বাপেক্সের সাফল্যের পথে বাধা

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন কোম্পানি (বাপেক্স) দেশে সাতটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে উৎপাদন পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে গ্যাসসম্পদ উন্নয়নে তার সক্ষমতা প্রমাণ করেছে। গ্যাসসম্পদ আহরণ ও উৎপাদনে বাংলাদেশের নিজস্ব কারিগরি, লোকবল ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা যে সার্থকতা ধারণ করতে পারে, বাপেক্স তার উদাহরণ সৃষ্টি করে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন করার সম্ভাবনাকে দৃশ্যমান করেছে। কিন্তু বাপেক্সের এই অর্জন বা তা ধরে রাখার পক্ষে যতটা সহযোগিতা কাম্য, তা কখনো সংস্থাটির ভাগ্যে জোটেনি। বিভিন্ন সময়ে সরকারি অবহেলা, অব্যবস্থাপনা, এমনকি মহলবিশেষের চক্রান্ত বাইরে বা ভেতর থেকে সংস্থাটিকে অকার্যকর করার পক্ষে কাজ করেছে।
একটি দুর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা দেশের তেল ও গ্যাসসম্পদ জাতীয় স্বার্থে সুরক্ষিত করতে পারে না, তার মোক্ষম উদাহরণ হলো প্রশাসন যখন দেশের সর্বাপেক্ষা সম্ভাবনাময় এলাকাগুলো বিদেশিদের হাতে তুলে দিয়ে জাতীয় কোম্পানিকে কেবল অল্প সম্ভাবনাময় এলাকাগুলো দিয়ে থাকে। আর নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ সরকার এ কাজ পুরোপুরিভাবে সম্পন্ন করে। দেশের সর্বোচ্চ সম্ভাবনাময় সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলের ৯, ১২, ১৩ ও ১৪ নম্বর গ্যাস ব্লক বিদেশি কোম্পানিকে লিজ দিয়ে কেবল অল্প সম্ভাবনাময় এলাকাগুলো বাপেক্সকে দেওয়া হয়। আর এর ফলে বিদেশি কোম্পানির আবিষ্কারগুলো হয় বৃহৎ, যেমন: বিবিয়ানা, জালালাবাদ, বাংগুরার মতন গ্যাসক্ষেত্রগুলো। পক্ষান্তরে বাপেক্সকে দেওয়া অল্প সম্ভাবনাময় এলাকায় স্বাভাবিকভাবে কেবলই অপেক্ষাকৃত ছোট গ্যাসক্ষেত্রগুলো আবিষ্কৃত হয়। সুতরাং, যাঁরা বিষয়টি তুলে বাপেক্সকে বিদেশি কোম্পানির তুলনায় খাটো করে দেখাতে চান, তাঁরা নেহাতই বিদেশিদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট।
সম্প্রতি সরকারি সহযোগিতা বাপেক্সের অবকাঠামোগত উন্নয়নে (যেমন নতুন রিগ যন্ত্র সংযোজন) সাহায্য করেছে বটে, কিন্তু নীতিনির্ধারণী মহলে চলমান সনাতনী ধীরগতির রীতিনীতি অপরিবর্তিত থাকায় বাপেক্স তার কার্যক্রম চালাতে কখনো অহেতুক জটিলতায়, কখনো একরকম স্থবিরতায় আটকে পড়ে। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের মতো বৃহৎ ও জটিল কার্যক্রম অন্য দশটি কর্মকাণ্ড থেকে ভিন্নতর এই অর্থে যে এখানে কোনো কোনো সময় ত্বরিত সিদ্ধান্ত ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য হয়ে পড়ে, যা না করলে সমগ্র অনুসন্ধান কার্যক্রম বিপদের সম্মুখীন, এমনকি ব্যর্থ হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের সরকারি আমলা দ্বারা পরিচালিত চলমান নীতি ও পন্থায় ত্বরিত সিদ্ধান্ত ও ব্যবস্থাপনার বিষয়টি অনুপস্থিত। নিম্নোক্ত উদাহরণটি প্রাসঙ্গিক বটে।
বাপেক্সের গ্যাস অনুসন্ধান কূপটি আটকে রইল: পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মোবাররকপুর কূপ খনন প্রকল্পটি শুরু করা হয় ২০১৪ সালের জুলাই মাসে। সাধারণভাবে চার মাসের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্য নিয়ে কূপটি ৪৬ হাজার মিটার গভীর পর্যন্ত খনন করার জন্য কাজ শুরু হলে বাপেক্সের কর্মীদের কাছে তা বেশ চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়। এটি এ কারণে যে এই প্রথমবার দেশের পশ্চিমাঞ্চলে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ভূতাত্ত্বিক কাঠামোতে (স্তরবিন্যাস কাঠামো) গ্যাস সম্ভাবনা যাচাই করা হবে এবং তা আবিষ্কৃত হলে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সম্ভাবনার নতুন এক দিগন্ত উন্মোচিত হবে। প্রথম তিন মাসের মধ্যেই বাপেক্সের অনুসন্ধান কূপটি ৪৩ হাজার মিটার গভীরতায় পৌঁছে যায়। কেবল তা-ই নয়, এই গভীরতার মধ্যে দুটি গ্যাস স্তর উপস্থিতির আভাস পাওয়া যায়। গভীর কূপ খননে কোনো প্রকার জটিলতা খনন কার্যক্রমকে কখনো ব্যাহত করতে পারে এটি সর্বজনস্বীকৃত এবং এহেন জটিলতা মেটানোর জন্য তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য।
দুর্ভাগ্যক্রমে বাপেক্সের কূপটিতে আশার আলো যখন উঁকি দিচ্ছিল, তখনই খনন পাইপটি কূপের ভেতর জটিলতার কারণে আটকে যায়। তাকে টেনে তুলতে না পেরে কারিগরি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি স্থান থেকে তা কেটে ওপরে বের করে আনা
হয়। কারিগরি বিবেচনায় এর পরের কাজটি সাইড ট্র্যাকিং। অর্থাৎ, কূপটির সোজা পথ থেকে সরে এসে পাশ কাটিয়ে খননকাজ চালিয়ে নেওয়া। লক্ষ্যটি ঠিক হলেও তারপরই আসে বিপত্তি। এ বিপত্তি কারিগরি নয়, বরং প্রশাসনিক বা আরও সুনির্দিষ্টভাবে প্রশাসনিক স্থবিরতা। সাইড ট্র্যাকিং কাজটি করতে একধরনের যন্ত্র লাগে, যা কিনা দেশে নানান সার্ভিস কোম্পানির কাছে রয়েছে।
যেকোনো বেসরকারি তেল কোম্পানি এ পরিস্থিতিতে সার্ভিস কোম্পানি থেকে এই সাইড ট্র্যাকিং খননের ব্যবস্থা করে তাৎক্ষণিকভাবে কূপ খনন শুরু করত। কিন্তু বাপেক্স তা পারে না, কারণ তাকে সে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। তাই এই সার্ভিস নিতে হলে লাগবে সরকারি অনুমোদন, পরিবর্তন করতে হবে ডিপিপি (আদি খনন প্রকল্প), আর্থিক জোগানের ব্যবস্থা ও তার অনুমোদন। সবকিছু পার হয়ে প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে তবেই খননকাজ শুরুর প্রক্রিয়া আবার শুরু। কিন্তু তত দিনে ভূ-অভ্যন্তরে ভূতাত্ত্বিক পরিবেশ কূপটিকে যথেষ্টভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলে। আর এভাবেই অনেক প্রকল্প ব্যর্থ হয়ে যেতে দেখা যায়। আশ্চর্য হলেও সত্য যে এ রকম গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের কোনো ত্বরিত আইনি ধারা নেই, যা দিয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
পাবনার মোবাররকপুর কূপটি আটকে যাওয়ার পর প্রায় দুই মাস চলে গেছে, অথচ সরকারি ধীর নীতির ধারায় ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। আর সে কারণে বাপেক্সের কূপটি মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন বিষয়টির কারিগরি গুরুত্ব না দেখে সনাতনী ধীর নীতির পথে চলে থাকে, তাতে গ্যাস আবিষ্কারের সমূহ সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়। এ রকম ঘটনা অতীতে বাপেক্স খননকৃত বেশ কিছু কূপের ক্ষেত্রে ঘটেছে। একটি দুর্বল প্রশাসন কীভাবে একটি সবল কারিগরি কার্যক্রমকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, এর সাক্ষ্য এসব কূপ।
বাপেক্সে কারিগরি জনবলের অভাব: যেকোনো তেল-গ্যাস কোম্পানির সফলতার মূলে রয়েছে তার পর্যাপ্ত কারিগরি জনশক্তি। বাপেক্সের দপ্তর পর্যায়ে ও মাঠপর্যায়ে খোঁজ করে দেখা যায় যে উভয় পর্যায়েই প্রয়োজনীয় সংখ্যার তুলনায় জনবলের অভাব রয়েছে। মাঠপর্যায়ে কূপ খননকাজে যে–সংখ্যক ড্রিলার ও তার সহযোগী সরাসরি নিয়োজিত থাকে, সেখানে পর্যাপ্ত কর্মীর অভাবে খননকাজ অনেক সময়ই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা কঠিন হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে বাপেক্সের বহরে বর্তমানে যে চারটি গভীর খনন রিগ রয়েছে, তা নিয়োগ করে একযোগে চারটি কূপ খনন করার প্রয়োজনীয়সংখ্যক খননকর্মী কোম্পানিটির নেই। মাঠপর্যায়ে খননস্থানে ভূতাত্ত্বিক কর্মীও পর্যাপ্তসংখ্যক নেই। দপ্তর পর্যায়েও কর্মীর সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম।
বাপেক্সের এই মুহূর্তে ২৫ থেকে ৩০টি ভূতাত্ত্বিক ও আনুষঙ্গিক শাখায় পদ খালি রয়েছে, যা পূরণ করার জন্য কেবল প্রশাসনের সামান্য উদ্যোগই যথেষ্ট। এসব পদ পূরণ করার প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা রয়েছে এমন জনবলেরও অভাব নেই। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাপেক্সের জনবল বৃদ্ধির কোনো জরুরি উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়।
বাপেক্স বনাম গাজপ্রম: রাশিয়ার গ্যাস কোম্পানি গাজপ্রম কেবল রাশিয়াতেই নয়, বরং সারা ইউরোপের দেশগুলোয় গ্যাস-বাণিজ্যে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে রয়েছে। এ কোম্পানির অধীনে রয়েছে সাইবেরিয়ার বিশাল গ্যাসভান্ডার, যা আন্তমহাদেশীয় পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপের অধিকাংশ দেশকে সরবরাহ করে, যারা তার ওপর নির্ভরশীল। তবে বাংলাদেশে গাজপ্রমের অবস্থান যেন একটি ভুল সময়ে ভুল জায়গায় এসে পড়ার মতন।
বিগত বছরে বাংলাদেশের গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ফার্স্ট ট্র্যাক কার্যক্রমের অধীনে গাজপ্রমকে দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় ১০টি উন্নয়ন কূপ খননের কাজ দেওয়া হয়, যার মাধ্যমে প্রতিটি কূপে ২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনের মাধ্যমে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়। কিন্তু খননকাজের ফলাফল হয় হতাশাব্যঞ্জক। কোনো কোনো কূপে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে স্বল্প গ্যাস উৎপাদিত হয়, আবার কোনোটিতে কয়েক দিন স্বল্পমাত্রায় গ্যাস উৎপাদনের পর বন্ধ হয়ে যায়। সর্বোপরি গাজপ্রম প্রতিটি কূপ খননে যে অর্থমূল্য নেয়, তা বাপেক্স কর্তৃক খননকৃত কূপের মূল্যের প্রায় দ্বিগুণ। তাই স্বভাবতই গাজপ্রমের কার্যক্রম বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোয় নেতিবাচক হিসেবে প্রচার লাভ করে। গাজপ্রম অবশ্য তাদের কূপগুলোয় সব কটিতে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী গ্যাস না পাওয়ার দায় বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের ওপর ন্যস্ত করে, যেহেতু কূপের স্থান নির্ধারণে গাজপ্রমের কোনো ভূমিকা নেই এবং কূপের অভ্যন্তরের তথ্য পেতে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের সহযোগিতার অভাব ছিল বলে অভিযোগ করে।
বর্তমানে সরকার পুনরায় গাজপ্রমকে আরও পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র খননে নিয়োগ করছে, যা আবার বিতর্কের সূত্রপাত করে। কেন এই গাজপ্রম? যে কোম্পানি বিশ্ববাজারে গ্যাস-বাণিজ্য করে প্রতিদিন কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা করে, বাংলাদেশের মতন দরিদ্র দেশে পাঁচ-দশটা কূপ খনন করে তার কীই-বা লাভ? এদিকে বাংলাদেশ তার নিজস্ব কোম্পানি বাপেক্সকে গ্যাসকূপ খননে নিয়োগ না করে তাকে বঞ্চিত করেছে এবং ওই কাজ গাজপ্রমকে দিয়ে দেওয়ায় জাতীয় স্বার্থ বিঘ্নিত হয়েছে। কোন অর্থনৈতিক সূত্রে বাংলাদেশ গাজপ্রমকে নিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে, যা কিনা গাজপ্রমের মতন বিশ্বখ্যাত কোম্পানির জন্যও অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে? সরকারের পক্ষ থেকে সামগ্রিক বিষয়টি জনগণের কাছে ব্যাখ্যা করা হয় না।
ড.বদরূল ইমাম, অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।