নারী-পুরুষ সমতা অর্জনে বড় বাধা বাল্যবিবাহ

ক্রিস্টিন হান্টার
ক্রিস্টিন হান্টার
ইউএন উইমেন ইন বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ ক্রিস্টিন হান্টার নারীর ক্ষমতায়ন ও লৈঙ্গিক সমতা সৃষ্টির লক্ষ্যে পরিচালিত নানা প্রকল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এ বিষয়ে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, নারীর অবমূল্যায়নের মধ্যেই লৈঙ্গিক অসমতার বীজ নিহিত রয়েছে। তিনি বাল্যবিবাহ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন।

প্রথম আলো : বাংলাদেশের নারীদের অবস্থান কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ক্রিস্টিন হান্টার : বাংলাদেশের সামগ্রিক ইতিহাস লক্ষ করলে দেখবেন, নারী ও বালিকাদের প্রাত্যহিক জীবনের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। সেই ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে স্কুলে ভর্তি হওয়া, মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য, সন্তান গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করে আরও অনেক ক্ষেত্রেই।
কিন্তু তারপরও অসমতা রয়ে গেছে। সুনির্দিষ্ট কিছু সম্পদ ও সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে আছে। মাধ্যমিক স্কুলে ছেলে ও মেয়েদের ভর্তির হার একই, এটা ঠিক, কিন্তু ফলাফলের ক্ষেত্রে মেয়েরা পিছিয়ে আছে। ড্রপআউট হলে ছেলেরা শ্রমিকের কাজ করে, আর মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। মেয়েদের উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে, সেটা তাদের পড়াশোনা করতে কিছু মাত্রায় সাহায্য করছে। অন্যদিকে স্কুলের বাইরে চলে গেলে মেয়েদের ঋণ পাওয়ার সুযোগ থাকে না।
প্রথম আলো : কিন্তু ক্ষুদ্রঋণ তো মূলত নারীদের দেওয়া হয়...
ক্রিস্টিন হান্টার : হ্যাঁ, তা ঠিক। কিন্তু তার সুবিধা ভোগ করে কে? ঋণ শোধের ভার কার? পুরুষেরা ঋণের সুবিধা ভোগ করে, আর তা শোধ করে নারীরা। অর্থাৎ অসমতার একটি ক্ষেত্র হচ্ছে সম্পদ প্রাপ্তি। নারীদের সব সময় অবমূল্যায়ন করা হয়, এর কোনো ব্যত্যয় হয় না। এখানে নারীকে পুরুষের সমান হিসেবে দেখা হয় না। নারীর প্রতি যে হারে সহিংসতা হচ্ছে, তা থেকে এটা স্পষ্ট। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সমীক্ষা অনুসারে, ৮৭ শতাংশ নারী তাঁদের স্বামীর দ্বারা নির্যাতিত হন, এর মধ্যে ৬৬ শতাংশই হচ্ছে শারীরিক সহিংসতা। গত ১২ মাসে দেশের এক-তৃতীয়াংশ নারীই শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, অর্থাৎ বছরে ১ কোটি ৩০ লাখ নারী সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। তাঁরা যেমন বাড়িতে নির্যাতিত হচ্ছেন, তেমনি কর্মক্ষেত্র এবং রাস্তায়ও নির্যাতিত হচ্ছেন। এই ৮৭ শতাংশ নারী আবার মানসিকভাবেও নির্যাতিত হয়েছেন। আর এই সহিংসতা স্রেফ ক্ষণিকের ক্রোধের বিস্ফোরণ নয়, এটা ধারাবাহিক ব্যাপার।
আরেকটি বড় ব্যাপার হচ্ছে বাল্যবিবাহ। আইন অনুসারে, ১৮ বছর বয়সের আগে মানুষ নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তারপরও ১৮ বছর বয়সের আগে অর্ধেকেরও বেশি মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, যখন তারা নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্তই নিতে পারে না। অর্থাৎ সমাজ ছেলে ও মেয়েদের সমান দৃষ্টিতে দেখে না। আবার অর্থনীতিতে নারীর অবদান স্বীকার করা হয় না। দক্ষতা অর্জনের প্রশিক্ষণ লাভের সুযোগ নারীদের কম। আসলে নারীদের এসব সুযোগ লাভের ক্ষেত্রে এত বেশি প্রতিবন্ধকতা আছে যে তাঁদের পক্ষে তা গ্রহণ করাই কঠিন।
গৃহস্থালির কাজের বেশির ভাগই করে নারী, কিন্তু সেটা শ্রম আইনে স্বীকৃত নয়। পারিশ্রমিকবিহীন শ্রমের ওপর সিপিডি একটি সমীক্ষা করেছিল, তাতে দেখা যায়, কাজ ও উৎপাদনে নারীর বিপুল শ্রমের পারিশ্রমিক নেই। নারী ছাড়া অন্য কেউ টাকা বানাচ্ছে, যদিও তারাই কাজটা করছে।
পারিশ্রমিকবিহীন শ্রমিকের ৯০ শতাংশই নারী। তারা হয়তো হস্তশিল্পসহ অন্যান্য পণ্য তৈরি করছে, যেগুলো বিক্রিও হচ্ছে, কিন্তু সেই স্বীকৃতি নারীরা পাচ্ছে না। পুরুষের ক্ষেত্রে তা হতে পারে না। আইনি, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে নারীদের সমমর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না।
নারীরা কৃষিতে কাজ করলেও তাদের স্বীকৃতি নেই। ভূমির মালিকানার ভিত্তিতে কৃষকের সংজ্ঞা নির্ধারিত হচ্ছে, কিন্তু নারীরা ভূমির মালিক না হওয়ায় তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কৃষকের স্বীকৃতি পাচ্ছে না। সে কারণে তারা কৃষকদের প্রশিক্ষণসহ নানা প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
প্রথম আলো : সরকার সূক্ষ্মভাবে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ থেকে ১৬ করার চেষ্টা করছে...
ক্রিস্টিন হান্টার : সরকার বাল্যবিবাহ রোধ করতে অবস্থান নিয়েছে, এতে আমি সত্যিই খুশি। এটা স্রেফ বাগাড়ম্বর নয়, এতে ভবিষ্যতের প্রতি সত্যিই অঙ্গীকার আছে। বাল্যবিবাহের কারণে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। লৈঙ্গিক সমতা অর্জনের ক্ষেত্রে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
বাল্যবিবাহের একটি পরিণতি হচ্ছে মাতৃমৃত্যু। ১৮ বছরের নিচে মা হওয়ার বেলায় অর্ধেকের বেশিই মেয়ে মারা যায়। কিশোরী মেয়েরা সন্তান জন্মের সময় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। সন্তান জন্মের সময় নারীদের চেয়ে কিশোরীরাই বেশি মারা যায়। শুধু বাল্যবিবাহ বন্ধ হলেই মাতৃমৃত্যুর হার অর্ধেক কমানো সম্ভব।
কিশোরীদের ওপর সহিংসতার মাত্রা অনেক বেশি, এতে দেশের বিপুল সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়। এখানে ১৫-১৬ বছর বয়সী বিবাহিত মেয়েদের কেউ কেউ স্কুলে যায়, আফ্রিকার মতো নয়, ওখানে বিয়ে হওয়ামাত্রই মেয়েরা ড্রপআউট হয়ে যায়। কিন্তু অন্তঃসত্ত্বা হলে তাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। শিক্ষা না থাকায় কাজ করার যোগ্যতা তারা অর্জন করতে পারে না। আর অল্পবয়সী মায়ের সন্তানের ওজন কম হয়, শিশুর বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য বিশাল এক সমস্যা। বাড়িতে এই মেয়েরা পুরুষের সমান খেতে পারে না, শারীরিকভাবেও তারা যোগ্য নয়, আর পুষ্টিসংক্রান্ত তথ্যও তারা পায় না।
বাল্যবিবাহ বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে, অঙ্গীকার থাকতে হবে। কিন্তু বাবা-মা চাইলে কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিতে পারবেন, এমন আইন করা হলে সেটা কী বার্তা দেবে? অর্থাৎ কখনো কখনো বাল্যবিবাহে সমস্যা নেই? না, এটা সব সময়ই সমস্যাজনক। মেয়েদের কোনো সমস্যা হলে তা সমাধানের বিকল্প পথ বাতলাতে হবে, বিয়ে সমাধান হতে পারে না। সমাজকে মেয়েদের জন্য নিরাপদ করে তুলতে হবে।
বাল্যবিবাহের অভিঘাত সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয় দরিদ্রদের জীবনে। দরিদ্র ঘরের মেয়েরাই বাল্যবিবাহের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এর ফলে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সমতামুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এই বিষয়গুলো তেমন আলোচিত হয় না।
প্রথম আলো : প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নারীরাই সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত, এর কারণে বাল্যবিবাহ বেড়ে যায়। এই বিষয়টি কীভাবে আমলে নেওয়া যায়?
ক্রিস্টিন হান্টার : জলবায়ু পরিবর্তন ও জেন্ডার নিয়ে আমরা অনেক কাজ করছি। সমাজে যে-ই অরক্ষিত হোক না কেন, তার মুখ্য কারণ হচ্ছে অসমতা। নারীরা পুরুষের সমান নয় বলে তারা অরক্ষিত হয়ে পড়ে। লৈঙ্গিক অসমতা আমরা যত বেশি দূর করতে পারব, তত বেশি আমরা নারীদের অসহায়ত্ব দূর করতে পারব। নিজেদের জীবনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে, সমাজে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ও তা সামলানোর ক্ষেত্রে নারীদের আরও বেশি অংশগ্রহণ থাকা দরকার। নারীদের পুরুষের সমান মজুরি পাওয়া ও শ্রমের সমান সুযোগ পাওয়া উচিত। ফলে দুর্যোগ ঘটলে নারীরা যেকোনো কিছুর ওপর নির্ভর করবে, তার জো থাকে না। কারণ, তাদের সম্পদ লাভের সুযোগ নেই।
অন্যদিকে নারীদের রেজিলিয়েন্স (ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা) তৈরির চেষ্টা আমাদের করতে হবে। এর জন্য নারীর ক্ষমতায়ন দরকার। কিন্তু তার যদি সম্পদই না থাকে, তাহলে সে এই ক্ষমতা অর্জন করবে কীভাবে?
আর দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহকে বিকল্প হিসেবে দেখা হয়। আর নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা দুর্যোগ-পরবর্তী দুর্যোগ বাড়িয়ে দেয়। অনেক বিষয়ই এখানে উল্লেখ করা দরকার। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে নারীদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা নেই, ল্যাট্রিনে আলোরও ব্যবস্থা নেই। পানের পানির স্বল্পতার কারণে নারীদের বহু দূরে গিয়ে তা সংগ্রহ করতে হয়, ফলে তাদের বিপদের আশঙ্কা বাড়ে। বাল্যবিবাহ ও সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যায়।
কথা হচ্ছে, দুর্যোগ প্রস্তুতির মাধ্যমে এসবের আশঙ্কা কমিয়ে আনতে হবে। এগুলো ঠিকঠাক হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্য নারী সংগঠনগুলো সহযোগিতা ও মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নারীদের ওপর অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপে। উপকূলীয় এলাকায় দেখা যায়, পুরুষেরা মৌসুম ভিত্তিতে অভিবাসন করে, ফলে ঘর থাকে পুরুষশূন্য। এতে নারীদের গৃহস্থালির কাজের পাশাপাশি পরিবারের উপার্জন বাড়াতেও কাজ করতে হয়, আবার লবণাক্ততার জন্য তাদের খাওয়ার পানি আনতেও অনেক দূরে যেতে হয়। ফলে তাদের কর্মসময়ের পরিধি দেখে আমাদের বিভ্রান্ত হতে হয়।
প্রথম আলো : বাংলাদেশের নারীদের কোনো বার্তা দিতে চান?
ক্রিস্টিন হান্টার : মূল বার্তা হলো, নারীদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। তাদের অধিকার আছে, সেটার স্বীকৃতি দিতে হবে। উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাদের সম–অংশীদার হিসেবে গণ্য করতে হবে। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু নারী অধিকার সংগঠনগুলো আবার এর জন্য অপেক্ষা করে থাকতে পারে না। আইনি, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে নারীর মূল্য স্বীকার করে নিতে হবে। নারীর জন্য সম্পদ বিনিয়োগ করতে হবে।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ
ক্রিস্টিন হান্টার : আপনাকেও ধন্যবাদ।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
ক্রিস্টিন হান্টার: ইউএন উইমেন ইন বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ।