বিএনপি: 'হায়রে কপাল মন্দ, চোখ থাকিতে অন্ধ'

যখন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিচারে অনেকের মনে আনন্দ, তখন আনন্দমেলার এক কোণে দাঁড়িয়ে বিএনপি বিবৃতি দিয়েছে, ফাঁসির দণ্ডাদেশ নিয়ে তারা শুধুই ‘হতাশ, বিস্মিত, মর্মাহত ও সংক্ষুব্ধ’। প্রতিবাদী নয়, হরতালমত্ত নয়, শুধুই হতাশ। মন্দের ভালো তো একরকম ভালোই। এটাও তেমন এক ‘ভালো’। আশা করা যায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে বিএনপি কৌশলগতভাবে সমালোচনামুখর থাকলেও নীতিগতভাবে একে মেনে নেবে। এই দলে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন ও আছেন। এই দলে অনেক যুদ্ধাপরাধী এখনো আছেন, যেমনটা আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিতেও কিছু কিছু আছে। আর জামায়াতে ইসলামী তো যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবেই পরিচিত। পার্থক্য এখানেই, লীগ মুক্তিযুদ্ধকে পুঁজি করে, বিএনপি সেই পুঁজি ভেঙে ‘রাজাকার’ ক্রয় করে। এ যেন ‘শুধু জানালার লোভে বেচে দিলাম ঘর-দরজা’! এ ব্যাপারে তাদের কাছ থেকে আরও স্পষ্ট ও স্বচ্ছ অবস্থান দেশবাসী প্রত্যাশা করে।
বাংলাদেশের জ্ঞানবুদ্ধি হওয়া মানুষের মধ্যে দুটি অপূর্ব রাজনৈতিক সমঝোতা হয়ে আছে। শহীদজননী জাহানারা ইমামকে ধন্যবাদ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে দেশের সাবালক সমাজে তেমন দ্বিধা নেই। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকেও ধন্যবাদ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যে নিরপেক্ষ সরকার দরকার, সেটাও তাঁরা একদিন জনগণকে বুঝিয়ে ছিলেন। যে ভোলে ভুলুক, গণহত্যার বিচার আর গণতন্ত্রের বিষয়ে এই সমঝোতা ছাড়া এগোনো কঠিন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিএনপির আচরণ শত্রুজ্ঞানে ভজনার মতো। বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনিতে চাঁদ সওদাগর নিতান্ত বাধ্য হয়ে সন্তানের প্রাণ বাঁচাতে মনসা দেবীকে বাঁ হাতে পূজা দিয়েছিলেন। ডান হাতের ভক্তির বিপরীতে এই বাঁ হাতের দানকে বলে শত্রুজ্ঞানে ভজনা করা। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও ইতিহাসের প্রতি বিএনপির এই খুঁতযুক্ত ভজনার নিট ক্ষতি হলো: মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জাতীয় মীমাংসা না হওয়া; তা আওয়ামী লীগের একচেটিয়া সম্পত্তি হয়ে থাকা। বিএনপির এই কপটতার সুযোগ পুরোপুরি নেয় জামায়াত। বিএনপি যেন চিরশিশু পিটারপ্যানের মতো, বয়স বাড়ে কিন্তু বুদ্ধি বাড়ে না।
বিএনপির প্রিয় গানটা মনে হয় ফকির লালন সাঁই-ই গেয়ে রেখেছেন: ‘থাকতে রতন ঘরে, এ কি বেহাত আজ আমারি/ আপন ঘরে পরের সংসার, আমি দেখলাম না রে তার বাড়িঘর’। বিএনপির পেছনে জনসমর্থন ছিল, আছে। তবু বিএনপির আন্দোলনে জনগণ ভরসা পেল না। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের ভাগও তাদের হাতছাড়া প্রায়। দুই দল যতই বিবাদ করুক, দেশবাসী রাজনীতি ও শাসন বিষয়ে মৌলিক সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে ফেলেছে। বিচার চলবে, গণতন্ত্রও লাগবে: এ সমঝোতা জনগণের মন থেকে সরানো সহজ নয়।
এটা হাওয়ার ওপর তাওয়া ভাজার মতো করে বলা কথা নয়, এর প্রমাণ আছে। প্রথম আলোর উদ্যোগে ওআরজি-কোয়েস্ট রিসার্চ লিমিটেড পরিচালিত একাধিক জরিপে এ দুটি বিষয়ে দেশের বেশির ভাগ সাবালক মানুষ ‘হ্যাঁ’সূচক উত্তর দিয়েছে। ২০০৯ সালের জনমত জরিপে ৮৬ শতাংশ মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছিল। ৭৪ শতাংশ মানুষ এ ব্যাপারে মহাজোট সরকারের ওপর আস্থা রেখেছিল। আওয়ামী লীগ সরকার বিষয়টি উপলব্ধি করে। তাই যখনই হালে পানি কমে, তখনই বিচারের পালে জোরসে হাওয়া দেওয়া হয়। বিএনপি-ই শুধু বিষয়টি বুঝতে অপারগ।
আওয়ামী লীগ বুঝেও বুঝে না যে কেন ৯০ শতাংশ মানুষ নির্দলীয় বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন করার পক্ষে। রাজনৈতিক বা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ মানুষ। এটাও প্রথম আলোর উদ্যোগে ওআরজি-কোয়েস্ট রিসার্চ লিমিটেড পরিচালিত জরিপের ফল। ২০১১ ও ২০১২ সালের জনমত জরিপে যথাক্রমে ৭৩ ও ৭৬ শতাংশ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মত দিয়েছিল। মাত্র ছয় মাসে (আগের জরিপ করা হয়েছিল অক্টোবর, ২০১২) অর্থাৎ ২০১৩ সালের এপ্রিলে এসে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে জনমত বেড়েছে ১৪ শতাংশ বেশি। কারণ, বিরোধীদের প্রতি সরকারের অসহিষ্ণু আচরণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বাড়াবাড়ি।
যুদ্ধাপরাধের বিচার কোনো না কোনো দিন হতোই। হয়তো আরও ভালোভাবে হতো। কিন্তু হতেই হতো। এ অনিবার্যতার পথে বিএনপির বাগড়া দিয়ে থাকাটা আত্মঘাতী। তারা গঠনমূলক ভূমিকা নিলে বিচার–প্রক্রিয়া আরও সবল ও নিষ্কণ্টক হতো। যেভাবেই হোক, সময় বিএনপির জন্য সুযোগ এনেছিল সংশোধনের। এতে তাদের ক্ষতি হতো না, বরং নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তাদের দাবি আরও জোরদার হতো। জামায়াত যে কারণে বিচার না মানতে বাধ্য, বিএনপির তো তেমন ঠেকা ছিল না! জনমনে এ থেকে জন্মানো সন্দেহ তাদের সার্বভৌমত্বের রাজনীতির পথের কাঁটা হয়েই থাকবে।
বারে বারে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক ইস্যু যে রাজনীতির নদীতে বান নিয়ে আসে, তার কারণ আছে। লাখো পরিবার ভুক্তভোগী, কোটি তরুণ শহীদদের প্রতিদান দিতে চায়। তা ছাড়া, রাজনীতির জন্য এর চেয়ে বড় আদর্শ আর আবেগের দেখা তো মিলছে না! আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা এই বাস্তবতা যতটা চেনেন, বিএনপি ততটাই বেখেয়াল। বিএনপির সংগঠন না হয় সরকারের চাপে-তাপে কাবু, আদর্শিকভাবে তারা দুর্বল কেন? মানুষ শুধু সরকার বিরোধিতা নেবে না, বিকল্প আদর্শ ও উন্নত রাজনীতিও দেখতে চাইবে।

>এই দফায় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতার এই আপাত-ভারসাম্য বদলে দিতে পেরেছে। কিন্তু জনমনে আবার এরশাদ আমলের মতো একচেটিয়াতন্ত্র কায়েমের আশংকাও জাগছে। অর্থনীতি এখন অনেক বড়, ক্ষমতার শিকড়-বাকড়ও এখন অনেক গভীরে এবং জনমতের প্রকাশ ঘটানোর প্রযুক্তি এখন সবারই হাতের মুঠোয়

দিনের শেষে, রাজনীতির গল্পটা আর বাঁদরের তেলতেলে লাঠি বেয়ে ওঠার কসরত হয়ে নেই, প্রতিযোগীরা এখন লাঠিটাই ভাঙতে নেমেছে। রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমাজে অস্বাস্থ্যকর বিতিকিচ্ছি অবস্থা। নব্বইয়ের সব অর্জন ভেসে যাচ্ছে। তিন জোটের রূপরেখায় শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতায় আরোহণ ও ক্ষমতা হস্তান্তরের পদ্ধতি জয়ী পক্ষই সব পাবে, এই ভয়টা কমিয়ে দিয়েছিল। সবারই মোটামুটি সুযোগ পাওয়ার এই নিশ্চয়তা ছাড়া রাজনীতি শান্তির পথে থাকবে না। আর শান্তি থাকলে, প্রতিপক্ষের মনে বিলীন হওয়ার ভয় না থাকলে, সমাজ-অর্থনীতি বিকশিত হয়, প্রতিষ্ঠান দাঁড়ায়। নাগরিকদের মনে আস্থার সৃষ্টি হয়, উদ্যমী মানুষেরা সামনে এসে কাজ করতে পারে। না থাকলে কী হয়, তা বুঝিয়ে বলার দরকার নেই, চারপাশে তাকালেই বোঝা যায়।
রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি কমিয়ে আনা ছাড়াও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার আরেকটা অবদান ছিল। স্বাধীনতার পরের প্রথম ১৯ বছরে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীকে চ্যালেঞ্জ জানানোর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দাঁড়াতেই পারেনি। এরশাদের আমলের শেষের দিকে অবস্থা বদলাতে থাকে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বাম দলগুলো সংহত হয়। তাদের আর উপেক্ষা করা সম্ভব হয় না। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এভাবে বাংলাদেশে রাজনীতিতে বহুপক্ষীয় ভারসাম্য আসে। এই বহুপক্ষীয়তাই বহুদলীয় গণতন্ত্রের জমিন। নতুন বাস্তবতায় কারও পক্ষেই একচেটিয়া ক্ষমতাবান হয়ে ওঠা সম্ভব ছিল না। তার জন্য নব্বইয়ে স্বীকৃত ক্ষমতার ভারসাম্যটা ভেঙে ফেলতে হবে। বিরোধী দলকে কাবু করে, নির্বাচনের মাঠ অসমান রাখার মাধ্যমেই তা সম্ভব। বিএনপি সরকার ১৯৯৬ সালে একবার এবং ২০০৭ সালে আরেকবার এই চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে।
মনে হচ্ছে, এই দফায় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতার এই আপাত-ভারসাম্য বদলে দিতে পেরেছে। কিন্তু জনমনে আবার এরশাদ আমলের মতো একচেটিয়াতন্ত্র কায়েমের আশঙ্কাও জাগছে। অর্থনীতি এখন অনেক বড়, ক্ষমতার শিকড়-বাকড়ও এখন অনেক গভীরে এবং জনমতের প্রকাশ ঘটানোর প্রযুক্তি এখন সবারই হাতের মুঠোয়। এরকম জটিল বাস্তবতায় আশির দশকের কায়দায় দেশ চালানোর খেসারত অনেক বেশি। তাই বিএনপি যখন বর্তমান সরকারের উদ্যোগেই নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার পেতে রাজি, তখন সরকার সেই উদ্যোগ নিয়ে নিজেদের তৈরি সমস্যার সমাধান নিজেরা করে দিতে পারে। নইলে মানুষ বিকল্প খুঁজতেই থাকবে। যে জনমতের চাপে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আপসের সুযোগ বন্ধ হয়, সেই জনমত কিন্তু গণতন্ত্র রুদ্ধ করার বাসনার আগুনেও পানি ঢেলে দিতে পারে। দেশ যখন সমস্যার মাইনফিল্ড হয়ে ওঠে, তখন কোথায় কখন কীভাবে বিস্ফোরণ ঘটবে, কেউ বলতে পারে না।
রাজনীতির অন্ধত্বে জনগণের কপাল আরও মন্দ হোক, তা কেউ চায় না।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
[email protected]