আসমা, আমির, অলোকদের জন্য ভালোবাসা

অসহিষ্ণুতার শিকার অভিনেতা আমির খান স্ত্রী ও পুত্রের সঙ্গে
অসহিষ্ণুতার শিকার অভিনেতা আমির খান স্ত্রী ও পুত্রের সঙ্গে

অসহিষ্ণুতা নামের সংক্রমণ ব্যাধিটি মানুষের ভেতরে যে শুভবোধ, শুভচিন্তা ও মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা থাকে, সেসব ধ্বংস করে দেয়। অসহিষ্ণুতাজাত হিংসা ও ঘৃণা দেশে দেশে যুদ্ধ বাধায়, মানুষে মানুষে রক্তপাত ঘটায়। আমরা এই অসহিষ্ণুতার চরম প্রকাশ দেখতে পাই আইএস নামের জঙ্গি সংগঠনটির নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতায়। আবার তাদের দমনের নামে যে অভিযান চালানো হয়, সেটিও কম নিষ্ঠুর নয়।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেফরি ডি স্যাকস আইএসের উত্থানের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘এটা আসলে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, হর্ন অব আফ্রিকা এবং মধ্য এশিয়ায় মার্কিন ও ইউরোপীয় প্রকাশ্য ও গোপন সামরিক অভিযানের এক ভীতিকর ও অপ্রত্যাশিত ফলাফল।’ কিন্তু কোনো কারণই প্যারিসে কিংবা তুরস্কে কিংবা তিউনিসিয়ায় নিরীহ মানুষ হত্যাকে জায়েজ করতে পারে না।
২.
দুনিয়াজুড়েই আজ হিংসা আর রক্তপাত। কোথাও ধর্মের নামে, কোথাও রাষ্ট্রের নামে, কোথাও–বা রাজনীতির নামে মানুষ মানুষকে হত্যা করছে। আবার হত্যাকারী মানুষ নিজেও আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। প্যারিসের হামলায় যুক্ত আটজনের ছয়জনই আত্মহত্যা করেছেন বলে গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে। প্যারিস বা সিরিয়া থেকে বাংলাদেশ অনেক দূরে। আমাদের নেতারা বলছেন, আইএস থেকেও আমরা ঢের দূরে আছি। কিন্তু মানুষ হত্যা থেমে নেই। মনে হচ্ছে, অসহিষ্ণুতার দৈত্যটি নিয়ত ঘাড়ের ওপর বিষ নিশ্বাস ফেলছে।

‘আইএসমুক্ত’ বাংলাদেশেও আজ জনজীবন নিরাপদ নয়। বিশেষ করে যদি আপনি হন সংখ্যালঘু কিংবা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কেউ। সুযোগ বুঝে সন্ত্রাসীরা মিছিলে, মসজিদে, প্রকাশনালয়ে হানা দিচ্ছে। গুলিতে-বোমায়-চাপাতির কোপে মানুষ মরছে। লাঞ্ছিত হচ্ছে দেশ ও মানবতা। পত্রিকায় চোখ মেললেই, টিভি খুললেই নারী ও শিশুর রক্তাক্ত মুখ। আগে একজন মানুষের মৃত্যু আমাদের যেভাবে বিচলিত করত, এখন শতজনের মৃত মুখও তেমন করে না। কেবল রাষ্ট্রের মন নয়, মানুষের মনও পাথর হয়ে গেছে। আমাদের সমাজের যাঁরা নেতা, তাঁরা আলো দেখাতে পারছেন না, রাষ্ট্র ও রাজনীতির যাঁরা চালক, তাঁরাও নিরাপত্তা দিতে পারছেন না। এ রকম অবিমৃশ্য ও অবিশ্বাসী সময় সম্ভবত আর আসেনি। দেশে একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটছে, আর আমরা পরস্পরের ওপর দোষ চাপিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছি। বহু বছর আগে জীবনানন্দ দাশ ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতায় লিখেছিলেন: যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা/ যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-প্রীতি নেই-করুণার আলোড়ন নেই/ পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।’ আজকের বাংলাদেশের জন্য কথাটি শতভাগ সত্য।
কেবল পৃথিবী নয়, বাংলাদেশটিও নিয়ত হিংসার বারুদে দগ্ধ হচ্ছে (বাংলাদেশ পৃথিবীর বাইরে নয় জেনেও কথাটি বলছি)। প্রতিহিংসার আগুন নিকট অতীতে আমাদের অনেক জীবন নিভিয়ে দিয়েছে। কেউবা আহত হয়ে হাসপাতালের শয্যায় কাতরাচ্ছেন। চলতি বছরের শুরুতে যে আগুন বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল; সেই আগুন নিভেছে বলে মনে হয় না। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে লক্ষ্য করে আগুন ছুড়ে মারছে। অন্য পক্ষ সেই আগুন থামাতে গুলি–গুমের আশ্রয় নিয়েছে। আর সাধারণ মানুষ হয় আগুনে পুড়েছে, নয়তো গুলি খেয়ে মরেছে। তিন মাসের হরতাল-অবরোধের অবসান হলে আমরা ভাবলাম এবার রক্ষা পাওয়া যাবে। কিন্তু এই ঘৃণার আগুন কিংবা গুলি কখনো থামে না। সেই হিংসা তাড়িয়ে বেড়ায় নির্জন রাস্তায় পথচলা কিংবা রিকশায় বসা বিদেশি নাগরিককে। সেই হিংসা থামিয়ে দেয় তাজিয়া মিছিল এমনকি মসজিদে নামাজের জন্য প্রস্তুতিরত মুসল্লিকেও। কখনো সেই হিংসা পুড়িয়ে দেয় বইয়ের পাতা, ছিনিয়ে নেয় তরুণ প্রকাশক ও মুক্তবুদ্ধির লেখকের জীবন।
পরের মাসের ক্যালেন্ডারের পাতা যেমন আগের মাসের পাতা ঢেকে দেয়, তেমনি একটি নৃশংস ঘটনা পুরোনো ঘটনাকে ভুলিয়ে দেয়। নতুন হত্যাকাণ্ডে পুরোনো হত্যাকাণ্ডের ছবিও ঝাপসা হয়ে আসে। প্রতিদিনই মৃতের তালিকা বাড়ে। এখন ক্যালেন্ডারের সব তারিখই লাল মনে হয়, যা মানুষের খুনে এবং স্বজনহারাদের অশ্রুতে সিক্ত। আমাদের সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঋদ্ধ, আমাদের বিরোধী দল গণতন্ত্র রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরী—তারপরও হত্যা থামছে না। হিংসার আগুন নিভছে না।

৩.
ভারতের অভিনেতা আমির খান। পাকিস্তানের মানবাধিকারকর্মী আসমা জাহাঙ্গীর। বাংলাদেশের লেখক অভিজিৎ, ব্লগার ওয়াশিকুর, প্রকাশক দীপন, সমাজকর্মী অলোক সেনসহ আরও অনেকে অসহিষ্ণুতার শিকার। আমির খান ও আসমা জাহাঙ্গীর ভাগ্যবান যে তাঁরা শারীরিকভাবে আক্রান্ত হননি। উগ্রপন্থীরা তাঁদের দেশ ছাড়ার হুমকি দিয়ে ক্ষান্ত রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সন্ত্রাসীরা যাকেই নিশানা করে, তাকেই শেষ করে দেয়। তাদের হাত থেকে খুব কম লোকই রেহাই পায়।
যেকোনো ঘটনায় কেউ সংক্ষুব্ধ হলে আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। হোক সেটি ব্যক্তিগত কিংবা জাতিগত অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার বিষয়। কিন্তু পাকিস্তানে আসমা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে কেউ আদালতে মামলা করেননি। উগ্রপন্থীরা সরাসরি তাঁকে দেশছাড়া করার হুমকি দিয়েছেন। আয়শা বালুচ নামে একজন লিখেছেন, বাংলাদেশ যদি তাঁর এত প্রিয় হয়ে থাকে তিনি সেখানে যান না কেন? ফাতিমা আলী নামে আরেকজন তাঁকে পাকিস্তান থেকে বের করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। আসমা জাহাঙ্গীরের অপরাধ? তিনি বাংলাদেশের দুই যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে পাকিস্তান সরকারের দ্বৈতনীতির সমালোচনা করে বলেছিলেন, যখন পাকিস্তানের সামরিক আদালতে বা সৌদি আরবে অন্যায়ভাবে কাউকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়, তখন পাকিস্তান সরকারকে এ ধরনের প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা যায় না।
আর ভারতের আমির খান এক টুইটে সাম্প্রতিক ঘটনায় নিজের উদ্বেগ জানাতে গিয়ে লিখেছিলেন, ‘ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার ঘটনাগুলোয় তিনি আতঙ্কগ্রস্ত। নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিরণ (স্ত্রী) এতটাই উদ্বিগ্ন ছিল যে আমাকে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল, আমাদের কি ভারত ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত।’ এরপরই উগ্রপন্থীরা তাঁর বিরুদ্ধে জোর প্রচারণা চালাতে থাকে। সুধীর কুমার ওঝা নামে এক আইনজীবী তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। পাঞ্জাবের শিবসেনা–প্রধান ঘোষণা দিয়েছেন, যে আমির খানের গালে চড় মারবে, তাঁকে এক লাখ রুপি পুরস্কার দেওয়া হবে। ভাবা যায়, অহিংস আন্দোলনের পথিকৃৎ মহাত্মা গান্ধীর ভারতে এ রকম হিংসা ও ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া হচ্ছে!
এসব অপপ্রচারের জবাবে আমির খান বলেছেন, ‘আমি বা আমার স্ত্রী কিরণ কারোরই দেশ ছাড়ার কোনো ইচ্ছে নেই। দেশ ছাড়ার কথা একবারও বলিনি। আমার স্ত্রী কিরণও বলেনি।.....ভারত আমার দেশ, আমি একে ভালোবাসি, এ দেশে জন্মে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি, এবং এখানেই আমি থাকব।’
ভারতের ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় ও সামাজিক অসহিষ্ণুতার পরিপ্রেক্ষিতে মুখ খুলেছেন প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক এ আর রহমান। তাঁকেও আমির খানের মতো পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিছুদিন আগে মুহাম্মদ: দ্য মেসেঞ্জার অব গড ছবির সংগীত পরিচালনার জন্য তিনি মুসলিম উগ্রপন্থীদের দ্বারা সমালোচিত হয়েছিলেন। তিনি এ-ও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে ‘আমরা মহাত্মা গান্ধীর দেশের মানুষ।’ অনুরূপ প্রতিবাদ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বহু রাজ্যে। আমির খানের ঘটনায় ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো উগ্রপন্থার কঠোর সমালোচনা করেছে। কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী বলেছেন, সংবিধান রচনায় যাদের পূর্বসূরিদের কোনো অবদান ছিল না, তারাই সংবিধানের বহুত্ববাদী চেতনার ওপর আঘাত হেনেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, আমির খানের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। সে জন্য কেউ তাঁকে দেশ ছেড়ে যেতে বলতে পারে না।

৪.
ভারতের প্রখ্যাত কথাশিল্পী ও বিজয় লক্ষ্মী পণ্ডিতের কন্যা নয়নতারা সেহগাল ঢাকা লিট ফেস্টিভ্যালে এসে বলেছিলেন, যখন বিশ্বজুড়ে অস্থিরতা ও অসহিষ্ণুতার আগুন জ্বলছে, তখন তিনি সাহিত্য নিয়ে সুন্দর সুন্দর কথা বলতে আসেননি। তিনি এসেছেন তাঁর দেশ ভারতে কী ঘটেছে, সেসব বলতে। বহু ধর্ম ও বহু সংস্কৃতির মানুষের ভারতে রাষ্ট্র বা সরকার নাগরিকদের ওপর হিন্দুত্ববাদ চাপিয়ে দিতে পারে না। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর ভাগনি নয়নতারা সম্প্রতি লেখক হত্যা এবং দাদরি ঘটনায় সরকারের নীরবতার প্রতিবাদে প্রথম সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার ফেরত দেন। তাঁর দেখাদেখি ৭০ জনেরও বেশি লেখক-শিল্পী-বিজ্ঞানী ইতিহাসবিদ তাঁদের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ফেরত দিয়েছেন। কেবল তাই নয়, অসহিষ্ণুতা ও উগ্রতার বিরুদ্ধে তাঁরা রাজ্যে রাজ্যে মহাসমাবেশ করেছেন। শান্তি ও সম্প্রীতির পক্ষে জনমত তৈরি করছেন। একইভাবে বাংলাদেশও আজ চরম অসহিষ্ণুতা ও হিংসার বলি হলেও আমাদের লেখক, শিল্পী কিংবা নাগরিক সমাজকে সেই অপশক্তির বিরুদ্ধে যূথবদ্ধ হয়ে রাস্তায় নামতে দেখা যায় না। অথবা রাস্তায় নামলেও তাঁদের কণ্ঠ এত ক্ষীণ যে তা সন্ত্রাসীদের কর্ণকুহরে পৌঁছায় না।
ভারতে তবু আমির খানের ওপর হুমকির প্রতিবাদ করেছেন সে দেশের অনেক রাজনীতিক, লেখক-শিল্পী ও সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষ। কিন্তু বাংলাদেশের অলোক সেনদের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানাতে দেখিনি কোনো রাজনীতিককে। প্রতিবাদ সমাবেশ করেননি সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের কেউ। সেই কাজটি করতে হলো হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের নেতা-কর্মীদেরই।
আমাদের বিবেক এতটাই অন্ধ ও বধির হয়ে গেছে!
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
[email protected]