রোজাদারের মনুষ্যত্বের গুণাবলি

ধর্ম
ধর্ম

ধর্মপ্রাণ রোজাদার লোকেরা যেন প্রকৃত মানুষ হতে পারে, তার মধ্যে মনুষ্যত্বের গুণাবলি যেন পূর্ণ মাত্রায় জাগ্রত হয়, সে যেন খুঁজে পায় চিরমুক্তির মোহনা, যেন পৌঁছাতে পারে তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে বা মনজিলে মকসুদে—এ জন্য আল্লাহ তাআলা রমজান মাসে সিয়ামের বিধান দান করেছেন। কিন্তু মানুষকে পথভ্রষ্ট করার জন্য শয়তান ব্যক্তির নফস বা প্রবৃত্তির ওপর কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য প্রভৃতি রিপু দ্বারা প্রভাব বিস্তার করে। শয়তান যেমন মানুষের প্রকাশ্য শত্রু তেমনি রিপুগুলোও মানুষের গুপ্ত শত্রু। যে রোজাদার এসব নিয়ন্ত্রিত ও দমিত রাখতে পারে, সে মানুষই প্রকৃত বীরত্বের স্বাক্ষর রাখতে পারে। রোজার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা সৎ ও পুণ্যবান মানুষকে সফলতা ও মুক্তির প্রান্তরে পৌঁছাতে চান এবং পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব, মায়া-মমতা, সৌহার্দ্য, হৃদ্যতা-ভালোবাসা সৃষ্টি করতে চান।
সততার গুণাবলি অর্জনের প্রচেষ্টা ও নিরলস চর্চা মানুষকে মর্যাদার উচ্চতর স্থানে পৌঁছে দিতে পারে। রোজার মধ্যে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ হিসেবে মানুষের পূতপবিত্র সুন্দর চরিত্র সৃষ্টির ঐশী অবদান লুকিয়ে আছে, যেন মানুষ তাকওয়া অর্জন করতে পারে, আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে পারে এবং তাঁর শোকরগুজার হতে পারে। ইসলামে রোজা তাই নিছক উপবাস নয়, বরং মাহে রমজানের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য মানুষকে সৎ, নির্লোভ ও সংযমী হতে শেখায়। রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেওয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদের দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা সাবধান হয়ে চলতে পার।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৩)
রোজাদার ব্যক্তির সৎ ও পুণ্যবান থাকার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে সমাজে নীতি-নৈতিকতা এবং সততার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। রোজা পালনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া অর্জন করা। তাকওয়া মানে আল্লাহর অসন্তুষ্টির ভয়ে তাঁর নিষেধসমূহ পরিহার করা, যাবতীয় আদেশ-নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করা এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা। এককথায় সব ধরনের অকল্যাণকর ও গুনাহের কাজ বর্জন করা এবং সব ধরনের কল্যাণময় ও সওয়াবের কাজ পালন করাই তাকওয়া। রোজা মানুষের মধ্যে সর্বতোভাবে তাকওয়া সৃষ্টি করে। মানুষ যখন রোজা পালন করে তখন সে আত্মশুদ্ধি লাভ করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে। তাই রোজাকে সফল করে তুলতে হলে সৎ থাকার অভ্যাস অর্জন করা দরকার।
একজন রোজাদার যখন রোজা পালন করে ধৈর্য, সততা, ন্যায়নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতার পরিচয় দেয়, তখন দারুণ ক্ষুধা-তৃষ্ণার মধ্যেও সে পানাহার করে না। অথচ তার মধ্যে সততা, ন্যায়নিষ্ঠা ও খোদাভীতি না থাকলে সে লোকচক্ষুর অন্তরালে পানাহার করতে পারে। ইচ্ছা করলে সংগোপনে রোজা ভঙ্গের যেকোনো গর্হিত কাজে লিপ্ত হতে পারে। প্রকাশ্যে লোকেরা তাকে রোজাদার বলে জানবে। কিন্তু একজন মুমিন বান্দা তা করে না। মূলত এটিই হচ্ছে তাকওয়া। সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে রোজা পালন করে ইমানদার ব্যক্তি তাকওয়ার অনুশীলন করে। রোজাদার অশ্লীলতা, অনাচার ও অপকর্ম পরিহার করে চলে। রোজাদারের মধ্যে আত্মসংযম, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও আল্লাহভীতি না থাকলে সব পরিশ্রম ও সিয়াম-সাধনা নিষ্ফল হয়ে যাবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘অনেক রোজাদার এমনও আছে, যাদের অনাহারে থাকা ছাড়া আর কিছু নেই।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘রোজা ঢালস্বরূপ, যতক্ষণ না একে নষ্ট করে দেওয়া হয়।’ অতঃপর সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! কিসে রোজা নষ্ট হয়? তিনি বললেন, ‘মিথ্যা কথা ও পরনিন্দা দ্বারা ঢাল তথা রোজা বিনষ্ট হয়ে যায়।’ (বুখারি)

>তাকওয়া মানে আল্লাহর অসন্তুষ্টির ভয়ে তাঁর নিষেধসমূহ পরিহার করা, যাবতীয় আদেশ-নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করা এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা

রোজার মাধ্যমে মানুষকে সৎ ও পুণ্যবান করাই হলো রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য। রোজা রাখার পরও যদি কেউ পুণ্যবান না হয়; আদর্শ, সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার ওপর নিজের জীবনের ভিত্তি রচনা করতে না পারে, মাহে রমজানে অসত্য ও নিরর্থক কথাবার্তা পরিত্যাগ করতে না পারে এবং রমজান মাসের বাইরে নিজের জীবনে সততা ও পবিত্রতা দেখা না দেয়, তাহলে তার চিন্তা করে দেখা উচিত যে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উপবাস যাপন করে তার কী লাভ হলো? তাই রোজাদারকে রোজার আসল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে সজাগ থাকার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘অনেক রোজাদার এমন আছে, কেবল ক্ষুধা আর পিপাসা ছাড়া যাদের ভাগ্যে অন্য কিছুই জোটে না। তেমনি রাত্রিতে ইবাদতকারী অনেক মানুষও এমন আছে, যারা রাত্রি জাগরণ ছাড়া আর কিছুই লাভ করতে পারে না।’ (ইবনে মাজা)
মাহে রমজানের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত করে পারস্পরিক প্রেম-ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও মহব্বতের সুমধুর ও সুনিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলে এ পৃথিবীকে শান্তির স্বর্গে পরিণত করা, তা যদি না হয় আর মানুষের ভেতর যদি মানবিক গুণাবলি সৃষ্টি না করা যায়, তাহলে সে রোজা উপবাস বৈ আর কিছু নয়। তাই রমজানের একটি মাসে কঠোর সিয়াম সাধনা করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অবশ্যকর্তব্য। রোজা রেখে যদি কেউ মিথ্যা কথা বলে, অন্যের গিবত করে কিংবা দৃষ্টিকে হারাম বস্তু থেকে ফিরিয়ে রাখতে না পারে, তার রোজা কলুষিত হয়ে গেল। বাহ্যিক দৃষ্টিতে তার রোজা হয়ে গেলেও রমজানের রহমত ও বরকত তার ভাগ্যে জুটবে না। নবী করিম (সা.) রোজার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইমান ও আত্মবিশ্লেষণের সঙ্গে রোজা রাখবে, তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
মাহে রমজানে অবশ্যই রোজাদারকে যাবতীয় পাপকাজ যথা: পরচর্চা, পরনিন্দা, ঝগড়াবিবাদ, সুদ-ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, হারাম, অশ্লীলতা, ব্যভিচার, বেহায়াপনা, অন্যায়-অত্যাচার, ওজনে কম দেওয়া, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল দেওয়া প্রভৃতি শরিয়ত পরিপন্থী কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রত্যেক রোজাদার নর-নারীর জীবনে পাপকাজ থেকে মুক্ত থেকে মনুষ্যত্বের গুণাবলি অর্জনে নীতি-নৈতিকতা, সততা ও ন্যায়নিষ্ঠা প্রদর্শনপূর্বক রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পরিপূর্ণ করার প্রত্যয়ে অধিক পরিমাণে কোরআন তিলাওয়াত, দোয়া-ইস্তেগফার, তাসবিহ-তাহলিল, জিকির-আসকার, দান-সদকা ও তারাবি-তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়সহ ইবাদত-বন্দেগি করে অশেষ পুণ্য লাভের জন্য আত্মনিয়োগ করা উচিত।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]