কোন যোগ্যতায় খাদ্য প্রতিমন্ত্রী

মন্ত্রিসভায় কোনো ‘রদ’ নেই, কিছু ‘বদল’ ঘটেছে। তিন নতুন মুখ এসেছেন। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে কেবল দপ্তরবিহীন করতে একটি প্রজ্ঞাপন জারির সপ্তাহ না ঘুরতেই যে বদলটি আমরা দেখলাম, তাতে আরও জোরালোভাবে প্রতীয়মান হয় যে এই পরিবর্তনের সঙ্গে জবাবদিহি, স্বচ্ছতা ও সুশাসনের ধারণার কোনো সম্পর্ক নেই। সৈয়দ আশরাফকে সরানোটা সবার চোখে পড়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নিকটাত্মীয় মোশাররফ হোসেনের হাতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে গেছে। এখন মনে হয় আশরাফের অপসারণ ছাড়াও তাঁকে ওই পদে অবিলম্বে বসানোটাই বেশি জরুরি ছিল। তাঁর পরিবারের সদস্যরা এই মন্ত্রণালয়ে তাঁর অধিষ্ঠান চাইছিলেন বলেও শোনা যায়। তবে সৈয়দ আশরাফকে জনপ্রশাসনমন্ত্রী করে ভুল শুধরে নেওয়াটা ইতিবাচক।
কারও সাতেপাঁচে না থাকা নুরুল ইসলাম বিএসসি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দলের স্বার্থে তাঁর আসনটি উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি বিদ্রোহী হননি। জাতীয় পার্টির মহাসচিবকে জয়ী হতে দিয়েছেন। শিল্পপতি হিসেবে তাঁর পরিচিতি আছে, মানুষ হিসেবে ভদ্রলোক। তবে সংগঠনের কাজে বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ তাঁর ছিল না। তারানা হালিম রুপালি পর্দার প্রিয় মুখ, তাঁর জনপ্রিয়তা রয়েছে। আইনজীবী হিসেবে তিনি সক্রিয় ছিলেন না, ছিলেন মঞ্চে ও পর্দায়। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনেও তাঁর গতিশীল পদচারণ ছিল। দলের জন্য কাজ করেছেন। তাই মন্ত্রিসভায় আরেকজন নারীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চয় উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
তবে বেশ অবাক হতে হয় যে কালীগঞ্জের সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান আহমেদকে প্রতিমন্ত্রী করায়। বিশেষ করে গম উপাখ্যানের পরপরই এমন একজনকে খাদ্য প্রতিমন্ত্রী করা হলো, যা ইঙ্গিত দেয় যে মন্ত্রী পদে কারও নিয়োগ করার ব্যাপারে জনমনে কী ধারণা হতে পারে, তা মোটেই বিবেচ্য নয়। অন্যথায়, তিন নতুন মুখের মধ্যে যাঁর অতীত মলিন, কেন বেছে বেছে তাঁকেই খাদ্য প্রতিমন্ত্রীর পদে বসানো হবে।
আমাদের কাছে থাকা তথ্য–প্রমাণ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে নতুন খাদ্য প্রতিমন্ত্রীর সরকারি খাদ্যবিষয়ক এমন ভূমিকা রয়েছে, যা নিয়ে উন্নত গণতন্ত্রে বিরাট প্রশ্ন তোলা যায়, আমাদের খুঁড়িয়ে চলা গণতন্ত্রেও এটা গ্রহণযোগ্য হবে বলে আশা করি না।
এই প্রতিমন্ত্রীর অতীত খতিয়ে দেখা দরকার। এটা আমাদের কাছে একেবারেই পরিষ্কার নয় যে তাঁকে মন্ত্রী হিসেবে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে ঠিক কোন বিবেচনাটি অনুঘটকের কাজ করেছে। তিনি ব্যবসায়ী, কিন্তু এলাকায় কী ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত, তা পরিষ্কার নয়। তাঁর মরহুম বাবা ১৯৭০ সালে এমপিএ (প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য) এবং ১৯৭৩ সালে সংসদ সদস্য ছিলেন। কিন্তু জেনারেল এরশাদের জামানায় বিতর্কিত উপায়ে উপজেলাব্যবস্থা প্রবর্তনকালে নুরুজ্জামান আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন এরশাদবিরোধী আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নেন। ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টির আশীর্বাদে উপজেলা চেয়ারম্যান হন।

>সিকিম, মিজোরাম ও গোয়ার মতো ছোট রাজ্য সাত মন্ত্রী দিয়ে চলছে। বাংলাদেশের ৩৫০ (৫০ সংরক্ষিত নারী আসনসহ) আসনের সংসদের দেশে মন্ত্রী থাকা উচিত সর্বোচ্চ ৫২ জন

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচন করে তিনি হেরে যান। ২০০১ সালে তিনি পুনরায় আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র পান, কিন্তু ঋণখেলাপি হওয়ার কারণে তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। আওয়ামী লীগ অন্য একজনকে প্রার্থী করে। এর মধ্যে আবার হাইকোর্টে রিটে জিতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধাচরণ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন এবং পরাস্ত হন। পরে আওয়ামী লীগ তাঁকে বহিষ্কার করেছিল। ২০০৯ সালে তিনি দ্বিতীয়বার উপজেলা চেয়ারম্যান হন। এই নির্বাচনে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বর্তমানে এরশাদের জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রোকনউদ্দিন জানিয়েছেন, তিনি ২০০৯ ও ২০১৪ সালে দুবার উপজেলা নির্বাচনে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। তাঁর অভিযোগ ২০০৯ সালে নুরুজ্জামান ও ২০১৪ সালে তাঁর ছোট ভাই কারচুপি করে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছেন।
নির্বাচনে পরাজিত হয়ে এ রকম অভিযোগ নিশ্চয় নতুন নয়, কিন্তু শুধু সে কারণে তাঁর অভিযোগ নাকচ করাও যুক্তির কথা নয়। তবে যেটা লক্ষণীয়, নুরুজ্জামান ও তাঁর ছোট ভাই, যিনি বর্তমানে কালীগঞ্জের উপজেলা চেয়ারম্যান, তাঁরা একই বাসভবনে থেকেই যুগপৎ স্থানীয় রাজনীতি করে আসছেন। উভয়ের বনিবনার কোনো ঘাটতি নেই। উপজেলা চেয়ারম্যানের পদে ছোট ভাইকে বসাতে পেরে নুরুজ্জামান খুশি হয়েছেন। এখন আমরা দুটি নির্দিষ্ট ঘটনার উল্লেখ করব।
২০১০ সালের ৬ অক্টোবরে ইত্তেফাক-এর লালমনিরহাটের সংবাদদাতার পাঠানো একটি খবর ছাপা হয়েছিল। শিরোনাম: ‘লালমনিরহাট থানায় আওয়ামী লীগ নেতার হাতে এএসআই লাঞ্ছিত’। শিরোনামে ভুল ছিল। ভেতরে লেখা আছে, এটা ঘটে কালীগঞ্জ থানায়। আর ওই নেতা হলেন আজকের খাদ্য প্রতিমন্ত্রী। ওই খবরে বলা হয়েছে, হরেরাম গ্রামে একটি জমি কেনাবেচার ঘটনায় মামলা হয়েছিল। ওই থানার তৎকালীন এএসআই আবদুল মান্নাফ, যাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, তিনি তদন্ত প্রতিবেদন দেন, যা আওয়ামী লীগের থানা সভাপতি ও নুরুজ্জামানের এক ঘনিষ্ঠ কলেজশিক্ষকের বিপক্ষে যায়। তিনি দলবল নিয়ে থানায় গিয়ে হুমকি দিয়েছিলেন, এ সময় থানার ভেতরে ওসির সামনেই মান্নাফ লাঞ্ছিত হন। নুরুজ্জামান ওই ঘটনার পরে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমি সোমবার রাতে কালীগঞ্জ থানায় গিয়ে মান্নাফের কাছে কিছু বিষয়ে জানতে চাইলে সে আমার সঙ্গে বেয়াদবি করে।’ (প্রথম আলো, ৭ অক্টোবর, ২০১০)। প্রতিমন্ত্রীর ভাই আমাকে জানান, পুলিশ লাঞ্ছনার ওই অভিযোগ সত্য নয়, ১৯৯১ থেকে তাঁর ভাই টানা থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি, ২০০১ সালে নির্বাচনকালে তাঁর কথায় ‘জেলা আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রে’ তাঁকে বহিষ্কার করা হয়, কেন্দ্র যা মানেনি, তাই ২০০৩ সালে তিনি পুনরায় থানা কমিটির সভাপতি হন। শেখ হাসিনার সই করা ২০১৩-২০১৬ সালের লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের ৩৪ সদস্যের কমিটিতে নুরুজ্জামানের নাম সদস্য হিসেবে ৬ নম্বরে, জেলাতেও বড় পদে থেকে দলের কাজে বড় ভূমিকা রাখার অভিজ্ঞতা ছিল না।
২০১৫ সালের ২ জানুয়ারির প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি শিরোনাম হলো: ‘কালীগঞ্জে খয়রাতির চাল আত্মসাতের অভিযোগ পিআইও ও চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা’। খাদ্য প্রতিমন্ত্রীর ভাই মাহবুবুজ্জামান আহমেদ তুষভান্ডার ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর মরহুম বাবা এই তুষভান্ডারে ২৪ বছর, নুরুজ্জামান ১০ বছর ও মাহবুবুজ্জামান ১৯ বছর চেয়ারম্যান ছিলেন। কিন্তু ২০১১-১২ অর্থবছরে সরকারি খয়রাতি জিআর প্রকল্পের ৪৮ টন চাল আত্মসাতের অভিযোগে দুদক ১৯টি মামলা করে। এর মধ্যে ১৩টি মামলায় অভিযুক্ত মন্ত্রীভ্রাতা মাহবুবুজ্জামান।
‘যখন আত্মসাতের ঘটনা ঘটে, তখন শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যান হিসেবে আমি বিদেশ সফরে ও ছুটিতে ছিলাম। এ বিষয়ে মহিলা এমপির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, আমি সাক্ষী ছিলাম।’ জানতে চেয়েছি, আপনার প্রতিমন্ত্রী ভাই কি বিষয়টি জানেন? তাঁর কী মত? কালীগঞ্জের উপজেলা চেয়ারম্যান আমাকে টেলিফোনে বলেন, তিনি জানেন এবং তিনিও মনে করেন যে এতে আমাকে অভিযুক্ত করা সংগত নয়। দুদকের সহকারী পরিচালক জাকারিয়া প্রথম আলোর লালমনিরহাট সংবাদদদাতা আবদুর রবকে বুধবার বলেছেন, ওই মামলা তদন্তাধীন, এখনো চার্জশিট হয়নি।
এসব বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য সরকারের জানা থাকলেও তাঁর মন্ত্রিত্ব আটকে যেত কি না, জানি না। কারণ, মায়া ও কামরুলের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের তুলনায় এসব গুরুতর নয়! তবে এটা বলব, এই পরিবর্তন ‘মিনিমাম গভর্নমেন্ট ও ম্যাক্সিমাম গভর্নেন্স’-এর ধারণার সঙ্গে খাপ খায় না। ভারত ২০০৪ সালে সংবিধানের ৯১ সংশোধনী এনে প্রধানমন্ত্রীর হাত বেঁধে দিয়েছে। কোনো অবস্থাতেই ৫৪৫ আসনের লোকসভার ১৫ শতাংশের বেশি মন্ত্রী হবে না।
সিকিম, মিজোরাম ও গোয়ার মতো ছোট রাজ্য সাত মন্ত্রী দিয়ে চলছে। সেই বোধযোগ্য যুক্তিতে বলা যায়, বাংলাদেশের ৩৫০ (৫০ সংরক্ষিত নারী আসনসহ) আসনের সংসদের দেশে মন্ত্রী থাকা উচিত সর্বোচ্চ ৫২ জন। এখন আরও তিনজন বাড়িয়ে ৫৫ ছাড়িয়ে গেছে। উপদেষ্টা ধরলে সেটা ৬০। এই ধারা বন্ধ করতে সংবিধানে একটি সংশোধনী আনা জরুরি হয়ে পড়েছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
[email protected]