যে ফোনালাপটি না হলেই ভালো হতো

কার্টুন: শিশির
কার্টুন: শিশির

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার মধ্যে ফোনালাপ হবে—এমন কথা চাউর হয়ে গিয়েছিল কয়েক দিন আগেই। সরকারের মন্ত্রী-নেতারা আগাম ঘোষণা দিয়েছিলেন, দুই নেত্রীর মধ্যে সংলাপ হবে। দেশের মানুষও আশান্বিত হয়েছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে দেশে যে সংকট তৈরি হয়েছে, দুই নেত্রীর আলোচনায় তার শান্তিপূর্ণ সমাধান হলেও হতে পারে। বিদেশি কূটনীতিকদের কেউ কেউ বলেছিলেন, এবার বরফ গলবে।
না, বরফ গলেনি। বরং গত শনিবার রাতে দুই নেত্রীর মধ্যে যে টেলিফোন সংলাপ হলো, তাতে বরফ আরও জমাটবদ্ধ হয়েছে। সংকট ঘনীভূত হয়েছে। তিন দিনের হরতাল এবং হরতাল-পরবর্তী সহিংসতায় ১৩টি প্রাণ ঝরে গেছে। আরও কত হরতাল হবে। আরও কত প্রাণ যাবে, আরও কত মানুষ বোমা-ককটেলের ঘায়ে পঙ্গু হবে, তার হিসাব নেই।
দুই নেত্রী কথা বলবেন, এ কথা শুনে মানুষ যতটা আশান্বিত হয়েছিলেন, টেলিফোন আলাপের পর তাঁরা তার চেয়ে অনেক বেশি হতাশ হয়েছেন। আহত হয়েছেন। তার চেয়েও বড় কথা, জাতি হিসেবে আমরা লজ্জিত হয়েছি। মাথা হেঁট হয়ে গেছে। আমাদের শীর্ষ নেতৃত্ব এই ভাষায় কথা বলেন! গতকাল দুই নেত্রীর টেলিফোন আলাপ ছিল টক অব দ্য টাউন। টক অব দ্য কান্ট্রি। জনসভায়, রাজনৈতিক মঞ্চে নেতা-নেত্রীরা যে ভাষায় কথা বলেন, পরস্পরকে আক্রমণ করেন, সেই একই ভাষায় কি তাঁরা টেলিফোনে কথা বলতে পারেন?
১৯৭১ সালের মার্চে পাকিস্তানি বাহিনী যখন নিরস্ত্র বাঙালির ওপর গুলি চালাল, তখন বঙ্গবন্ধু জানতেন, ওরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, ক্ষমতা দেবে না। পাকিস্তান থেকে সেনা ও সমরাস্ত্র এনে গণহত্যা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার পরও তিনি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠকে অসামান্য সৌজন্য দেখিয়েছেন। তাঁকে বাংলাদেশের অতিথি বলে অভিহিত করেছেন। এমনকি একাত্তরের খলনায়ক জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গেও হাসিমুখে কথা বলেছেন। তিনি নিজের পরিকল্পনার কথা যেমন ওদের বুঝতে দেননি, তেমনি আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের জন্য শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।
কিন্তু আমাদের দুই নেত্রীর মধ্যে যে টেলিফোন আলাপ হলো, তাতে সামান্যতম সৌজন্যবোধের পরিচয় পাওয়া গেল না। টেলিফোনটি করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কেমন আছেন—বলে তিনি কথা শুরু করেন। ওপার থেকে বিরোধী দলের নেত্রী বললেন, ‘ভালো। ভালো আছি।’ প্রত্যুত্তরে ‘আপনি কেমন আছেন’ সে কথাও জিজ্ঞেস করেননি। এরপর দুই নেত্রীর মধ্যে দুপুরে টেলিফোন করা না-করা, ধরা না-ধরা এবং লাল টেলিফোন সেট বন্ধ থাকা না-থাকা নিয়ে অনেকক্ষণ বাহাস চলতে থাকে। একটি বিনীত আমন্ত্রণ পরিণত হয় দুর্বিনীত ঝগড়ায়। প্রধানমন্ত্রী যতই বলেন তিনি দুপুরে লাল টেলিফোন করেছেন। রিং বেজেছে। আপনি হয়তো যেকোনো কারণে ধরতে পারেননি। বিরোধীদলীয় নেত্রী ততই জোর দিয়ে বলেন, টেলিফোনের রিং হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তাঁর টেলিফোন সেটটি অনেক দিন ধরেই ডেড হয়ে আছে।
এরপর শেখ হাসিনা ২৮ অক্টোবর তাঁর সরকারি বাসভবনে আমন্ত্রণ জানালে খালেদা জিয়া অপারগতা প্রকাশ করেন এবং বলেন, হরতালের মধ্যে তাঁর পক্ষে গণভবনে আমন্ত্রণ গ্রহণ করা বা আলোচনায় অংশ নেওয়া সম্ভব নয়। সরকার সৎ ও আন্তরিক হলে ২৯ অক্টোবরের পর যেকোনো সময় আলোচনা হতে পারে।
দুই নেত্রীর ৩৭ মিনিটের কথোপকথনে ঘুরেফিরে যুদ্ধাপরাধের বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানো, একাত্তরের পর ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের মানুষ হত্যা, ১৫ আগস্টের খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালন ও কেক কাটা, ১৯৯৫-৯৬ সালে জামায়াতকে নিয়ে আওয়ামী লীগের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, ২০০১ সালের পর আওয়ামী লীগের ওপর সরকারের দমন-পীড়ন, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, ২০০৬ সালের লগি-বইঠার আন্দোলন, এরশাদের সামরিক শাসন ও ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনের ক্ষমতাকে বৈধতা দানের বিষয় ঘুরেফিরে আসে এবং প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁরা একে অপরকে তীব্র ভাষায় অভিযুক্ত করেন। আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী যত আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করেন, বিরোধী দলের নেত্রী তত অভিযোগের মাত্রা বাড়িয়ে দেন। তাঁর সুর ছিল চড়া। কে কার প্রতি অন্যায় আচরণ করেছেন, জনসভার অনুমতি দিতে কত বিলম্ব করেছেন, সেসব নিয়েও দুজনের মধ্যে তর্ক হয়। ফলে টেলিফোন করার মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী যখন ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা করে তাঁকে হত্যাচেষ্টার কথা বললেন, তখন খালেদা জিয়া এই হামলার দায় আওয়ামী লীগের ওপর চাপান।
আমন্ত্রণ গ্রহণ করা না-করার স্বাধীনতা আমন্ত্রিত ব্যক্তির আছে। আবার কখন, কাকে কীভাবে আমন্ত্রণ জানাবেন, সেটি পুরোপুরি নির্ভর করে আমন্ত্রকের ইচ্ছার ওপর। সেসব নিয়ে আমরা কোনো প্রশ্ন করব না। আমাদের আপত্তি হলো, দেশের দুই শীর্ষ নেত্রীর মধ্যে যে টেলিফোনে আলাপ হলো তার ভাষাভঙ্গি নিয়ে। পুরো টেলিসংলাপটি পরিণত হয় রাজনৈতিক কূটতর্কে। মনে হয়েছে, এক পক্ষের কাছে আমন্ত্রণ জানানোর চেয়ে আমন্ত্রণের বার্তাটি দেশবাসীর কাছে প্রচার করাই মুখ্য ছিল। অপরপক্ষ সেই সুযোগে মনের যত রাগ ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। এখানে জনগণের আকাঙ্ক্ষার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। নিজেদের জেদ বজায় রেখেছেন। সারাক্ষণ একে অপরকে কথা ও বাক্যবাণে ঘায়েল করতে সচেষ্ট ছিলেন। তাই মনে হয়, এই সংলাপ না হলেই ভালো হতো।
দুই নেত্রী টেলিফোনে যেসব বিষয়ের অবতারণা করেছেন, তা নতুন নয়। দুই দশক ধরেই একে অপরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। এ ব্যাপারে দুজনেরই ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও বেদনা থাকতে পারে। কিন্তু তাঁদের মনে রাখা উচিত ছিল, তাঁরা কেবল ব্যক্তি নন, বাংলাদেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতা। তাঁদের একজন বর্তমানে দেশ শাসন করছেন, আরেকজন অতীতে দেশ শাসন করেছেন এবং ভবিষ্যতেও শাসন করবেন বলে আশা করেন। বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষের আস্থা ও ভরসা তাঁদের ওপরই। কেবল দেশের সাধারণ মানুষ নয়, দুই দলেরই হাজার হাজার নেতা-কর্মীও তাঁদের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর এমন কোনো আচরণ করতে পারেন না, যাতে জাতি হিসেবে আমরা লজ্জিত ও ছোট হই।
রাজনীতিতে মত ও পথের ভিন্নতা থাকবে। নীতি ও আদর্শের পার্থক্য থাকবে। কিন্তু রাজনীতিকে বৈরিতা ও শত্রুতার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া কখনোই সমীচীন নয়। বর্তমানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে ঝগড়া চলছে, তা নীতিগত নয়। এমনকি যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টিও এখন মীমাংসিত। কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে, রায় কার্যকরের অপেক্ষায় আছে। বাকিদের বিচারও চলছে। বিরোধীদলীয় নেতা নির্দলীয় সরকারের প্রস্তাব উত্থাপনকালে যেভাবে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সহযোগিতা কামনা করছেন, তাতে বলার উপায় নেই যে তিনি দেশটির বন্ধুত্ব চাওয়ার আওয়ামী লীগের চেয়ে পিছিয়ে আছেন।
বর্তমান সংকটের মূল বিষয় হলো নির্বাচন। আর এই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার জন্য গ্রহণযোগ্য করতে দুই নেত্রী দুটি ফর্মুলা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সর্বদলীয় সরকার। আর বিরোধীদলীয় নেতার নির্দলীয় সরকার। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দুই নেত্রীর দুই প্রস্তাবকে সমন্বয় করে সবার জন্য একটি সমাধান বের করা কঠিন নয়। সে ক্ষেত্রে সবারই প্রত্যাশা ছিল, দুই নেত্রী বসবেন, কথা বলবেন এবং সেই শান্তিপূর্ণ সমাধান বের করে আনবেন। কিন্তু তাঁরা টেলিফোনে সংলাপের নামে অহেতুক বৈরিতার সৃষ্টি করলেন। তাঁদের এই সংলাপ শুনে শৈশবে পড়া যোগীন্দ্র নাথ সরকারের সেই বিখ্যাত কবিতার কথাই মনে পড়ে, ‘বাহবা বাহবা ভোলা ভুতো হাবা/ খেলিছে তো বেশ/ দেখিব কে হারে কে জেতে/ খেলা হলে শেষ’।
সবশেষে নিজেদের প্রতি ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হয়। আমরা হয়তো এর চেয়ে উন্নত নেতৃত্বের পাওয়ার যোগ্য নই। সেই জাতি সেই নেতৃত্বই পায়, তারা যার উপযুক্ত!
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
[email protected]