যানজটে জানজট

.
.

ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ির খাঁচায় আটকে থেকে অসহায় পাখির মতো ছটফট করা ঢাকা শহরের নিত্যদিনের বাস্তবতা। এই নরকযন্ত্রণা থেকে মুক্তির অনেক উপায়ের কথা বলা হয়েছে গত দেড় দশকে। শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণে রাস্তার সংখ্যা বাড়াতে হবে। ঢাকার চারপাশে একটি চক্রাকার সড়ক নির্মাণ করাও জরুরি। ঢাকার ওপর মানুষের চাপ কমাতে আশপাশের শহরগুলোর সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ করে সরকারি অফিস-আদালত শহর ও দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দিতে হবে।
মেট্রোরেল অবশ্যই একটি ভালো সমাধান, কিন্তু এর নির্মাণ সময়সাপেক্ষ। আপাতত বাসের সংখ্যা ও রুট উভয়ই বাড়াতে হবে। ‘গরিবের গাড়ি কেনা নয়, ধনীর গণপরিবহন ব্যবহার করাটাই টেকসই উন্নয়নের সূচক।’—বলেছিলেন লাতিন আমেরিকার এক রাষ্ট্রনায়ক। ঢাকা শহরের ঘেয়ো কুকুরের মতো চেহারার বাসগুলো মধ্য আয়ের একটি দেশের নাগরিক ও নগরপিতাদের উন্নত রুচির পরিচায়ক নয়। উন্নত মানের এবং শীতাতপনিয়ন্ত্রিত নগরবাস চালু করা এখন সময়ের দাবি।
এক থেকে দেড় কোটি মানুষের শহর ঢাকায় রাস্তার তুলনায় গাড়ি অনেক বেশি এবং এ সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। অনেক বাড়িতে বাজার করার জন্য এবং অফিসে যাওয়ার জন্য এক গাড়ি ব্যবহার করা হয় না। এমন পরিবারও নাকি আছে, যার প্রত্যেক সদস্যের জন্য আলাদা গাড়ি আছে। সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকের একাধিক গাড়ি আছে। অথচ কানাডার মতো উন্নত দেশে একাধিক পরিবার মিলে একই গাড়ি ব্যবহার করার সংস্কৃতি চালু হয়েছে। ব্যক্তিগত ও সরকারি গাড়ির সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে কমাতে হবে।
লন্ডন বা প্যারিসের বেশির ভাগ রাস্তার তুলনায় ঢাকার রাস্তা কম প্রশস্ত নয়। কিন্তু বিভিন্ন মার্কেটের সামনে পার্ক করা গাড়ি রাস্তার অনেকখানি দখল করে থাকে বলে ‘বটলন্যাক’ পরিস্থিতি, অর্থাৎ বোতলের গলার মতো রাস্তার অগ্রভাগ সরু হয়ে যানজটের সূচনা হয়। ঢাকার ২০টি রেলক্রসিং, যেগুলো দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৭২টি ট্রেন চলাচল করে, সেগুলোও যানজটের অন্যতম কারণ।
পাশ্চাত্যের উন্নত শহরগুলোর মতো ঢাকাতেও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। পাশ্চাত্যে শহরের ব্যস্ত এলাকায় গাড়ি নিয়ে ঢুকতে গেলে মাশুল দিতে হয়। খুব কম শহরেই বিনা পয়সায় পার্কিং করা যায়। ভুল জায়গায়, বিনা মাশুলে গাড়ি পার্ক করলে পুলিশ বা দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো এজেন্সি গাড়িটি টো করে নিয়ে যায়। বাংলাদেশেও এ ধরনের উদ্যোগ নিলে শহরে গাড়ির সংখ্যা কমবে এবং গাড়ি পার্কিংয়ে শৃঙ্খলা আসবে।
বাংলাদেশে ট্রাফিক আইন মানতে কেউ বাধ্য নয়। পথচারী, রিকশাওয়ালা, ব্যক্তিগত গাড়ি, বাস, ট্রাক কেউ আইন মানে না। প্রশাসন ও মন্ত্রণালয়ের গাড়িও মাঝেমধ্যে রং সাইড দিয়ে যায়। অনেকক্ষণ আটকে থাকার পর ট্রাফিক পুলিশের ইশারায় গাড়ি চলতে শুরু করতেই রাস্তা পার হতে যায় এক বা একাধিক পথচারী। এতে গাড়ির গতি কমে গিয়ে যানজটের সৃষ্টি হয়।
রাস্তা পার হওয়ার জন্য ঢাকায় একসময় জেব্রা ক্রসিং ছিল, কিছুদিন ধরে ওভারব্রিজ সংস্কৃতি চালু হয়েছে। হুইলচেয়ারে চলাফেরা করা লোকদের পক্ষে ওভারব্রিজ ব্যবহার করা অসম্ভব। নিউইয়র্কের মতো ব্যস্ত শহরেও ওভারব্রিজ নেই বললেই চলে। তবে ওভারব্রিজ যদি কোনো কারণে অপরিহার্য হয়, তবে সিঁড়ির ধাপগুলোর উচ্চতা কমাতে হবে। কারণ অনেকেই শারীরিক সমস্যার কারণে উঁচু ধাপের সিঁড়িতে চড়তে পারেন না।
‘আমি অমুক জায়গায় যাব না!’—বিদেশে কোনো ট্যাক্সিওয়ালা এমন কথা বলতেই পারে না। বাংলাদেশে রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালকদের এই বিশেষ অধিকার দেওয়া হয়েছে। ঢাকায় রিকশাওয়ালারা কোনো আইনই মানতে চায় না। কোনো রিকশা একবার রং সাইডে গেলে সেই রিকশাকে অনুসরণ করে অন্য সব গাড়ি, এমনকি অ্যাম্বুলেন্স। আজকাল অনেক সাধারণ গাড়িতেও ব্যবহৃত হয় অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন।
ঢাকা শহরে রিকশা, অটোরিকশা ও ট্যাক্সির নির্দিষ্ট কোনো স্ট্যান্ড নেই। তারা যেখানে খুশি ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকে। যার ফলে রাস্তার প্রশস্ততা কমে যায়। লেগুনা ও বাসের স্ট্যান্ড থাকলেও তারা যেখানে-সেখানে যাত্রী তোলে ও নামায়। অজায়গায় একটি গণপরিবহন থামার মানেই হচ্ছে অন্য সব বাহনের গতি কমে যাওয়া।
ঢাকার রাস্তায় ট্রাফিক লাইট জ্বলে, কিন্তু গাড়ি চলে ট্রাফিক পুলিশের ইঙ্গিতে। তাহলে জনগণের টাকা খরচ করে ট্রাফিক লাইট বসানো কেন? বিদ্যুতের অপচয়ই-বা করা কেন? আইনের রক্ষক যদি উৎকোচের বিনিময়ে আইন ভাঙাকে বৈধতা দেয়, তবে চালকেরা তার নির্দেশ না মানাটাই স্বাভাবিক। ঢাকার রাস্তাগুলো সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা যেতে পারে। যারাই ট্রাফিক আইন ভাঙবে, তাদের গাড়ির নম্বরপত্রের ছবি উঠবে এবং ডাকযোগে ছবিসহ জরিমানার চিঠি চলে যাবে প্রত্যেকের ঠিকানায়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সরকারি বিকাশ নম্বরে জরিমানার টাকা পরিশোধ না করলে প্রদেয় অর্থের পরিমাণ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকবে। ট্রাফিক লাইট দিয়ে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ বা আইন ভঙ্গকারীকে জরিমানা করার দায়িত্ব শুরুতে কয়েক মাসের জন্য সুশৃঙ্খল কোনো বাহিনীর হাতে ন্যস্ত করা যেতে পারে।
পাশ্চাত্যের দেশগুলোর মতো ড্রাইভিং লাইসেন্সে পয়েন্ট সিস্টেম রাখা হোক। প্রত্যেক লাইসেন্সে ১০টির মতো পয়েন্ট থাকবে এবং চালকের অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে পয়েন্ট কাটা যাবে। যেমন ধরা যাক, লাল আলোতে গাড়ি না থামালে ৪ পয়েন্ট চলে যাবে। সব কটি পয়েন্ট কাটা গেলে লাইসেন্স বাতিল হবে এবং পুনরায় পরীক্ষা দিয়ে নতুন করে লাইসেন্স নিতে হবে।
পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ বাংলাদেশের মানুষের স্বভাবে আছে চর দখলের উদগ্র আকাঙ্ক্ষা। দোকানদার-হকার ফুটপাত দখল করে নিয়েছে বলে পথচারী নেমে আসে রাস্তায়। রাস্তার দুই পাশ পার্ক করা গাড়ির দখলে থাকে বলে পথচারীরা রাস্তার মাঝখানে হাঁটতে বাধ্য হয়, যার ফলে বটলন্যাক হয়ে সৃষ্টি হয় যানজট।
বাঙালির দখলের বদভ্যাসকে নিয়ন্ত্রণে এনে ঢাকার রাস্তাকে যানজট এবং ঢাকার জীবনকে জানজটমুক্ত করা আশু প্রয়োজন। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালনের জন্য নয়, নিছক অসহায় নাগরিকদের প্রতি করুণাবশত দুই নগরপিতা কি যানজট সমস্যা সমাধানে ফলদায়ক কোনো উদ্যোগ নেবেন?
শিশির ভট্টাচার্য্য, অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।