শিক্ষায় ভ্যাট আরোপ করা নৈতিক নয়

নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম
ভ্যাট বাতিলের দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। অন্যদিকে বেতনবৈষম্য দূর করার দাবিতে আন্দোলন করছেন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাট নিয়ে বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম

প্রথম আলো : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার ওপর আরোপিত ভ্যাটের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন ছাত্ররা। এ ধরনের ভ্যাট আরোপকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
নজরুল ইসলাম : আসলে বিষয়টি নীতিগত। প্রথমেই আমাদের এই নীতিগত প্রশ্নের সুরাহা করতে হবে যে শিক্ষার ক্ষেত্রে ভ্যাট থাকবে কি না। সাধারণভাবে আমি শিক্ষার ক্ষেত্রে ভ্যাট আরোপের বিরুদ্ধে। আমি মনে করি, শিক্ষার ক্ষেত্রে ভ্যাট নেওয়া যৌক্তিক বা নৈতিক নয়। কারণ, আমরা চাই আমাদের দেশে শিক্ষার বিস্তার ঘটুক, উচ্চশিক্ষার বিস্তার ঘটুক। শিক্ষার মধ্য দিয়ে দেশে মানবসম্পদ গড়ে ওঠে। সুতরাং, নীতিগত অবস্থানটি হওয়া উচিত এ ক্ষেত্রে ভ্যাট বা এ ধরনের কিছু আরোপ না করা।
প্রথম আলো : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা উচ্চ বেতনে পড়েন। সরকার যে যুক্তি দিচ্ছে তা হচ্ছে, পড়াশোনার জন্য এত টাকা খরচ করতে পারলে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট কেন তাঁরা দিতে পারবেন না?
নজরুল ইসলাম : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উচ্চ বেতনে পড়ছেন, তা সত্যি। কিন্তু সে জন্য তাঁদের ওপর নতুন করে বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দেওয়া যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উচ্চ বেতন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আয় হচ্ছে, সেখান থেকে কিন্তু সরকার আয়কর পাচ্ছে। আমার কথা হচ্ছে, সরকার যদি শিক্ষায় ভ্যাট আরোপ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়, তবে সব ক্ষেত্রেই ভ্যাট আরোপ করা উচিত। শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ভ্যাট আরোপের বিষয়টি বৈষম্যমূলক।
প্রথম আলো : পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো সরকার অর্থ দিয়ে চালায়। সরকার যদি শুধু বেসরকারি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ভ্যাট আরোপ করার নীতি গ্রহণ করে?
নজরুল ইসলাম : দেখুন, সরকার যদি বেসরকারি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ভ্যাট আরোপ করার নীতি নেয়, তবে যেসব বেসরকারি কলেজ উচ্চশিক্ষা দিচ্ছে, সেসব বেসরকারি কলেজের ওপর ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে না কেন? শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বা শিক্ষার ওপর কেন ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে, তার কোনো নৈতিক ও যৌক্তিক ব্যাখ্যা সরকার তুলে ধরতে পারেনি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তো সরকার-নির্ধারিত কারিকুলামেই পড়ালেখা করছেন। তাঁদের আলাদা করে দেখার কোনো অর্থ হয় না।
প্রথম আলো l ইংরেজি মাধ্যমের পড়াশোনার ক্ষেত্রে তো ভ্যাট কার্যকর রয়েছে।
নজরুল ইসলাম : ইংরেজি মাধ্যমের বিষয়টি আলাদা। এই মাধ্যমের কারিকুলাম সরকারের নির্ধারিত নয়। এখানে সমাজের খুবই অল্পসংখ্যক বিত্তশালী পরিবারের সন্তানেরা পড়াশোনা করে। তাদের পড়াশোনার মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের, পরীক্ষা হয় আন্তর্জাতিকভাবে। এর সঙ্গে আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মিলিয়ে দেখা যাবে না।
প্রথম আলো : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চবিত্তের সন্তানেরা পড়েন—এমন একটি ধারণা রয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের দেশের অবস্থান বিবেচনায় তাঁরা বিত্তশালী।
নজরুল ইসলাম : একসময় দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া কিছু ছিল না। উচ্চশিক্ষা মানেই ছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এখন অবস্থা পাল্টেছে। অসংখ্য ছাত্রছাত্রী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। শুরুতে যেমন শুধু উচ্চবিত্তের সন্তানেরা পড়তেন, এখন সেই অবস্থাও পাল্টেছে। এখন মধ্যবিত্ত বা অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী নয়—এমন পরিবারের ছেলেমেয়েরাও পড়াশোনা করছেন। ফলে, এটা এখন আর বলা যাবে না যে শুধু উচ্চবিত্তের ছেলেমেয়েরাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন।
প্রথম আলো : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পড়াশোনার খরচের মধ্যেও তো তারতম্য আছে।
নজরুল ইসলাম : তা আছে। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদি বিবিএ কোর্সের জন্য দুই লাখ টাকা নেয়, সেই একই কোর্সের জন্য কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পাঁচ লাখ টাকাও নেয়। আমি মনে করি, এই বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ভাগ করা যেতে পারে। যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চ বেতন ও ফি নেয়, তাদের ওপর ভ্যাট বা এ ধরনের কিছু আরোপ করা যেতে পারে। আয়করের ক্ষেত্রে যেমন স্ল্যাব থাকে, এ ক্ষেত্রেও তেমন করা যেতে পারে। সরকার একটি নির্দিষ্ট কোর্সের জন্য টিউশন ফির একটি সীমা নির্ধারণ করে দিয়ে বলতে পারে যে এর চেয়ে বেশি যারা নেবে, তাদের ভ্যাট দিতে হবে।
প্রথম আলো : এটা কীভাবে হতে পারে?
নজরুল ইসলাম : এ রকম কিছু করতে হলে বিষয়টি আগে থেকেই পরিষ্কার থাকতে হবে। স্বচ্ছতার বিষয়টি নিশ্চিত থাকতে হবে। যেমন: একটি কোর্সের জন্য টিউশন ফি কত, সেটা যেমন পরিষ্কার থাকতে হবে, তেমনি এর সঙ্গে কত ভ্যাট দিতে হবে, সেটাও থাকতে হবে। ফলে, একজন ছাত্র বা ছাত্রী ভর্তি হওয়ার আগেই জেনে যাবেন যে কোর্সের জন্য তাঁকে কত খরচ করতে হবে।
প্রথম আলো : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেশি অর্থ খরচ করে পড়ছেন। এখন ভ্যাট আরোপ হয়েছে। বলা হচ্ছে, এই ভ্যাট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে। কিন্তু এটা বোঝা যায় যে কার্যত তা শিক্ষার্থীদের ওপরই এসে পড়বে। এত অর্থ খরচ করে যে শিক্ষা, তার মানের দিকটি কোন পর্যায়ে?
নজরুল ইসলাম : এটাই সবচেয়ে উপেক্ষিত বিষয়। মানের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা রয়ে গেছে। ভ্যাট না হয় এনবিআর দেখবে, কিন্তু শিক্ষার যথাযথ মান বজায় থাকছে কি না, সেটা দেখার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও সরকারের। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটি বা ট্রাস্টির লোকজন টাকা সরিয়ে নেন কি না বা এ ধরনের যে অভিযোগ রয়েছে, তা বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ তদারকির বিষয়টি খুবই জরুরি।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
নজরুল ইসলাম : আপনাকেও ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন: