ভালো শিক্ষক তৈরি করব কীভাবে?

১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল শিক্ষাকে সর্বজনীন করা। এর ৫৩ বছর পর সেই লক্ষ্য কতটা অর্জিত হলো, শিক্ষাব্যবস্থায় কী কী দুর্বলতা ও অসংগতি রয়ে গেছে, তার ওপর আলোকপাতই এবারের শিক্ষা দিবসে প্রথম আলোর আয়োজন।
১৭ সেপ্টেম্বর সামনে রেখে ধারাবাহিক আয়োজনের দ্বিতীয় লেখাটি প্রকাশিত হলো আজ।

গত কয়েক বছরে শিক্ষায় উন্নতির দাবির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিক্ষার মান নিয়ে সমালোচনা। সংখ্যা নিয়ে তুষ্টি আর মান নিয়ে বিতর্ক। কেউ বলছেন, পরিমাণে আগে বাড়ুক, তারপর মান দেখা যাবে। অন্যরা তা মানতে নারাজ। তাঁরা মনে করেন, পরিমাণে আর মানে মোটামুটি একসঙ্গে বাড়াতে না পারলে সেই উন্নতি টেকসই হয় না। লকলকে বেড়ে ওঠা উন্নতি নয়।
শিক্ষার চারটি প্রধান উপাদান—ঘরবাড়ি, বইপত্র, ছাত্র ও শিক্ষক। সবগুলো ভালো হলে তো সোনায় সোহাগা। কিন্তু তা তো সব ক্ষেত্রে ঘটে না। এবার যদি দেখি কোন দুটি ‘ভালো’ চাই আমাদের? প্রথম কথা হলো, ছাত্র আর শিক্ষক না হলে তো শিক্ষার প্রশ্নই ওঠে না। তাই শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো এই ছাত্র আর শিক্ষক। এবার আমরা কোনটা বেশি ‘ভালো’ চাইব? ছাত্র, না শিক্ষক? সব ছাত্রই কোনো না কোনো গুণে সমৃদ্ধ। তা ছাড়া শিক্ষা হলো সবার জন্মগত অধিকার। কাজেই সবার (প্রাথমিক) শিক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাই সবাইকে সুযোগ দিতেই হবে। কিন্তু শুধু সুযোগ দিলেই তো হবে না, নিশ্চিত করতে হবে তারা যেন ভালো শিক্ষা পায়। ভালো শিক্ষা যদি চাই, ভালো শিক্ষক ছাড়া তা কিছুতেই সম্ভব নয়।
ভালো শিক্ষক পাব কী করে? মেধাবীদের শিক্ষকতায় নিয়োগ করে, তাঁদের আকর্ষণীয় বেতন ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করে আর অব্যাহত প্রশিক্ষণ দিয়ে ভালো শিক্ষক তৈরি করা যায়।
শিক্ষক নিয়োগে দলীয় আনুগত্য কিংবা ‘ডোনেশন’ নামের ঘুষ যদি প্রধান হয়ে ওঠে, তাহলে মেধাবীদের নিয়োগ কিছুতেই নিশ্চিত হয় না। অন্তত গত দুই-আড়াই দশকে শিক্ষক নিয়োগে যে চরম অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তার মূলে রয়েছে এই দলীয় আনুগত্য আর ঘুষের লেনদেন। শিক্ষকের পদটি নিলামে তুলে, দলীয় আনুগত্য আর স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকেই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বলে সর্বত্র অভিযোগ।
বাংলাদেশে অতীতে শিক্ষকের ভালো আর্থিক সুবিধা না থাকলেও সামাজিক মর্যাদা ছিল খুবই উঁচু। এখন কোনোটাই নেই।
কী করে ভালো শিক্ষক হয়ে ওঠা যায়? প্রতিভাবানদের কথা বাদ দিলে ভালো শিক্ষক তৈরি করতে হয়। কে তৈরি করতে পারে? পারে সমাজ, কিন্তু শেষ বিচারে রাষ্ট্র। বাংলাদেশে কোনটি সরকারের আর কোনটি সমাজের দায়, তা নিরূপণ করা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে এবং ভাঙতে ভাঙতে সমাজ হয়ে উঠেছে প্রান্তিক এক অকার্যকর ক্ষমতাকাঠামো। ফলে রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে। যদিও সমাজের সঙ্গে তা ভাগাভাগি করাই উত্তম।
সংবিধানে যা-ই লেখা থাক, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। অর্থাৎ ‘নাগরিকেরা তাদের সামর্থ্যমতো কাজ করবে আর রাষ্ট্র তার সাধ্যমতো নাগরিকের সব মৌলিক চাহিদা মেটাবে’—এই সমাজবাদী অঙ্গীকার নেই আমাদের সংবিধানে। বাংলাদেশ বড়জোর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, মুক্তবাজার অর্থনীতির দেশ, যার মূল ভিত্তি মুনাফা। শিক্ষাক্ষেত্রে তার অশুভ প্রভাব দিনে দিনে স্পষ্ট হচ্ছে। শিক্ষাও হয়ে উঠছে দামি পণ্য।