রামপাল ও সুন্দরবনের দূষণ

রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করলে সুন্দরবনের পরিবেশ দূষিত ও বিনষ্ট হবে, এমনকি দীর্ঘ সময়ে তা বনের জীববৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ফেলবে, এ বিষয়ে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। অন্য পক্ষে, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সরকার মনে করে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি করবে না এবং সে কারণে এটি স্থাপনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কোনো পরিবর্তন আনার প্রয়োজন নেই। পরিবেশ বিনষ্ট হতে পারে, এরূপ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুটি পরস্পরবিরোধী মত যখন সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়, তার পরিণতি যে কখনো সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে, সে উদাহরণ দেশে-বিদেশে বিদ্যমান। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন বা ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত কয়লাখনি প্রকল্প কিংবা কানাডায় নিউ ব্রন্সউইকে তেল-গ্যাসবিরোধী আন্দোলনগুলো সেসবের সাক্ষ্য বহন করে। সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি কারও কাম্য নয়, তাই পারস্পরিক আলোচনা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে একদিকে পরিবেশবিদ ও সাধারণ জনগণ এবং অন্যদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নকারীদের মধ্যে সমঝোতা হওয়া বাঞ্ছনীয়।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করলে পরিবেশ দূষিত হয়, তা সর্বজনস্বীকৃত বৈজ্ঞানিক সত্য। তবু বিশ্বে কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় সবচেয়ে বেশি। কয়লাদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব মেনে নিয়েই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী চালু রয়েছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু থাকবে, কিন্তু কোনো দূষণ হবে না, এটি অবাস্তব চিন্তা। তাহলে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে এত বিতর্ক কেন? এর কারণ হলো, রামপাল সাধারণ কোনো স্থানে অবস্থিত নয় বরং এটি বিশ্বের অনন্য অভয়ারণ্য এক ও একক সুন্দরবনের অতি নিকটে অবস্থিত এবং এখানে প্রস্তাবিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উদ্ভূত দূষক বনভূমিটির জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে বলে পরিবেশবিদেরা আশঙ্কা করছেন। বিশ্বখ্যাত যে সুন্দরবন বাংলাদেশের প্রকৃতির সবচেয়ে বড় সম্পদ, তার পরিবেশকে বিপজ্জনকভাবে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া থেকে বিরত রাখতে পরিবেশবিদদের দাবি ধীরে ধীরে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে।
পরিবেশবিদদের দাবি, কয়লা পোড়ানোর কারণে উদ্ভূত দূষণ বাতাস, পানি ও মাটিতে—সব ক্ষেত্রেই বিস্তার লাভ করবে। কয়লা পোড়ানো থেকে উদ্ভূত এসব মৌলিক দূষণ ছাড়াও সুন্দরবনের মধ্যে পশুর নদ দিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া কয়লাবাহী জাহাজ চলাচলের সময় নদীর দূষণ ঘটবে। এ ছাড়া ড্রেজিং, শব্দ, ফ্লাডলাইট ও আনুষঙ্গিক অপরাপর উপাদানগুলো সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিপন্থী। অন্য পক্ষে, সরকার দাবি করছে, বাতাস, পানি ও মাটির দূষণ রোধকল্পে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে, তাই তা বিপজ্জনক পর্যায়ে যাবে না। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে পশুর নদপথে কয়লাবাহী জাহাজ নদে কোনো দূষণ করবে না। বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে আনুষঙ্গিক কোনো দূষণ ঘটবে না।
প্রকৃতপক্ষে কয়লা পোড়ালে কী ধরনের দূষক নির্গত হয় এবং তা কীভাবেই বা পরিবেশকে দূষিত করে? কয়লা পোড়ালে বায়বীয়, কঠিন ও তরল—এই তিন প্রকৃতির দূষক নির্গত হয় এবং এগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পরিবেশকে দূষিত করে। প্রথমত, কয়লা পোড়ালে কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড ও সালফার ডাই-অক্সাইড—এ তিনটি বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হয় এবং তা বাতাসে মিশে পরিবেশ বিনষ্ট করে। দ্বিতীয়ত, কয়লা পোড়ানোর কারণে উদ্ভূত ছাই মিহিদানাদার একটি কঠিন দূষক, যার ভেতর বেশ কিছু বিষাক্ত ভারী ধাতব পদার্থ যেমন পারদ, সিসা ও আর্সেনিক থেকে থাকে। বিশ্বব্যাপী বহু বছর ধরে কয়লার ব্যবহার (বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে) পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে যে দূষণ ঘটিয়েছে, তার পরিণতিতে আবহাওয়ার তাপমাত্রা বেড়েছে, নির্গত গ্যাস জলীয় বাষ্পের সংস্পর্শে বিষাক্ত অ্যাসিড তৈরি করেছে, নির্গত ছাই পরিবেশ দূষিত করেছে।
রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সরকারপক্ষ বলছে, এটিতে ‘সুপারক্রিটিক্যাল টেকনোলজি’ ব্যবহার করা হবে, যার মাধ্যমে পোড়ানো কয়লা থেকে উদ্ভূত বিষাক্ত গ্যাস ও ছাইসমূহ বাতাসে ছড়ানোর আগেই বহুলাংশে আটকে দেওয়া যাবে। তবু যে পরিমাণ বিষাক্ত গ্যাস বাতাসে নির্গত হবে, তার একটি পরিমাপ দেওয়া হয়েছে। দেখানো হচ্ছে যে সুন্দরবন এলাকায় যেখানে সাধারণভাবে বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে ৮ মাইক্রোগ্রাম, বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা পোড়ানোর পর তা নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি সময়ে বেড়ে দাঁড়াবে প্রতি ঘনমিটারে ৫৩ মাইক্রোগ্রাম; যা কিনা আবাসিক ও গ্রাম্য অঞ্চলে বাতাসে সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে কম (ইআইএ চূড়ান্ত রিপোর্ট, ২০১৩)। আর এখানেই পরিবেশবিদদের সুনির্দিষ্ট বিরোধিতা যে সুন্দরবন তো আবাসিক বা গ্রাম্য অঞ্চল নয়, বরং এটি অতিমাত্রায় প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যে ভরপুর পরিবেশ স্পর্শকাতর একটি এলাকা। তাই সুন্দরবনের জন্য আবাসিক ও গ্রাম্য এলাকার গ্রহণযোগ্য সর্বোচ্চ গ্যাস মাত্রা গ্রহণ করা নেহাতই দায়িত্বহীনতার পরিচয় অথবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সুতরাং সুপারক্রিটিক্যাল টেকনোলজি প্রয়োগের মাধ্যমে দূষিত পদার্থ বহুলাংশে কমিয়ে আনার যে ব্যবস্থাপনা, তা একটি সাধারণ এলাকার জন্য উপকার বয়ে আনতে পারে; কিন্তু তা সুন্দরবনের মতো পরিবেশ স্পর্শকাতর এলাকার জন্য যথেষ্ট নয়।
এবার দেখা যাক, তরল প্রকৃতির দূষকগুলোর সমস্যা। তরল প্রকৃতির দূষকের একটি উৎস আধুনিক ক্লিন কোল টেকনোলজি প্রয়োগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। সহজভাবে বলতে গেলে, কয়লা পোড়ানোর পর দূষিত বাতাস ও ছাইসমূহকে আটকে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় যে পানি ও রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়, তার বর্জ্য (ওয়েস্ট ওয়াটার) অন্য এক বিষাক্ত তরল দূষক হিসেবে তৈরি হয়। আর এই তরল দূষক নিয়ে যত বিপত্তি। অর্থাৎ রামপালে সুপারক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করে বায়ুদূষকগুলো আটকে দেওয়ার যে দাবি করা হচ্ছে, তা প্রকৃতপক্ষে অন্য এক তরল দূষকের জন্ম দেবে। আর তা কেবল এখানেই নয়, বরং এ সমস্য বিশ্বব্যাপী ক্লিন কোল টেকনোলজিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস-এ সম্প্রতি প্রকাশিত বেশ কয়েকটি রিপোর্টে তার প্রতিফলন দেখা যায়। নিউ জার্সির একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উন্নততর প্রযুক্তির (স্ক্রাবার) মাধ্যমে বিষাক্ত গ্যাস ও ছাই আবদ্ধ করার ব্যবস্থা প্রয়োগ করলে পাশের লোকালয় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই দেখা যায় যে এ প্রযুক্তিতে যে পানি ও রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছে, তা ফেলতে হয়েছে পাশের নদনদীতে, যা কেবল নদনদীর পানিকেই দূষিত করেনি, বরং ভূগর্ভস্থ খাওয়ার পানিকে দূষিত করে তুলেছে। সেখানকার ভুক্তভোগী একজন বাসিন্দা বলছেন, ‘আমাদের বিষাক্ত বাতাসের পরিবর্তে এখন বিষাক্ত পানি সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র।’ ওই রিপোর্টে চার্লস ডুহিগ লিখছেন: যুক্তরাষ্ট্রব্যাপী বহু কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বায়ুদূষণ কমানোর জন্য উন্নততর প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে বায়ুদূষণ কমেছে বটে, কিন্তু তার বিনিময়ে পানি বা তরল দূষণের জন্ম দিয়েছে। আর এই দূষিত পানিকে ট্রিটমেন্ট করে পরিপূর্ণভাবে পরিষ্কার করা যায় না।
রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে পশুর নদ থেকে পানি নিয়ে ব্যবহার করা হবে আর ব্যবহারের পর যে পরিমাণ পানি নদেতে আবার ফেলে দেওয়া হবে, তার পরিমাণ ঘণ্টায় পাঁচ হাজার ১৫০ ঘনমিটার (ইআইএ চূড়ান্ত রিপোর্ট, ২০১৩)। এর সঙ্গে যুক্ত থাকবে দূষিত বায়ু ও ছাই আটক করার কাজে ব্যবহূত স্ক্রাবার থেকে বের হওয়া দূষিত পানি। এই দূষিত পানি পশুর নদে পড়ে সোজা গিয়ে ঢুকবে সুন্দরবনের ভেতর। অন্য দূষক বিষাক্ত ধাতব পদার্থসংবলিত ছাই একটি কঠিন পদার্থ, যা বাতাসে নির্গত হওয়ার আগে তাকে বহুলাংশে আটকে রেখে জমা করা হবে। কিন্তু বাতাস থেকে আলাদা করে মাটিতে রাখলে তা যথেষ্ট দূষণ ঘটাতে পারে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রায় এক হাজার ৪০০ একর এলাকা ভরাট করার জন্য এ ছাই ব্যবহার করা হতে পারে (ইআইএ চূড়ান্ত রিপোর্ট, ২০১৩)। রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নকশা অনুযায়ী পশুর নদের তীরে বিদ্যুৎকেন্দ্রসংলগ্ন ছাই ফেলে দেওয়ার পুকুর (অ্যাশ ডিসপোজাল পন্ড) ও তার পাশে কয়লা স্তূপাকারে জমা রাখার স্থান (লোকাল স্টকইয়ার্ড) উভয়েই নদের পানিকে দূষিত করার সম্ভাব্য উপাদান। এখান থেকে কয়লা ও ছাই যথার্থ ব্যবস্থাপনার অভাবে সংলগ্ন পশুর নদের পানিকে দূষিত করবে, যা কেবল অল্প দূরত্ব পেরিয়ে সরাসরি সুন্দরবনে গিয়ে পৌঁছাবে।
পরিবেশ অধিদপ্তর যে ইআইএ রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিবেশ ছাড়পত্র দিয়েছে, প্রকৃতপক্ষে তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। প্রকল্পবিরোধীরা বলছেন, রিপোর্ট প্রদানকারী সিইজিআইএস সরকার নিয়ন্ত্রণাধীন সংস্থা এবং সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে তারা নিরপেক্ষভাবে পরিবেশে প্রভাব জরিপ না করে বরং সরকারি ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছে মাত্র। তদুপরি রামপালকে প্রকল্প স্থাপনের স্থান হিসেবে নির্বাচন ও ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে; উপরিউক্ত ইআইএ রিপোর্ট দেওয়ার আগে যা বিতর্কের মাত্রা বাড়িয়েছে মাত্র। একটি নিরপেক্ষ সংস্থা দিয়ে পরিবেশ প্রভাব নিরূপণ করা না হলে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। সরকারের পক্ষে দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনা হবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি রামপালের পরিবর্তে সুন্দরবন থেকে নিরাপদ দূরত্বে নির্মাণ করা। সুন্দরবন বিশ্বনন্দিত অমূল্য বনাঞ্চল, যা কিনা বাংলাদেশকে প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের শীর্ষে নিয়ে গেছে। কোনো ভুল সিদ্ধান্ত বা ব্যবস্থাপনার কারণে প্রকৃতির দেওয়া এই অনন্য উপহার ক্ষতিগ্রস্ত হোক, তা কারও কাম্য নয়।
ড. বদরূল ইমাম, অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।