দুই নেত্রীর মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন প্রয়োজন

>
হারুন-অর-রশিদ
হারুন-অর-রশিদ
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুই বছর পূর্তিতে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন অধ্যাপক হারুন–অর–রশিদ

প্রথম আলো : ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের দুই বছর পূর্তিতে বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভার কর্মসূচি নেওয়ার পরই আওয়ামী লীগ সেখানে পাল্টা কর্মসূচি নিল। এটাকে কীভাবে দেখেন?
হারুন-অর-রশিদ : আমাদের দেশে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি অনেক দিন ধরেই চলে আসছে। এর উত্তরণ ঘটানো দরকার। তবে এর একটি পটভূমিও আছে। ২০১৪ সালে বিএনপি কেবল নির্বাচন বর্জনই করেনি, নির্বাচন যাতে না হয়, সে জন্য ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। নির্বাচনে অংশ না নেওয়া ছিল বিএনপির মারাত্মক ভুল। তিন সিটিতে অংশ নিলেও তারা মাঝপথে সরে দাঁড়িয়েছিল। এবার সেটা করেনি। এটা যথাযথ সিদ্ধান্ত। বিএনপি ২২টি পৌরসভায় জয়ী হলেও সব সময় সংখ্যাই জয়-পরাজয়ের একমাত্র নির্ধারক নয়। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো তারা যে ভুল পথে গিয়েছিল সেখান থেকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে এসেছে।
প্রথম আলো : বিএনপির অংশগ্রহণ সত্ত্বেও তিন সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় আমরা ভালো নির্বাচন পেলাম না কেন?
হারুন-অর-রশিদ : ‘ভালো নির্বাচন’ কথাটি আপেক্ষিক। আমাদের প্রত্যাশা উন্নত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে ধরনের নির্বাচন হয় সে ধরনের নির্বাচন হবে। কিন্তু একটি ভালো নির্বাচন করতে হলে কতগুলো পূর্বশর্ত পূরণ করতে হয়। যেমন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সুসংহত করা। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৫ বছরে প্রত্যক্ষ সামরিক শাসনই ছিল ১৫ বছর। তাই পৌর নির্বাচনকে ঢালাওভাবে সুষ্ঠু হয়নি, বলা যাবে না। বহু জায়গায় ভালো নির্বাচন হয়েছে। বিএনপি ২২টি মেয়র পেলেও তাদের ভোটের সংখ্যা ২৮ শতাংশ।
প্রথম আলো : কিন্তু এই নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করেছে কি?
হারুন-অর-রশিদ : আমাদের একটি বিষয় বুঝতে হবে, এই সমাজে যার ক্ষমতা বেশি আনুষঙ্গিক শক্তিগুলো তার পেছনেই দাঁড়ায়। রাজনৈতিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সমপর্যায় না হলে ত্রুটি-বিচ্যুতি হওয়া স্বাভাবিক। আগে এই দুই দলের মধ্যে ভোটের পার্থক্য এত ছিল না। বিএনপি দেশের অন্যতম বড় দল হওয়া সত্ত্বেও তার রাজনীতি প্রশ্নবিদ্ধ। তাদের ধারাবাহিক নীতি নেই। একদিকে দলটি সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চা করার কথা বলেছে, অন্যদিকে সহিংস রাজনীতিকে উসকে দিয়েছে।
প্রথম আলো : বিএনপির গণতান্ত্রিক কর্মসূচি নেওয়ার যে সাংবিধানিক অধিকার সেটি কি সরকার স্বীকার করেছে?
হারুন-অর-রশিদ : যখন দুটি দলের পারস্পরিক সম্পর্ক চরম বৈরী, বিদ্বেষমূলক ও অপরকে নির্মূল করার লক্ষ্যে পরিচালিত, তখন তো গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ সম্ভব নয়। একাত্তর ও পঁচাত্তর আমাদের জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে বড় বিভাজনরেখা। সেখানে একাত্তরের ও পঁচাত্তরের ঘাতকদের নিয়ে রাজনীতি করলে কিংবা তাদের প্রশ্রয় দিলে গণতান্ত্রিক সহনশীলতা আশা করা যায় না। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো বিকশিত করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের মৌলনীতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে মেনে নিতে হবে।
প্রথম আলো : ২০১১ সালের পৌর নির্বাচনে কিন্তু বিএনপি অধিকাংশ মেয়র পদ পেয়েছিল? এবারে মাত্র ২২টি।
হারুন-অর-রশিদ : এবারের নির্বাচনটি কোন প্রেক্ষাপটে হয়েছে বুঝতে হবে। তখন তো বিএনপি ৯২ দিন হরতাল-অবরোধের নামে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়নি। নির্বাচনের আগে বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া শহীদদের সংখ্যা নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তা জনগণের অনুভূতিকে আহত করেছে। এটি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে তাঁর সরাসরি অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশে রাজনীতি করা যাবে না।
প্রথম আলো : মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি কেবল আওয়ামী লীগই ধারণ করে? অন্যান্য দল সিপিবি, বাসদ এরাও তো ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয়নি।
হারুন-অর-রশিদ : তারাও ধারণ করে। তারা কখনো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান তুলেছেন। যেকোনো দল নির্বাচন বর্জন করতে পারে কিন্তু জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে না।
প্রথম আলো : বিএনপি তো ভুল স্বীকার করে আপনার ভাষায় ‘গণতান্ত্রিক ধারায়’ ফিরে এসেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ তাদের জায়গা দিচ্ছে না কেন?
হারুন-অর-রশিদ : এখানেও পরিবেশের বিষয়টি মুখ্য। তারা গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে এসেছে, এটাই যথেষ্ট নয়। আবারও যে ধ্বংসাত্মক রাজনীতি করবে না, সেই নিশ্চয়তা দিতে হবে। দুটি প্রধান দলের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। তবে তার ভিত্তি হবে মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনা।
প্রথম আলো : কিন্তু বিএনপিকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন বা সভা-সমাবেশ করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে কি?
হারুন-অর-রশিদ : দিচ্ছে না সে কথা বলা যাবে না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি না পেলেও তারা আজ নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে পারছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সভা-সমাবেশ করার অধিকার সবার আছে। বর্তমানে দুটি দলের মধ্যে যে বিশাল দূরত্ব আছে, তা কমিয়ে আনতে হবে।
প্রথম আলো : দূরত্ব কমানোর দায়িত্ব কি দুই পক্ষেরই নয়?
হারুন-অর-রশিদ : দায়িত্ব পালন করছে বলেই বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী ধন্যবাদ জানিয়েছেন। সরকারকে যেমন এগিয়ে আসতে হবে, তেমনি বিরোধী দলকেও ইতিবাচক সাড়া দিতে হবে। তাদের অধৈর্য হলে চলবে না। জনগণের সঙ্গে থেকে আন্দোলন করতে হবে। কিন্তু মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় এমন কিছু করা যাবে না, যা বিএনপি নেত্রী করেছেন। বিএনপি নির্বাচনে না এলেও দেশের উন্নতি তো থেমে নেই।
প্রথম আলো : অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে গণতন্ত্রের উন্নয়নও কি জরুরি নয়?
হারুন-অর-রশিদ : রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বৃহত্তর সমঝোতা গড়ে উঠলে বাংলাদেশ অচিরেই উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হবে। সে জন্য প্রয়োজন সরকার ও বিরোধী দলের পারস্পরিক সহযোগিতা।
প্রথম আলো :কিন্তু সরকার বিরোধী দলের সহযোগিতা চায় কি?
হারুন-অর-রশিদ : বিরোধী দলের সহযোগিতা চাইতে হবে। আবার বিরোধী দলকেও সরকারের প্রতি আস্থা রাখতে হবে। সম্পর্কোন্নয়ন হতে হবে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। সাম্প্রতিক পৌর নির্বাচন সম্পর্কোন্নয়নের একটি সূচনা হতে পারে। আমাদের রাজনীতির বড় সমস্যা হলো সরকারি ও বিরোধী দল—উভয়ই মনে করে, আমাকে জিততে হবে, বিরোধী দলে থাকলে চলবে না। পরিশীলিত গণতন্ত্রের একটি সূচক হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন করে যদি বিরোধী দল জয়ী হয়। দ্বিতীয় সূচক হলেও নির্বাচনে পরাজয় মেনে নেওয়া।
প্রথম আলো : সম্প্রতি একটি লেখায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওনক জাহান বলেছেন, ৫ জানুয়ারির পর রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের চাবিকাঠি প্রধানমন্ত্রীর হাতে। আপনি কি বলেন?
হারুন-অর-রশিদ : আমি মনে করি বিষয়টি শুধু প্রধানমন্ত্রীর ওপর নির্ভর করে না। বিএনপি নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর আন্তঃসম্পর্কের উন্নয়ন প্রয়োজন। তবে তার পূর্বশর্ত মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনার বিরুদ্ধে যাওয়া যাবে না।
প্রথম আলো : সমঝোতার পরিবেশ হলে কি মধ্যবর্তী নির্বাচন হতে পারে?
হারুন-অর-রশিদ : সেটি নির্ভর করবে সার্বিক পরিস্থিতির ওপর। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী যখন বললেন, বিরোধী দলকে নিয়ে মন্ত্রিসভা করব, তখন বিরোধী দল সেটি মানল না। এখনো মনে করি, সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আস্থার জায়গা তৈরি হলে কর্মপন্থা নির্ধারণ কঠিন নয়। আমার মনে হয় প্রধানমন্ত্রী চান না, বিএনপি দীর্ঘদিন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে থাকুক। সবার জন্য একটি নিরাপদ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দরকার। বৃহত্তর বোঝাপড়ার মধ্য দিয়েই আইনের শাসন নিশ্চিত করা যায়। সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে গেলে হবে না। বিএনপি একটি মারাত্মক অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে। প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল হওয়া সত্ত্বেও তারা সংসদে নেই। এটা দীর্ঘস্থায়ী হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।
প্রথম আলো : ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের প্রতি যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সমঝোতার স্বার্থে আগামী নির্বাচনেও সে রকম প্রস্তাব দেবেন কি না?
হারুন-অর-রশিদ : সেটা এখন বলা যাবে না। পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে।
প্রথম আলো : একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারকে কি পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকা উচিত?
হারুন-অর-রশিদ : সবাইকে নিয়ে নির্বাচন করতে পারলে সেটি উত্তম হতো। সে জন্য পারস্পরিক আস্থা তৈরি করতে হবে। সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসাই এই মুহূর্তে সবার লক্ষ্য হওয়া উচিত। আস্থা ও সহনশীলতার জায়গা তৈরি করতে হবে। এরপর নির্বাচন মধ্যবর্তী হবে, না মেয়াদ শেষে হবে—তা রাজনৈতিক নেতৃত্বই নির্ধারণ করবে।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
হারুন-অর-রশিদ : ধন্যবাদ।