মাহে রমজানে তাওরাত অবতরণ

ধর্ম
ধর্ম

আল্লাহর নবী হজরত মুসা (আ.)-এর কাছে কয়েক হাজার বছর আগে রমজান মাসের ৬ তারিখে কয়েকখানা পাথরের ফলকে উৎকীর্ণ অবস্থায় আসমানি কিতাব ‘তাওরাত’ নাজিল করা হয়। আল্লাহর আহ্বানে হজরত মুসা (আ.) তুর পাহাড়ে গমন করে প্রথমে ৩০ দিন একটানা রোজা ও ইতিকাফ পালন করেন, পরে আরও ১০ দিন একইভাবে সিয়াম ও ইতিকাফ পালন করেন। এভাবে ৪০ দিন পূর্ণ হলে তাঁর কাছে ‘তাওরাত’ অবতীর্ণ হয়। হজরত মুসা (আ.) তুর পাহাড়ে গিয়েছিলেন ২৭ রজব এবং ৬ রমজান তাঁর অবস্থান ৪০ দিন পরিপূর্ণ হলে তিনি তাওরাতপ্রাপ্ত হন। হজরত মুসা (আ.)-এর সঙ্গে আল্লাহর সরাসরি বাক্যালাপ হওয়ায় তিনি ‘কালিমুল্লাহ’ খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘মুসার সঙ্গে আল্লাহ সাক্ষাৎ বাক্যালাপ করেছিলেন।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৬৪)
হজরত মুসা (আ.) আল্লাহকে দেখার জন্য জোর আবেদন-নিবেদন করলে তিনি ঘোষণা করেন, ‘মুসা যখন আমার নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হলো এবং তার প্রতিপালক তার সঙ্গে কথা বললেন, তখন সে বলল: “হে আমার প্রতিপালক! আমাকে দর্শন দাও! আমি তোমাকে দেখব।” তিনি বললেন: “তুমি আমাকে কখনোই দেখতে পাবে না। বরং তুমি পাহাড়ের প্রতি লক্ষ করো, তা স্বস্থানে স্থির থাকলে তুমি আমাকে দেখবে।” যখন তার প্রতিপালক পাহাড়ে জ্যোতি প্রকাশ করলেন, তখন তা পাহাড়কে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিল আর মুসা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ল। যখন সে জ্ঞান ফিরে পেল, তখন বলল: মহিমাময় তুমি, আমি অনুতপ্ত হয়ে তোমারই দিকেই প্রত্যাবর্তন করলাম এবং মুমিনদের মধ্যে আমিই প্রথম।’ (সূরা আল-আরাফ, আয়াত: ১৪৩)
হজরত মুসা (আ.)-এর হাতে যে আশ্চর্যজনক লাঠি থাকত, সেটি অনেক মুজিজা গুণসমৃদ্ধ ছিল। ফিরআউনের জাদুকরদের জাদুর সাপ সেই লাঠি সাপে পরিণত হয়ে খেয়ে ফেলেছিল। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘মুসার প্রতি আমি প্রত্যাদেশ করলাম, তুমিও তোমার লাঠি নিক্ষেপ করো, সহসা তা তাদের অলীক সৃষ্টিগুলোকে গ্রাস করতে লাগল।’ (সূরা আল-আরাফ, আয়াত: ১১৭) ওই লাঠি লোহিতসাগরে বিশাল পথ করে দিয়েছিল, যা দিয়ে ফিরআউনের কবল থেকে উদ্ধারকৃত বনি ইসরাইলকে নিয়ে হজরত মুসা (আ.) নিরাপদে নীল নদের ওপারে চলে যান। এই লাঠি অন্ধকারে আলো দিত, অনাবৃষ্টির সময় পানি বর্ষণ করত, ফলবান বৃক্ষ হয়ে যেত; দুধ, মধু ও সুগন্ধি জোগান দিত, সমুদ্রে দিক নির্ণয় করত।
হজরত মুসা (আ.) যখন রিসালাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন তিনি প্রধানত ১০টি বিধান বা ধর্মীয় অনুশাসন লাভ করেছিলেন আর তা হচ্ছে: ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, মূর্তি তৈরি কোরো না, মাতা-পিতার অবাধ্য হবে না, নরহত্যা কোরো না, ব্যভিচার কোরো না, প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে কোনোরূপ মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ো না, প্রতিবেশীর পরিবারের প্রতি অন্যায় লালসা কোরো না’ প্রভৃতি। হজরত মুসা (আ.) ও হজরত খিজির (আ.)-এর সাক্ষাৎ ও বিশেষ জ্ঞান শিক্ষালাভ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘অতঃপর তারা (মুসা ও তাঁর সঙ্গী) আমার বান্দাদের মধ্যে এমন একজনের (খিজিরের) সাক্ষাৎ পেল, যাকে আমি আমার কাছ থেকে অনুগ্রহ দান করেছিলাম এবং আমার কাছ থেকে শিক্ষা দিয়েছিলাম এক বিশেষ জ্ঞান। মুসা তাকে (খিজিরকে) বলল, “সত্য পথের যে জ্ঞান আপনাকে দান করা হয়েছে, তা থেকে আমাকে শিক্ষা দেবেন, এ শর্তে আমি আপনার অনুসরণ করব কি?”’ (সূরা আল-কাহফ, আয়াত: ৬৫-৬৬)
পবিত্র মাহে রমজানে আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক জাতির স্বীয় মাতৃভাষাকে যথাযথ মর্যাদা প্রদান করে নিজ নিজ জাতির নিজস্ব ভাষায় আসমানি কিতাব নাজিল করেছেন। হজরত মুসা (আ.)-এর সম্প্রদায়ের মাতৃভাষা ছিল হিব্রু বা ইবরানি, এ ভাষায় ‘তাওরাত’ অবতীর্ণ হয়। হিব্রু ভাষায় ‘তাওরাত’কে বলা হয় ‘তোরা’। নবী-রাসুলগণের মাতৃভাষায় আসমানি কিতাব নাজিলের গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তাঁর স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎ পথে পরিচালিত করেন।’ (সূরা ইবরাহিম, আয়াত: ৪)

>নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘রমজান উপলক্ষে আমার উম্মতকে পাঁচটি বস্তু দেওয়া হয়েছে, যা পূর্ববর্তী উম্মতকে দেওয়া হয়নি।’

হজরত মুসা (আ.)-এর সমকালেও রোজা রাখার বিধান ছিল। ইহুদিদের ওপর সপ্তাহে প্রতি শনিবার আর বছরের মধ্যে মহররমের ১০ তারিখে আশুরার দিন এবং অন্যান্য সময় বিশেষ উপলক্ষে রোজা ফরজ ছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরত করে ইহুদিদের আশুরার দিনে রোজা অবস্থায় পেলেন। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজ তোমরা কিসের রোজা করছ?’ তারা বলল, ‘এটা সেই মহান দিবস, যেদিন আল্লাহ তাআলা হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর সম্প্রদায়কে (বনি ইসরাইল) মুক্ত করেছিলেন এবং ফিরআউন ও তার জাতিকে নীল নদে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। ফলে শুকরিয়াস্বরূপ হজরত মুসা (আ.) ওই দিন রোজা রেখেছিলেন, তাই আমরা আজ রোজা করছি।’ এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আমি তোমাদের অপেক্ষা হজরত মুসা (আ.)-এর অধিক নিকটবর্তী। এরপর তিনি এদিন সাওম পালন করেন এবং সবাইকে রোজা রাখার নির্দেশ দেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)
হজরত মুসা (আ.) তুর পাহাড়ে আল্লাহর কাছ থেকে ‘তাওরাত’প্রাপ্তির আগে ৪০ দিন পানাহার পরিত্যাগ করেছিলেন। ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাতে বর্ণিত আছে, হজরত মুসা (আ.) তুর পাহাড়ে ৪০ দিন পানাহার বর্জন করে রোজা অবস্থায় ধ্যানমগ্নতায় কাটিয়েছিলেন। তাই ইহুদিরা হজরত মুসা (আ.)-এর অনুসরণে ৪০টি রোজা রাখা ভালো মনে করত। তন্মধ্যে ৪০তম দিনটিতে তাদের ওপর রোজা রাখা আবশ্যক ছিল। মহররমের ১০ তারিখে আশুরার দিনে হজরত মুসা (আ.) তাওরাতের ১০টি বিধান পেয়েছিলেন, এ কারণেই তাওরাতে ওই দিনের রোজা পালনের জন্য তাগিদ এসেছে। এ ছাড়া ইহুদি সহিফাতে অন্যান্য রোজারও সুস্পষ্ট হুকুম রয়েছে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘রমজান উপলক্ষে আমার উম্মতকে পাঁচটি বস্তু দেওয়া হয়েছে, যা পূর্ববর্তী উম্মতকে দেওয়া হয়নি।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘আমাদের রোজা ও আহলে কিতাবদের রোজার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে সেহ্রি খাওয়া।’ (মুসলিম) অন্য হাদিসে বর্ণিত আছে যে ‘আমাদের এবং ইহুদিদের রোজার পার্থক্য হচ্ছে আমরা সেহ্রি খাই।’
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]