাগানোর কোনো সুযোগ নেই। সাধারণভাবে বললে, এ আইনের মূল ব্যাপারটি ছিল টেন্ডার এড়ানো ও সময় বাঁচানো। এখন সেই পরিস্থিতি নেই। বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে সরকারের এখন একটি মহাপরিকল্পনা। সেখানে ২০৩০ সাল নাগাদ ৩৮ হাজার মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। কোন প্রাথমিক জ্বালানি থেকে কত শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে, তারও নির্দেশনা রয়েছে। এসব কোনো স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা নয় যে এটা বাস্তবায়ন করতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিহীন এই বিশেষ আইনের দরকার পড়বে।
আর সবচেয়ে বড় কথা, দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি আমরা সামাল দিয়ে এসেছি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এখন আমরা যে বাস্তবতার মধ্যে রয়েছি, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিদ্যুৎ ও জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ড. তামিমের ভাষায় তা হচ্ছে ‘লিস্ট কস্ট এক্সপানশন’, অর্থাৎ সাশ্রয়ী সম্প্রসারণ। কুইক রেন্টালের মতো দামি ও ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিবর্তে সাশ্রয়ী ও বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ। এগুলো আর যা-ই হোক, ‘দ্রুত’ বিদ্যুৎ উৎপাদনের আওতায় পড়বে না। ভারতের যে দুটি কোম্পানির সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে, এই ‘বিশেষ’ ও ‘দ্রুত’ আইনের আওতায় তার ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় প্রকাশ পেয়েছে প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে (১০ জুন ২০১৫)। কিন্তু যদি তা বাস্তবায়নের দিকেও এগোয়, তার পরও সবকিছু ঠিক করে প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেতে চার থেকে পাঁচ বছর সময় লাগবে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র ‘দ্রুত’ বিদ্যুৎ উৎপাদন আইনের আওতায় পড়ে কীভাবে?
বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভারতের দুই কোম্পানির সঙ্গে সই হওয়া সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী রিলায়েন্স গ্রুপ তৈরি করবে আমদানি করা এলএনজি (তরল গ্যাস)–নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র। চার ইউনিটে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে তিন হাজার মেগাওয়াট। অন্যদিকে, আদানি গ্রুপ তৈরি করবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। দুই ইউনিটে মোট উৎপাদন হবে ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০ সালে যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে, তার ২৫ ভাগ গ্যাস থেকে হওয়ার কথা। রিলায়েন্সের সঙ্গে সমঝোতার ক্ষেত্রে হয়তো এ বিষয়টি বিবেচনায় ছিল। কিন্তু আমদানি করা এলএনজিকে আবার গ্যাসে রূপান্তর করে বিদ্যুৎ উৎপাদন কতটা সাশ্রয়ী হবে, সেটা অবশ্যই বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। বিশ্ববাজারে তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ কমে যাওয়ায় এলএনজির দামও কমেছে। কিন্তু বর্তমান দামের ওপর ভিত্তি করে কোনো সিদ্ধান্তে আসা কঠিন। বছর খানেক ধরে তেলের দাম কম থাকলেও ২০১৬ সাল থেকে আবার তেলের দাম বাড়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ৪ জুন ভিয়েনায় ওপেক তেলমন্ত্রীদের এক বৈঠকের সূত্রে তেল ও গ্যাসশিল্প-সংক্রান্ত নিউজ পোর্টাল রিগজোন এমনই ইঙ্গিত দিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, বর্তমান দামেই ভারতের অন্ধ্রে তৈরি করা রিলায়েন্সের এলএনজি-নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন খরচ এত বেশি পড়ছে যে তা চালানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশে এ ধরনের প্রকল্প পোষাবে কীভাবে?
সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টি মাথায় রেখেই মহাপরিকল্পনায় ৫০ ভাগ বিদ্যুতের উৎপাদন কয়লাভিত্তিক করার কথা বলা হয়েছে। আদানির সঙ্গে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সমঝোতা স্মারকের বিষয়টি সেই বিবেচনায় মহাপরিকল্পনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। গুজরাটভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটি এখন ভারতের বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। গত মে মাসের হিসাব অনুযায়ী, আদানি এখন ভারতে কয়লাভিত্তিক মোট ১০ হাজার ৪৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।
রিলায়েন্স বা আদানি—এ ধরনের যেকোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যাপারে সমঝোতায় যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প কী করে বিশেষ আইনের আওতায় (যা ‘সরল বিশ্বাসে কৃত’ হিসেবে বিবেচিত হবে) বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়, যা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির কোনো বালাই থাকবে না!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
[email protected]