রোজা আত্মশুদ্ধির মূল হাতিয়ার

ধর্ম
ধর্ম

রমজান মাসে সংযত জীবনযাপনের কঠোর অনুশাসন আত্মিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন তথা মনের পবিত্রতা অর্জনের এক সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়। মানুষের আত্মশুদ্ধির একটি বলিষ্ঠ হাতিয়ার সিয়াম পালন বা রোজা। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে মানুষ তার পাশবিক প্রবৃত্তিকে সংযত এবং আত্মিক শক্তিকে জাগ্রত ও বিকশিত করে তোলার পরিপূর্ণ সুযোগ লাভ করে। মানুষের মনের মধ্যে যে পশু স্বভাব রয়েছে, তা তার আত্মিক উন্নতির পথে বাধার সৃষ্টি করে থাকে। মানুষ যখন তার পশু স্বভাবের ওপর আত্মিক ও বিবেকের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তখনই সে পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে যায়। পশু স্বভাব কখনো মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও আত্মসংযমের মাধ্যমে একে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা যায়। সে কারণেই সিয়ামের মতো কঠোর সংযম সাধনার মাধ্যমে মানবজাতি তার পশু স্বভাবকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনার চেষ্টা করে।
কুপ্রবৃত্তির হাতিয়ার বা অস্ত্রকে দুর্বল করে বশে আনার লক্ষ্যে আল্লাহ তাআলা সিয়াম সাধনার অপূর্ব সুযোগ দিয়েছেন। মানুষ যাতে কুপ্রবৃত্তিকে দমন করে ধর্মীয় অনুশাসন পালন করতে পারে এবং যাবতীয় অকল্যাণকর কাজ থেকে আত্মরক্ষা করে আল্লাহর রহমতের যোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। আত্মাকে সংশোধন, রিপুর লোভ-লালসা থেকে পরিমার্জন ও পরিশোধন করার মাধ্যমেই একজন রোজাদার ব্যক্তি সফলকাম হতে পারেন। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘শপথ মানুষের এবং তঁার, যিনি তাকে সুঠাম করেছেন। অতঃপর তাকে তার অসৎ কর্ম ও তার সৎ কর্মের জ্ঞান দান করেছেন। সেই সফলকাম হবে, যে নিজেকে পবিত্র করবে। এবং সে-ই ব্যর্থ হবে, যে নিজকে কলুষাচ্ছন্ন করবে।’ (সূরা আশ-শামস, আয়াত: ৭-১০)
রোজা আত্মশুদ্ধি ও চরিত্র উন্নয়নের এক বিশেষ প্রক্রিয়া। যেকোনো মানবিক প্রক্রিয়ায় উন্নতি করতে হলে যথেষ্ট মানসিক কসরত করতে হয়। শরীরকে বেশি মজবুত করতে হলে ব্যায়াম করতে হয়। তেমনি চারিত্রিক উন্নয়ন ও মানসিক উন্নতির জন্য প্রয়োজন মানসচর্চা ও মানসিক সাধনা। সিয়াম সাধনায় শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যবহারের চেয়ে মনের গতি-প্রকৃতি, কামনা-বাসনা নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বই অনেক বেশি। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) সিয়ামকে দেহের জাকাত বলে আখ্যায়িত করেছেন। সিয়াম বা রোজা দ্বারা শরীর, মন ও আত্মা বিধৌত হয়। দেহ যখন সংযমের শাসনের অধীন থাকে, আত্মা তখন সবল হয়ে ওঠে। সিয়াম সাধনায় কুপ্রবৃত্তিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। মানুষের মাঝে লুক্কায়িত পাশবিক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না।
আত্মা মানুষকে পাপাচারের দিকে পথনির্দেশনা দেয়। রোজাদারদের স্বকীয় আত্মাকে সৎ পথে পরিচালিত করার দ্বারা প্রবৃত্তির বিরুদ্ধাচরণ হবে। অন্তর যদি গুনাহর দিকে আহ্বান করে, তাহলে সেই আহ্বানে সাড়া দেওয়া যাবে না। মাহে রমজানে সর্বদা হৃদয়কে কু চিন্তাভাবনা থেকে সংশোধিত রাখতে হবে। মানবাত্মাকে সংশোধন করা হলে ইবাদতে সত্যনিষ্ঠতা ও একাগ্রতা আসবে। পরিশুদ্ধিতা লোভ-লালসা, কামনা-বাসনা, রিপুর তাড়না, অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ, জুলুম-নির্যাতন ও অসামাজিক দুর্বৃত্তপনা পরিহার করে ধার্মিকতার পথে অগ্রসর হওয়ার মাধ্যমে অর্জিত হবে। লৌকিকতা বা প্রদর্শনের ইচ্ছা পরিহার করে আত্মার পরিশুদ্ধি নিয়ে ইবাদতে মনোনিবেশ করা উচিত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই সাফল্য লাভ করবে যে পবিত্রতা অর্জন করে।’ (সূরা আল-আ’লা, আয়াত: ১৪)
কুপ্রবৃত্তিগুলো সবল ও সতেজ থাকলে সুপ্রবৃত্তিগুলো মৃতপ্রায় হয়ে যায়। মানুষের ইমান যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, শয়তান তখন তার ওপর প্রভাব বিস্তার করে। কুপ্রবৃত্তির তাড়নায় তখন মানুষ পাপের পথে ধাবিত হয়। তখন পরম দয়ালু আল্লাহ মেহেরবান তাদের আত্মশুদ্ধির দিকনির্দেশনা দেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো, বিশুদ্ধ তওবা; সম্ভবত তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মন্দ কর্মগুলো মোচন করে দেবেন।’ (সূরা আত-তাহরিম, আয়াত: ৮)

>আত্মশুদ্ধির মাসে মানবীয় মন্দ স্বভাবগুলো থেকে বিরত থাকা রোজা আদায়ের জন্য শর্তারোপ করা হয়েছে। তাই রমজান মানুষকে এসব মন্দ স্বভাব পরিহার করে সৎ স্বভাব অর্জন করতে শিক্ষা দেয়

অন্তরের বিশুদ্ধতা বা আত্মশুদ্ধির হাতিয়ার রোজা দ্বারাই অর্জিত হয়। মাহে রমজানে আত্মশুদ্ধির বিরাট সুযোগ থাকলেও মানুষের দৈনন্দিন জীবনে নৈতিক অধঃপতন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সামাজিক সমস্যা ও গণসচেতনতার অভাব প্রভৃতি সেই আত্মশুদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হলে সমাজের প্রত্যেক রোজাদার মানুষকে সৎ মনোভাবাপন্ন, নির্লোভ, মহৎ ব্যক্তিত্ববান হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। মানুষ যখন কোনো পাপকাজ বা দোষ-ত্রুটি করে, তখন তার অন্তরে কালিমা বা মরিচা পড়ে। মানুষ যত বেশি পাপকাজ করতে থাকে, তার অন্তরে পাপের কালিমা তত বেশি পতিত হয়। এই পাপের মরিচা থেকে আত্মশুদ্ধি তথা অন্তরকে স্বচ্ছ ও পরিষ্কার রাখার একমাত্র পন্থা হলো আল্লাহর জিকির। মানুষ যতই আল্লাহর জিকির-আজকার, ইবাদত-বন্দেগি, নামাজ-রোজা পালন করবে, তার অন্তর থেকে ততই পাপ মুছে যাবে এবং সে পাপমুক্ত হবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই তাঁর বান্দাদের তওবা কবুল করেন এবং পাপ মোচন করেন।’ (সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ২৫)
আত্মশুদ্ধির মাসে মানবীয় মন্দ স্বভাবগুলো থেকে বিরত থাকা রোজা আদায়ের জন্য শর্তারোপ করা হয়েছে। তাই রমজান মানুষকে এসব মন্দ স্বভাব পরিহার করে সৎ স্বভাব অর্জন করতে শিক্ষা দেয়। রোজা পালন বা সিয়াম সাধনায় মানুষের অন্তরকে পরিচ্ছন্ন ও সুষ্ঠু-সুন্দর রাখার পূর্ণ ব্যবস্থা রয়েছে। কলব বা অন্তরের অবস্থানকে পবিত্র, নির্মল তথা পরিশুদ্ধ করার জন্য নামাজের পরই রমজান মাসের রোজার স্থান। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পাপকাজ করে, তা থেকে তওবা করে, সে ব্যক্তি এমনভাবে নিষ্পাপ হয়ে যায় যেন সে পাপকাজ করেনি।’
সিয়াম সাধনায় পাশবিক প্রবৃত্তি যখন দমে যায়, তখন মানবাত্মার তেজ ও প্রাণশক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। রোজার দ্বারা মানুষের আত্মার উন্নতি সাধিত হয়। আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধির কারণে ক্ষুধার জ্বালা রোজাদারকে কাবু করতে পারে না। রোজাদার তাঁর ইমানের শক্তি বৃদ্ধির ফলে সব ধরনের খাবার সামনে থাকা সত্ত্বেও আহার করেন না, এ জন্য তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় পানাহার বর্জন করে থাকেন। রোজা পালনের মধ্য দিয়ে মানুষ অন্তরাত্মাকে পরিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে অভ্যস্ত হয়। বস্তুত রোজা হলো আত্মশুদ্ধি ও দেহ-মনের পবিত্রতা অর্জনের সর্বোপরি আল্লাহর নৈকট্য ও সান্নিধ্য অর্জনের পাশাপাশি পরকালীন চিরস্থায়ী জিন্দেগির চরম সাফল্য লাভের একটি সুবর্ণ সুযোগ।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]