পথের শেষ কোথায়, খালেদা জিয়া কি জানেন?

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

খালেদা জিয়া আবার পথে নেমেছেন। কিন্তু পথের শেষে কী আছে, তিনি কি তা জানেন? মসনদের পথ খাদের দিকেও আগায়। তাঁর হাতের মুঠিতে বড় ঝড়ের লাগাম। লাগাম ছেড়ে দিলেই তুফান বয়ে যাবে; তা সামলিয়ে তিনিও দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন তো? ঝড়ের লাগাম কখনো ছাড়তে নেই।
আলোচনার মায়ার খেলা অচিরেই ফুরাবে; তখনই সামনে আসবে আপস অথবা বলপ্রয়োগের প্রশ্ন। আপসের পথেসংবিধান, ফর্মুলা ইত্যাদির অজুহাত দিলে পুরান ঢাকার ঘোড়াগুলোও হাসবে। আপসে দুই পক্ষই জেতে, দুই পক্ষই হারে। সে রকম ভারসাম্যপূর্ণ আপস না হলে বলপ্রয়োগই ভরসা। সরকার তার সব বাহিনী, প্রতিষ্ঠান আর কলকবজা বিরোধীদের দমনে লাগাবে। বিরোধীদলও জ্বালাও-পোড়াও পথে সরকারকে অকার্যকর করতে চাইবে। দুটোই জনগণকে রাজনীতির মাঠ থেকে খেদিয়ে রাখার কৌশল। জনহীন রাজপথে জননিরাপত্তার নামে বলপ্রয়োগের সুযোগ হাতছাড়া করবে না সরকার। বিরোধীদলীয় নেত্রী কি সেই সুযোগটাই সরকারের হাতে সেধে তুলে দিতে চান? নাকি চান অন্য কোনো শক্তির বলপ্রয়োগ?
ক্ষমতা চালানো ও ক্ষমতা বদলের সব শান্তিপূর্ণ আয়োজন যখন নস্যাৎ হয়, তখনই বলপ্রয়োগের মৌসুম আসে। হরতাল-নাশকতা, দমন-পীড়ন জরুরি অবস্থা তখন অনিবার্য। বিরোধী দলের কর্মসূচির ফলে যদি তেমন অকাল আসে, তাহলে সরকার নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের বাধ্যবাধকতা মুক্ত হয়ে নেমে পড়বে একদলীয় নির্বাচনে। গণতন্ত্র রক্ষার নামেই হোক আর নিয়মতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার কথা বলেই হোক, সহিংস পরিস্থিতি ক্ষমতাসীনদেরই পক্ষে যেতে পারে। খালেদা জিয়া সেটাই চান?
ঘোলা পানিতে প্রতিবিম্ব পড়ে না। পানি বেশি ঘোলা করে ফেলে বলে গাধা কখনো নিজের মুখ দেখতে পারে না। রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে দুই জোট-মহাজোট এতই ঘোলা করে ফেলেছে, এই জল এখন চতুর শিকারিদের আদর্শ ক্ষেত্র। তার পরও সবারই নিজেদের মুখ দেখে নেওয়া উচিত। রাজনৈতিক সমাজ দুই শিবিরে ভাগ হয়ে সত্য ও যুক্তি বিসর্জন দিয়ে পরস্পরকে দোষাচ্ছে। পরস্পরের প্রতি এতই ঘৃণা তাদের, পারলে তারা বিদেশি ঠাকুরের খেদমত করবে কিন্তু দেশি ভাইকে ‘কুকুরের’ মতো দূর দূর করে। আমি যদি আপনাকে ঘৃণায় অন্ধ হই, তাহলেআপনাকে আমি আর জানতে পারব না। নিজেকেও না। এই দোষাদুষির কুস্তি যত চলবে, ততই বিভাজন বাড়বে, বাংলাদেশ বলে আর কিছু থাকবে না। থাকবে শুধু লীগ আর দলে বিভক্ত ছারখার বাস্তবতা।
গুণ নয় দোষই সংক্রামক। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র এক দেড় লাখ মানুষ দলকানা ও ঘৃণার পূজারি। অথচ রাজনীতির জলবায়ু এঁরাই নিয়ন্ত্রণ করছেন। পাড়া-গ্রামে দুই দলের ভোটাররা প্রতিবেশীর মতোই বাস করেন। এক পরিবারেই পাওয়া যাবে দুই ভিন্ন দলের নেতা-কর্মী। সেচের পানি বিএনপিপন্থীর জমির ওপর দিয়েই লীগপন্থীর জমিতে যায়। ব্যবসায়ীরা মুনাফার খাতিরে সম্পূর্ণদলনিরপেক্ষ বন্দোবস্ত করে রেখেছেন। রাজনীতিবিদেরাই কেবল বারেবারেঅযোগ্যতার প্রমাণরাখছেন। তাঁদের ইন্ধন দিতে মুখিয়েআছে কিছু কুদুলে বুদ্ধিজীবী আর আলুপোড়া খেতে আগ্রহী কিছু সুযোগসন্ধানী।
আমাদের রাজনীতির চেহারাটা গ্রিক উপকথার প্রাণী সেন্টরের মতো অর্ধেকটা মানবিক অর্ধেকটা পাশবিক। রাজনীতির ওপরের চেহারাটায় যতই মুক্তিযুদ্ধ, ইসলাম, জাতীয়তাবাদ, উন্নয়নের বুলি থাকুক, নিচের দিকে তা পরিবারতন্ত্র, দুর্নীতি, বলপ্রয়োগ ও গণবৈরিতার চতুষ্পদে প্রতিষ্ঠিত। এই পরিবারতন্ত্র দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত বিত্ত দিয়ে বলপ্রয়োগের ক্ষমতা বানায়। দলের লোকদের দুর্নীতির ভাগ, মধ্যবিত্তকে আদর্শের লজেঞ্চুস আর বৃহত্তর জনতাকে ধোঁকা দিয়েএই রাজনীতি চলে। বাধ্য না হলে এই রাজনীতি কাউকে ছাড় দেয় না। ক্ষমতার বণ্টন, সম্পদের বণ্টন এই রাজনীতি জানে না।
জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করাই যেকোনো রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য হওয়ার কথা। নিজের পক্ষে বেশির ভাগ মানুষকে নিয়ে আসাই নেতার ক্যারিশমা। অথচ বাংলাদেশের দুটি বড় দলের আদর্শ ও কর্মসূচির লক্ষ্যহলো ভাগ করো, শাসন করো। দুই উগ্র জাতীয়তাবাদ দেশের কাজে না এলেও, বিপুলসংখ্যক মানুষের চেতনানাশে ওস্তাদ। মেয়াদ ফুরানো ওষুধের মতো এসব আজ বিপজ্জনক। তার পরও বিকল্পেরঅভাবে এই রাজনীতি ও এর সমর্থন আরও কিছুদিন থাকবে। রাজনীতি থাকলে তাদের সমর্থকও থাকবে দেশে। অথচ নেতা-নেত্রীরা যেভাবে পরস্পরকে আক্রমণ করেন, তাতে মনে হয় এক পক্ষের কাছে অন্য পক্ষ হারাম। দুই দলের পক্ষে থাকা কোটি কোটি মানুষকে তাঁরা কী করবেন? বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়েদেবেন?
যুদ্ধাপরাধের বিচার আর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি অধিকাংশ মানুষের সমর্থন পেয়েছিল। কিন্তু দুই দল দুই ইস্যুকেই বিতর্কিত করে দেশকে বিভক্ত করতে কামিয়াব হয়েছে। এর দায় দুই পক্ষেরই। সমঝোতা চাইলে উভয় পক্ষকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে: বিচারও চলবে, নিরপেক্ষ নির্বাচনও হবে। আর দুই দল যদি সমঝোতায় আসে, কারও সাধ্য নেই ‘তৃতীয়’কাউকে ক্ষমতায় আনে।
মীমাংসা চাইলে এই মুহূর্তে সহিংসতা আর ঘৃণার প্রকাশ থামাতে হবে। সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধের আদেশ কি সরকার-সমর্থকদের ওপর খাটে না? হরতাল যদি উসকানি হয়, হরতাল ঠেকানোর কর্মসূচি কি বরযাত্রা? উভয় পক্ষকেই ঘোড়া সামলাতে হবে। দেশবাসীর সমর্থন চাইলে খালেদা জিয়াকেও বিকল্প পথ বের করতে হবে। মানুষের কাছে যাওয়ার পথ সব সময়ই খোলা। লগি-বইঠা-দা-কুড়াল হাতে করে সেটা হয় না। এগুলো প্রতিবাদের অস্ত্র নয়, সন্ত্রাসের অস্ত্র। এর বাইরে ব্যাপক গণ-অসহযোগ কিংবা গণজাগরণের জন্য তিনি আর কী করতে পারেন, তা তাঁকেই ভাবতে হবে। গণজাগরণ চাইলে যেতে হবে মানুষের কাছে, তরুণ-তরুণীদের কাছে। তাদের কাছে নিজেকে দেশের সম্ভাবনার জিম্মাদার প্রমাণ করতে হবে। তা না করে যতই পাল্টা বলপ্রয়োগের পথে যাবেন, ততই তাঁকে নির্ভর করতে হবে সন্ত্রাসী শক্তির ওপর। বিপরীতে সরকার নির্ভর করবে পুলিশ-বিজিবি-র‌্যাব ও লীগের ক্যাডারদের ওপর। সরকারের সুবিধাই এখানে বেশি। সরকারপক্ষ পাবে আইনের আশ্রয়, বিরোধী পক্ষের তেমন আশ্রয় নেই। থাকত, যদি বিএনপি গণ-অভ্যুত্থান ঘটানোর সামর্থ্যরাখত। কিন্তু শেখ হাসিনা মিসরের মোবারক নন, খালেদা জিয়াও নন ক্ষমতাচ্যুত মোহাম্মদ মুরসি।
কিন্তু দিন যাচ্ছে আর পথ আটকে যাচ্ছে। কুড়িগ্রামের ভূমিহীন মাজেদ আলী ঢাকায় রিকশা চালান দুই বছর ধরে। বয়স ৭৫। তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, এক ছেলে হাইস্কুলে, আরেক ছেলে কলেজে পড়ে। স্ত্রী জরায়ু ক্যানসারে ধুঁকছেন। বাঁচবে না জেনেও চিকিৎসা চালাচ্ছেন, ছেলেদের কামাই খাওয়ার আগেই আয়ু ফুরাবে জেনেও দুই ছেলেকে প্রতিদিন ২০০ টাকা খরচ দেন। বস্তির ঘরভাড়া দেন, নিজে খান, বউকে খাওয়ান। কারও কাছে তাঁর কোনো আশা নেই। তাঁর রিকশায় বসে পেছন থেকে দেখি, সাদা টুপি, সাদা পাঞ্জাবি, ঘাড়ের ওপর ফেলে রাখা নামাজি উড়নি, বাতাসে ওড়া পাতলা দাড়িতে সোডিয়াম আলোয় তাঁকে দেবদূতের মতো লাগে। বয়স আর মেহনত তাঁর পিঠ বাঁকিয়ে দিয়েছে। কত দুর্বলমানুষ, অথচ মধ্যরাতে আমার সমর্থনে ঘুষখোর পুলিশের সঙ্গে তর্ক করেন। তারপর আমি বাড়ি ফিরি, তিনি আবার নামেন রাস্তায়। না নেমে উপায়নেই।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মাননীয় বিরোধীদলীয় নেতা, মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েও বৃদ্ধ মাজেদ আলীর থামার উপায়নেই। এক দিনের কামাই নষ্ট হওয়া মানে ছেলেদের পড়ালেখা বন্ধ থাকা, মৃত্যুপথযাত্রী স্ত্রীকে অনাহারি রাখা। জীবনে সুন্দর মনের মানুষ একেবারে কম দেখিনি। মাজেদ আলী তাঁদের একজন। এখনো চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই, রিকশার হাতলে দুই মুঠি শক্ত করে ঘাড়-পিঠ উবু করে তিনি পথ চলছেন। বাতাসে উড়ছে তাঁর উড়নি। যে আত্মমর্যাদা আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে সংসার চালাচ্ছেন, সেটুকু দায়িত্বশীলতা আপনারা দেখাবেন কি? আপনারা যা-ই করেন, মনে রাখবেন বাংলাদেশও সমস্যার ভারে নুয়েআসা ওই বৃদ্ধের মতো। আমাদেরও থামবার সুযোগ নেই, আমাদেরও ভরসা করার বন্ধু নেই পৃথিবীতে।
প্রতিটি হরতাল, প্রতিটি পুলিশি অ্যাকশনে, আমি দেখতে পাই মাজেদ আলীর পিঠে বাড়ি পড়ছে। মাটির দিকে আরও নুয়েযাচ্ছে তাঁর পিঠ; তবু লোকটা থামতে পারছেন না। বউয়ের চিকিৎসা, ছেলেদের পড়ালেখা চালানো আর জীবনের বাকি কটা দিন ভিক্ষা না করার অসীম জেদের কারণেই মাজেদ আলী থামবেন না। বাংলাদেশের কোটি কোটি মাজেদ আলী দেশের মাটিতে বা বিদেশবিভুঁইয়ে দেশটাকে পিঠে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মাননীয়গণ, আপনাদের অনেক উপায় আছে, মাজেদ আলীদের নেই। ওরা থামবে না, দয়া করে আপনারাই থামুন।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
[email protected]