স্বাধীনতা না পেলে কী হতো?

স্বাধীনতা যদি আমরা না পেতাম, তাহলে কী হতো? বাংলামোটরের নাম থাকত পাক-মোটর, শুধু কি এইটুকুই ঘটত? একটা ছোট্ট স্লাইড শো দেখলাম ইউটিউবে। কোনো তরুণ বানিয়েছেন, বিজয় দিবস উপলক্ষে। ফেসবুকে শেয়ার করা হয়েছে, দেখে ফেললাম। খুবই আবেগ-উদ্দীপক। বলা হচ্ছে, যদি বাংলাদেশ স্বাধীন না হতো, তাহলে কী কী হতো? ঢাকার রাস্তার সাইনবোর্ড বিলবোর্ডে সব লেখা থাকত উর্দুতে। কক্সবাজারকে বলা হতো, পাকিস্তানের সমুদ্রসৈকত। জাতীয় স্মৃতিসৌধ থাকত না। ড. ইউনূসকে বলা হতো পাকিস্তানের নোবেলজয়ী। সাকিব আল হাসানকে বলা হতো, পাকিস্তানের ক্রিকেটার, যিনি বিশ্বের ১ নম্বর অলরাউন্ডার। ইত্যাদি। 
ওই ভিডিওটা যাঁরা বানিয়েছেন, তাঁদের ধন্যবাদ। তবে তাঁরা খুব সামান্যই কল্পনা করতে পেরেছেন দেশ স্বাধীন না হলে কী ঘটত আসলে। দেশ স্বাধীন না হলে সাকিব আল হাসান পৃথিবীর ১ নম্বর অলরাউন্ডার ক্রিকেটার কোনো দিনও হতে পারতেন না। ড. ইউনূসও নোবেল পুরস্কার পেতেন না। 
প্রথম কথা হলো, বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে সাকিব আল হাসানের যে প্রতিভা, সেটা আবিষ্কৃতই হতো না। বিকেএসপি বলতেই কোনো প্রতিষ্ঠান থাকত না। সাকিব আল হাসানও ক্রিকেটার হওয়ার চেষ্টা করতেন না। কারণ পাকিস্তানের জাতীয় দলে কোনো বাঙালিই কোনো দিন সুযোগ পেত না। পাকিস্তানিরা বাঙালিকে ভাবত ঊনমানুষ, মানুষের চেয়ে কিছু কম। মুসলমান তো ভাবতই না। যোদ্ধাজাতি তো ভাবতই না, ভাবত দুর্বল ছোটখাটো কালো মানুষের দল হিসেবে। তারা সেনাবাহিনীতে স্থান পাওয়ার যোগ্য নয়। খেলাধুলা তো তারা পারবেই না। ভাত খাওয়া এই ছোটখাটো কমজোর মানুষগুলো ক্রিকেট খেলবে কীভাবে? কাজেই বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে কোনো বাঙালি বড় ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেই পারত না। তারা শুধু পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিয়ে গঠিত পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে সমর্থন করেই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে বাধ্য হতো। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে বলে বাংলাদেশ দল টেস্ট খেলছে, ওডিআই খেলছে। খেলছে বলেই এত এত ক্রিকেটার তৈরি হচ্ছে। খুব সহজ একটা উদাহরণ হাতের কাছে আছে। পশ্চিম বাংলা থেকেই তো ভারতীয় জাতীয় দলে বাঙালি ক্রিকেটার সুযোগ পেয়েছে খুব কম। বাংলাদেশ যেদিন প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেছিল ভারতের বিরুদ্ধে, সৌরভ গাঙ্গুলি ছিলেন ভারতের অধিনায়ক, পশ্চিমবঙ্গের কাগজগুলো আনন্দ প্রকাশ করেছিল এই বলে যে, দুজন বাঙালি দুটো দেশের টেস্টের অধিনায়কত্ব করছেন। আর বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানকে হারায়, তখনো কলকাতার কাগজগুলো খুশি হয়ে বলে ১১ জন বাঙালি হারিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানিদের। 
স্বাধীনতা হলো সেই পরশপাথর, যা বদলে দিয়েছে বাংলাদেশের চিন্তা-চেতনা, বড় করেছে মানুষের বুকের পাটা, তাদের করেছে চির উন্নত শির। আর ব্র্যাক বলুন, গ্রামীণ ব্যাংক বলুন, সবই স্বাধীনতার পরে দেশ গড়ে তোলার কর্মযজ্ঞের ফসল। স্বাধীনতা ছাড়া ব্র্যাক হতো না, গ্রামীণ হতো না। আজকে যে বাংলাদেশ সবকিছুতে ভালো করছে, খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ, ফল উৎপাদনে রেকর্ডধারী, মাছ উৎপাদনে দুনিয়ার সেরাদের তালিকাভুক্ত, গার্মেন্টস রপ্তানিতে অন্যতম সেরা—এর সবই সম্ভব হয়েছে স্বাধীনতা পেয়েছি বলে। মানব উন্নয়ন সূচকে যে বাংলাদেশ ভালো করছে, ভালো করছে ভারতের চেয়েও, তাও সম্ভব হচ্ছে আমরা স্বাধীন দেশ বলে। ৪৪ বছর আগে আমেরিকানরা বলত, পূর্ব পাকিস্তান কেন স্বাধীন হতে চায়, একটাও খনিজ সম্পদ নেই, ওই দেশ তো অর্থনৈতিকভাবে ভায়াবল হবে না, ওরা তো মারা যাবে। ৪৪ বছর পরে তারাই বলছে, বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্থনীতির একটা। 
এর সবই সম্ভব হয়েছে দেশ স্বাধীন হয়েছে বলে। আর সেই স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেটাকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, পুরো দেশকে স্বাধীনতার নামে পাগলপারা করে তুলেছিলেন একজন মানুষ—তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান। আমরা আজকের এই গৌরবের দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করব, শ্রদ্ধা জানাব মুক্তিযুদ্ধের নেতৃবর্গকে, মুক্তিযোদ্ধাদের, তিরিশ লাখ শহীদকে, লক্ষÿ লক্ষÿ বীরাঙ্গনাকে এবং মনে রাখব, গোটা জাতিই সেদিন উদ্বুদ্ধ হয়েছিল এক মন্ত্রে—স্বাধীনতা। শুধু ব্যতিক্রম ছিল কতিপয় আলবদর-রাজাকার দালাল। 
বড় দাম দিয়ে অর্জন করতে হয়েছে এই স্বাধীনতা। ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বরে ডেইলি স্টারে জুলিয়ান ফ্রান্সিস একটা প্রবন্ধ লিখেছেন। তাতে তিনি হিসাব কষে দেখিয়েছেন একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের সংঘটিত গণহত্যার শিকার মানুষের সংখ্যা তিরিশ লাখের বেশি। 
আজাদের মায়ের কথা আবারও বলব। আজাদ ক্লাস সিক্সে পড়ত সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে। তার বাবা ছিলেন ভীষণ বড়লোক, ইস্কাটনে তাদের বাড়িতে সরোবর ছিল, হরিণ ছিল, মসলার বাগান ছিল। আজাদের বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করলেন। প্রতিবাদে আজাদের মা বের হয়ে গেলেন স্বামীর রাজপ্রাসাদ থেকে, ক্লাস সিক্সের ছাত্র আজাদকে নিয়ে। তিনি বস্তিঘরে আশ্রয় নিলেন। আজাদ ম্যাট্রিক পাস করল, আইএ পাস করল, ডিগ্রি পাস করল, এমএ পাস করল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, ১৯৭১ সালে। আজাদের বন্ধুরা যুদ্ধে গেছে। তারা গেরিলা অপারেশন করে। আজাদকে বলল, তুই কি আমাদের সাথে অপারেশনে যাবি। আজাদ বলল, মা ছাড়া এই জগতে আমার কেউ নাই, মায়েরও আমি ছাড়া কেউ নাই। মা যদি অনুমতি দেন, তাহলেই আমি কেবল যুদ্ধে যেতে পারি। আজাদ মাকে বলল, ‘মা, আমি কি যুদ্ধে যেতে পারি।’ মা বললেন, ‘নিশ্চয়ই।’ আজাদ যুদ্ধে গেল। তাদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নিল। ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট ঢাকার মুক্তিযোদ্ধা শেল্টারগুলোয় পাকিস্তানি বাহিনী হানা দেয়। আজাদদের বাড়িতে গোলাগুলি হয়। আজাদ, জুয়েল, বাশার প্রমুখকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি মিলিটারি। আজাদকে রমনা থানায় রাখা হয়। আজাদের মা রমনা থানায় গেলে পাকিস্তানি বাহিনীর দালালরা বলল, ‘আজাদকে রাজসাক্ষী হতে বলেন, ও যেন সবার নাম ধাম বলে দেয়। তাহলে ওকে ছেড়ে দে​ওয়া হবে।’ আজাদের মা ছেলেকে বললেন, ‘শক্ত হয়ে থেকো বাবা, কোনো কিছু স্বীকার করবে না।’ আজাদ বলল, ‘মা, কয়েক দিন ভাত খাই না। আমার জন্য ভাত নিয়ে এসো।’ 
মা বহু যত্ন করে ছেলের জন্য ভাত রেঁধে টিফিন ক্যারিয়ারে সাজিয়ে নিয়ে রমনা থানায় এলেন। এসে দেখলেন, ছেলে নেই। এই ছেলে আর কোনো দিনও ফিরে আসেনি। এবং এই মা আরও ১৪ বছর বেঁচেছিলেন, আর কোনো দিনও ভাত খাননি। 
আমাদের মায়েরা তাঁদের সন্তানদের উৎসর্গ করেছিলেন স্বাধীনতার জন্য। আমাদের ভাইবোনেরা তাঁদের জীবন ও সম্মান উৎসর্গ করেছিলেন আমাদের স্বাধীনতার জন্য। আজকে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। তাই আজকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশের মানুষের ভেতরে কী ভীষণ সম্ভাবনা আছে, তা আমরা কার্যক্ষেত্রে প্রমাণ করে দেখিয়ে দিচ্ছি। নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করার উদ্যোগের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়ে গেছে, বাংলাদেশকে আর কেউ দাবায়া রাখতে পারবে না। 
এখন দরকার সুশাসন, দরকার মানবাধিকার, দরকার মুক্ত পরিবেশ, দরকার অর্থবহ গণতন্ত্র। কম আয়ের দেশে সুশাসন আনা কঠিন। আয় বাড়লে সুশাসন আনা সহজ। আমরা মধ্য আয়ের দেশ হচ্ছি। এবার আমাদের চাই আরও গণতন্ত্র, আরও মানবাধিকার, আর স্বাধীনতা। দরকার মুক্ত পরিবেশ। দরকার বৈষম্য-মুক্তি, দরকার সাম্প্রদায়িকতা-মুক্তি, দরকার সম্প্রীতি। আমরা এই লক্ষ্যও অর্জন করতে পারব। কারণ এই দেশ যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে। বীরের এ রক্তস্রোত মায়ের এ অশ্রুধারা, তা ধরার ধুলায় হারিয়ে যেতে পারে না। এ জাতিকে কেউ দাবায়া রাখতে পারবে না।