সৈয়দ হাসান ইমাম: লেটার মার্ক-৮০

সৈয়দ হাসান ইমাম
সৈয়দ হাসান ইমাম

যখন সীমান্তের পথে পাড়ি দিয়েছি, তখন আমার গন্তব্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। নিশ্চিত হয়েছি, সৈয়দ হাসান ইমাম ওখানে আছেন। তাঁর কণ্ঠস্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী চেনার আগেই আমি চিনে ফেলেছি। আগরতলা হয়ে সুদীর্ঘ যাত্রার পর কলকাতা পৌঁছাতেই অনেক সুহৃদের সঙ্গে দেখা। আমার প্রথম প্রয়োজন হাসান ইমাম ভাইকে। পার্ক সার্কাসে দেখা হয়ে গেল। হাসান ভাই তাঁর প্রশস্ত বুকে উদাত্ত আলিঙ্গনে গ্রহণ করলেন। সুদীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি ভুলে গেলাম। হাসান ভাই আমাকে নিয়ে গেলেন তাঁর মামা মনসুর হাবিবুল্লার বাড়িতে, যিনি সিপিএম আমলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী ও পরে স্পিকার হয়েছিলেন। তখন তিনিও লড়াকু। কংগ্রেসের নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়ছেন। বড়ই রসিক মানুষ। রস করে অনেক কথাই বললেন, স্মৃতিচারণা করলেন সেই অবিভক্ত বাংলার কথা। আবদুল হাশিম সাহেব সে সময় বাংলার বড় নেতা। তাঁদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। এদিকে আমার মন আনচান। কখন যাব স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। হাসান ভাই বুঝতে পারলেন। একসময় বললেন, ‘চল’।
আমার মাথায় তখন নজরুলের গান: চল্ চল্ চল্! ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল।
পৌঁছে গেলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। তখন সেটি আমাদের ধমনির কেন্দ্র। দেখা হয়ে গেল সব বন্ধুর সঙ্গে। সে সময় আমার বয়স ২৩, অধিকাংশই আমার চেয়ে বয়সে বড়। হাসান ভাই বললেন, ‘এই যে, মামুন এসে গেছে। নাটক দে।’ আমি বাংলাদেশের যুদ্ধাবস্থার মধ্যে থেকেও ১৯৭১ সালের ১ ফেব্রুয়ারিতে প্রচারিত আমার লেখা নাটক আবার আসিব ফিরের পাণ্ডুলিপি হাতছাড়া করিনি। হাসান ভাই বলার সঙ্গে সঙ্গে কাপড়ের ব্যাগ থেকে পাণ্ডুলিপিটি বের করে দিলাম।
হাসান ভাই পাণ্ডুলিপিটি হাতে নিয়ে বললেন, ‘বাহ্! খুব ভালো নাটক। আমি দেখেছি।’ উপস্থিত সবাই একযোগে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমরাও সবাই দেখেছি। দারুণ!।’ সাউন্ড ইঞ্জিনিয়াররা বললেন, ‘কবে রেকর্ডিং করবেন?’ হাসান ভাই বললেন, ‘ঠিক আছে, কিন্তু এটা তো টেলিভিশনের জন্য, বেতারের উপযোগী করতে হবে না?’ বুঝতে পারলাম, সঠিক কথাই তো। আমি বলে উঠলাম, ‘কালকেই করে দিচ্ছি।’ হাসান ভাই শান্ত গলায় বললেন, ‘তুই ঠিক কর, যুদ্ধ তো কালই শেষ হয়ে যাবে না। দু-এক দিন সময় নিয়ে করে দে।’ এরপরই একটি কথিকা পড়তে গেলেন। বললেন, ‘আমি সালেহ আহমেদ বলছি। সৈয়দ হাসান ইমাম হয়ে গেলেন সালেহ আহমেদ। শব্দতরঙ্গে তা কোটি কোটি মানুষের অন্তরে পৌঁছে গেল।
দুই দিন বাদেই নাটকটি বেতারের উপযোগী করে দিলাম। এবং প্রচার হয়ে গেল বেশ কয়েকবার। এবার নাটকের নাম মৃত্যুহীন প্রাণ। আমি যুক্ত হলাম স্বাধীন বাংলা বেতারের সঙ্গে। এরপর রাস্তাঘাটে একটা সমস্যা হতে শুরু হলো। হাসান ভাই বা মামুন বলে ডাকলেই সবাই তাকায়। কেউ আবেগের আতিশয্যে আবার কেউ কেউ শত্রুতামূলক দৃষ্টিতে। সবাই যে আমাদের পক্ষে ছিল, তা না। তাই আমরা একেকজন একেকটা নাম নিলাম। হাসান ভাইয়ের নাম ভোলা দা, আমি নন্দ। হাসান ভাইয়ের ট্যান্ডেল হয়ে ঘুরে বেড়াই। কারণ, কলকাতা হাসান ভাইয়ের নখদর্পণে। এর মধ্যে অনেক মজার অভিজ্ঞতা হয়। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিন পয়সার পালা দেখতে গিয়েছি। টিকিট পেলাম কিন্তু টাকা লাগল না। তখনো বুঝিনি। নাটক শেষে যখন গ্রিনরুমে গেলাম, তখন দেখলাম অজিতেশের মেকআপ তোলা হয়নি, সেই অবস্থাতেই হাসান ভাইকে আলিঙ্গন করলেন, ‘কি রে হাসান, কেমন আছিস?’ আমরা তো অবাক! অজিতেশ বললেন, ‘আমরা বর্ধমান স্কুলে একসঙ্গে পড়তাম। স্কুলে নাটকও করেছি, ফুটবলও খেলেছি।’ তারপর আমাদের সঙ্গেও আলিঙ্গন করলেন। এর মধ্যেই আমাকে হাসান ভাই পরিচয় করালেন একজন নাট্যকার হিসেবে। ভীষণ লজ্জা পেলাম। তারপর যেদিন দেখা, সেদিন তাঁর রচিত সব নাটক দিলেন। পাতায় পাতায় লেখা, ‘একজন তরুণ নাট্যকারকে শুভেচ্ছা—অজিতেশ।’ বায়না ধরলাম, ‘হাসান ভাই, উৎপল দত্তকে দেখব।’ তত দিনে আমি তাঁর টিনের তলোয়ার দেখে ফেলেছি। প্রবল আগ্রহ তাঁকে দেখব। তিনি তখন জয় বাংলা ও ঠিকানা নামে দুটি নাটক লিখে নামিয়েও ফেলেছেন। সেগুলোও দেখেছি। হাসান ভাই আবারও বললেন, ‘চল’। চললাম উৎপল দত্তের বাড়ি। তিনি বাড়িতেই ছিলেন। আন্তরিক অভ্যর্থনা। হাসান ভাই আবারও লজ্জা দিলেন, আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে। উৎপল দত্ত বলে উঠলেন, ‘তাহলে দিন একখানা নাটক লিখে।’ আমার তো পালানোর মতো অবস্থা।
মুস্তাফা মনোয়ার তখন কলকাতায়। তাঁর প্রেরণায় একটা নাটক লিখতে শুরু করি। সে কী নাটক লেখা! রাতভর, দিনভর। রাতের বেলায় পত্রিকার কাগজের ওপর শুয়ে থাকা। আমি আর বাদল রহমান। নাটক লেখার পর নামকরণ হলো পশ্চিমের সিঁড়ি। এই নাটককে ঘিরে সব শিল্পীর আনাগোনা, সেখানেও মুখ্য হাসান ভাই। কলকাতায় যত শিল্পীর বিপদ-আপদ—সবকিছুতেই তিনি মুখ্য। কলকাতায় বসেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ চলচ্চিত্রের কী হবে তার একটা রূপরেখা দরকার। জহির রায়হান লিখলেন। একেবারেই সমাজতান্ত্রিক দেশের চলচ্চিত্রের রূপরেখা। হাসান ভাইয়ের সেখানেও একটা বড় ভূমিকা। যা-ই হোক সালেহ আহমেদ, ভোলা দা নামটি অবলুপ্ত হয়ে দেশে ফিরলেন। ব্যস্ত হয়ে উঠলেন আবার চলচ্চিত্রশিল্প নিয়ে।
শিল্পীদের সংগঠিত করা, কল্যাণকর কিছু চিন্তা, আগবাড়িয়েই সব জায়গায় পৌঁছে যাওয়া, অসুস্থ শিল্পীদের পাশে দাঁড়ানো—হাসান ইমাম এসব করতেন বহু আগে থেকেই। সেই পাকিস্তান আমল থেকে আজ অবধি। সেই ষাটের দশকে বিক্ষুব্ধ শিল্পীসমাজের কথা আজও ভুলিনি আমরা। বিক্ষুব্ধ শিল্পীসমাজের কাজ করে তিনি আবার রক্তকরবীতে অভিনয় করছেন। আবৃত্তি করে মানুষকে জাগিয়ে তুলছেন।
আজ তাঁর ৮০তম জন্মদিনে আমরা যাঁরা টিনের তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করি, তারা সবাই মিলে অভিনেতা-আবৃত্তিকার-সংগঠক হাসান ইমামকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই এবং দীর্ঘজীবী হওয়ার কামনা জানাই।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব।