আমার গুরু শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন

.
.

দেশ-কালের সীমানা পেরিয়ে যাঁর প্রতিভার ব্যাপ্তি, বাংলাদেশের মানুষের কাছে যিনি শিল্পবোধ, শিল্পচেতনা ও শিল্পের সৌন্দর্যকে ছড়িয়ে দিয়েছেন, বিশ্বের সংস্কৃতির সঙ্গে যিনি নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলেন, তিনি আমার গুরু শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। আজ তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
জয়নুল আবেদিনের সৃজনশীলতা ও শিল্পদর্শন তাঁকে মহান করেছে। তাঁর শিল্পের গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে জীবদ্দশাতেই দেশ-বিদেশে শিল্পবোদ্ধা, শিল্পসমালোচক ও শিল্পচেতনাসমৃদ্ধ সব মানুষের কাছে তিনি সমাদৃত হয়েছেন।
শৈল্পিক গুণে গুণান্বিত একজন মানবতাবাদী, হৃদয়বান, দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে এ দেশের মানুষের প্রতি ছিল তাঁর অসীম দরদ। চারুশিল্পের শিক্ষক হিসেবে এ দেশে শিল্পরুচি বিনির্মাণে তিনি ছিলেন অগ্রণী। আমার পরম সৌভাগ্য, চিরকাল সুন্দরের স্বপ্ন দেখা এই মানুষটির সরাসরি ছাত্র ছিলাম আমি। শিল্পের আঙিনায় বিশাল এই মানুষটির সাহচর্য পেয়েছিলাম। শান্তিনগরে তাঁর বাসার কাছাকাছি আমাদের আবাস থাকায় তাঁর সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ গড়ে ওঠার সুযোগ হয়।
তাঁর বাসায় প্রায়ই দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট ও বরেণ্য ব্যক্তিদের আগমন ঘটত। তাঁদের মধ্যে যাঁদের নাম আমার মনে পড়ছে, তাঁরা হলেন কবি গোলাম মোস্তফা, গায়ক আব্বাসউদ্দীন আহমদ, জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, অর্থনীতিবিদ ড. এম এন হুদা, কবি জসীমউদ্দীন, কথাশিল্পী শওকত ওসমান, অধ্যাপক মনসুরউদ্দিন, গায়ক মমতাজউদ্দিন, কলিম শরাফী, আবদুল লতিফ, আবদুল গণি হাজারী, সিকান্দার আবু জাফর, শহীদুল্লা কায়সার, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখ।
এ ছাড়া তখনকার বিশিষ্ট শিল্পী তাঁর সহকর্মী আনোয়ারুল হক, কামরুল হাসান, সফিউদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ কিবরিয়া, মীর মোস্তফা আলী, মুস্তাফা মনোয়ারসহ আরও কেউ কেউ আড্ডা দিতে আসতেন তাঁর বাসায়। ভারতবর্ষের বিখ্যাত শিল্পসমালোচক মুলকরাজ আনন্দও এসেছিলেন তাঁর বাসায়। তাঁর ছাত্র ও পরবর্তী সময়ে সহকর্মী বিশিষ্ট শিল্পী আমিনুল ইসলাম, ইমদাদ হোসেন, কাইয়ুম চৌধুরী, হামিদুর রাহমান, আবদুর রাজ্জাক, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, মুর্তজা বশীর, দেবদাস চক্রবর্তীরা আসতেন তাঁদের আঁকা কাজ দেখাতে, ভুলত্রুটি সংশোধন করতে এবং শৈল্পিক জ্ঞান অর্জনের জন্য। পরে এই শিল্পীরাই দেশে-বিদেশে তাঁদের শিল্পকর্ম দিয়ে সুপরিচিত হয়েছেন। এই গুণী মানুষদের অনেকেই আজ আর বেঁচে নেই। এই সুযোগে তাঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
আবেদিন স্যারের বাসায় বিদগ্ধজনের এই আড্ডায় আমার অংশগ্রহণের সুযোগ হতো। আড্ডার কনিষ্ঠজন ও প্রতিবেশী হিসেবে মাঝেমধ্যে ভাবির অনুরোধে ভেতরবাড়ি থেকে চা-নাশতা সরবরাহের দায়িত্বও বর্তাত আমার ওপর। এতে আমি প্রফুল্লবোধ করতাম। এই আড্ডার আলোচনার অনেক কিছুই বুঝতাম না, তারপরও মনের অজান্তেই কী এক ভালো লাগার বোধ ওই আসরে আমাকে টেনে নিয়ে যেত। এর সুবাদে ভাবি বেগম জাহানারা আবেদিন এবং তাঁদের তিন পুত্র—সাইফুল আবেদিন টুটুল, খায়রুল আবেদিন টুকুন ও ময়নুল আবেদিন মিতুর সঙ্গে আমার যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়, আজও তা অটুট ও অম্লান রয়েছে।
এলাকার ছেলেরা যাতে খেলাধুলা করতে পারে, সেদিকেও তাঁর বিশেষ দৃষ্টি ছিল। শান্তিনগর ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি। এই এলাকার ছেলে পরে রাজনীতিক মোজাফফর হোসেন পল্টু ছিলেন ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক। আবেদিন স্যার পাকিস্তানে গেলে ক্রিকেট ব্যাট-বলসহ অন্যান্য খেলার সামগ্রী নিয়ে আসতেন। সে সময়ের নামজাদা ক্রিকেটার রিয়াজউদ্দিন মানুকে আবেদিন স্যার ক্রিকেট দলের অধিনায়ক করেছিলেন। তিনিও আসতেন স্যারের বাসায়।
আউটডোরে ছবি আঁকতে আবেদিন স্যারের সঙ্গী হয়েছি অনেকবার। স্যারের মেজ ছেলে টুকুনও মাঝেমধ্যে যেত আমাদের সঙ্গে। স্যারের প্রিয় বিষয় ছিল প্রকৃতি, বিশেষ করে নদী ও নৌকা। তাঁর আঁকার জন্য কাগজ বিছিয়ে দিতাম, রং বের করে প্যালেটে ঢেলে দিতাম। ইনডিগো নীল ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয় রং। আকাশ ও নদীর জল আঁকতে তিনি এই রংটি ব্যবহার করতেন।
একদিনের কথা বলি। আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন নৌকার ছবি আঁকতে। অবাক হয়েছিলাম। জয়নুল আবেদিনকে নৌকার ছবি আঁকতে নতুন করে নৌকা দেখতে হবে! পরে বুঝলাম, তিনি নৌকা দেখার জন্য যাননি। তিনি নৌকায় চড়ে নৌকার দোলা অনুভব করতে গিয়েছিলেন।
স্যারের কাছে গিয়ে বলি, স্যার, নৌকার ছবি আঁকতে এসে নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন; ছবি আঁকা হলো না।
স্যারের জবাব, ‘নৌকা তো কতই দেখছি মিয়া, কিন্তু নৌকায় চড়লে কেমন লাগে, হেইডা অনুভব না কইরা, নৌকার দোলা না খাইয়া, বাবা, নৌকারে বুঝবা কেমনে! নইলে নৌকার ছবি তো মিয়া ডাঙায় উইঠা আইব!’
সেই দিনই বুঝেছিলাম জয়নুল আবেদিনের ছবি কেন এত জীবন্ত হয়। তাঁর চোখ কোনো কিছুকে বাইরে থেকে দেখত না। সবকিছুকে তিনি এ দেশের প্রকৃতি ও মাটি থেকে সংগ্রহ করতেন।
মহিলা সমিতি মঞ্চে থিয়েটারের নাটক দেখাতে একবার স্যারকে সপরিবারে নিয়ে এসেছিলাম ১৯৭৪ সালে। প্রয়াত বন্ধু আবদুল্লাহ আল-মামুনের চারদিকে যুদ্ধ প্রদর্শন হচ্ছিল সেবার। নাটক শেষে জয়নুল আবেদিন আমাদের নাটকের প্রশংসা করেছিলেন। আমাকে বলেছিলেন, ‘মিয়া, নাটকে অভিনয় চালাইয়া যাইবা, এটাও শিল্প।’ আমি সেই থেকে নাটকে আরও বেশি সম্পৃক্ত হলাম।
হাসপাতালে শুয়েও নিজের জীবনের উপমা খুঁজে পেয়েছিলেন কোকিলের ডাকে। আবেদিন স্যার পিজি হাসপাতালে অসুস্থ থাকা অবস্থায় একদিন আচমকা কোকিলের ডাক শোনা গিয়েছিল। আমি ছিলাম পাশেই। হঠাৎ স্যার ভাঙা কণ্ঠে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘অহন কোকিল ডাকে ক্যান রে!’ আমি উত্তর খোঁজার আগেই বললেন, ‘ক্যান ডাকে জানস? কোকিল ডাকে দুইবার। বসন্তকালে ডিম পাড়নের আগে। আরেকবার কুনহানে ডিম পাড়ছিল, হেই বাড়ি খুঁজবার সময়। হেই সময় কোকিলের ডাক বেসুরো হইয়া যায়। কোকিল অহন বাড়ি খুঁজতাছে। হের তো নিজের বাড়ি নাই, অন্যের বাড়িতে ডিম পাড়ে। আমারও বাড়ি নাই অহন, আমিও কোকিলের মতো বাড়ি খুঁজতাছি।’ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁকেও যেতে হবে অন্য কোনো বাড়িতে।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন একজন মহাপুরুষ হয়েও আমার কাছে তিনি ছিলেন বড় কাছাকাছির মানুষ। খুব আপনজন—যেমন আমি আমার আনন্দ-বেদনায় আমার মা–বাবাকে খুঁজে বেড়াই, তেমনি খুঁজে বেড়াই আমার শিল্পগুরু জয়নুল আবেদিনকে।
কেরামত মওলা: নাট্য অভিনেতা।