মাহবুব হোসেন: কৃষি ও কৃষকের আপনজন

মাহবুব হোসেন ছোট মেয়ে তপতী ও স্ত্রী পারভিন হোসেনের সঙ্গে
মাহবুব হোসেন ছোট মেয়ে তপতী ও স্ত্রী পারভিন হোসেনের সঙ্গে

বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অধিকারী অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী ড. মাহবুব হোসেনকে (১৯৪৫-২০১৬) গতকাল বাদ জুমা গুলশান আজাদ মসজিদে জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছে। ৪ জানুয়ারি ২০১৬ তিনি নিউজার্সির হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। মাহবুব হোসেন ১৯৪৫ সালের ২ জানুয়ারি নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর মহকুমার বাঙ্গালজী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি প্রাপ্ত হন। ৪৫ বছরের বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে প্রায় ২০ বছর তিনি বিদেশে কাটিয়েছেন।
তিনি ছিলেন এশিয়ান কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির নির্বাচিত সভাপতি (২০১৪-২০১৬), বিশ্বব্যাংকের সভাপতির জ্ঞানবিষয়ক কমিটির সদস্য এবং জাতিসংঘ পুষ্টি কমিটির সদস্য। বাংলাদেশ সরকারের কৃষিনীতি ও বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন-সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি মৌলিক অবদান রেখেছেন। অধ্যাপক রেহমান সোবহানের মতে, তিনি এশিয়ার অন্যতম শীর্ষ কৃষি অর্থনীতিবিদ।
ড. হোসেনের সঙ্গে সর্বশেষ খুদে বার্তা বিনিময় হয় ডিসেম্বরের ১০ তারিখ, ২০১৫, রাত ৯টা ৫৮ মিনিটে। তিনি আমাকে লিখেছেন, ‘আমি গেল সপ্তাহ হাসপাতালে কাটিয়েছি ও একটি বড় ধরনের অস্ত্রোপচারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছি। আমি বর্তমান খসড়ার বেশ কিছু পরিবর্তন আনব। এবার বইমেলায় হয়তো হবে না বরং আমরা পরের বইমেলাকে লক্ষ্য নিয়ে এগোতে পারি।’ তাঁর জীবন নিয়ে একটি বই লেখার জন্য আমি যে পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলাম, সে সম্পর্কে তিনি খুদে বার্তায় ওই মন্তব্যটি করেছিলেন।
দেশভাগের কারণে তিনি দুবার উদ্বাস্তু হয়েছিলেন। তাঁর পিএইচডির বিষয় ছিল কৃষিতে দ্বৈত কাঠামো তথা দারিদ্র্য, গ্রামীণ শিল্প, ক্ষুদ্রঋণ, কৃষি উন্নয়ন বিশেষত কৃষিতে প্রযুক্তি উন্নয়নের বিভিন্ন দিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রকাশনা হলো: Asian Rice Bowls: A Returing Crisis; Rice Researh in Asia; Progess and Prospect; Impact of Rice research in Asia; Strategy of Development in Bangladesh; Rural Economy and Livelihood Insights From Bangladesh: গ্রামের মানুষ গ্রামীণ অর্থনীতি: জীবন জীবিকার পর্যালোচনা; বাংলাদেশের পল্লি উন্নয়ন সমস্যা ও সম্ভাবনা, গল্পে গল্পে অর্থনীতি, গরিব দেশে গরিব মানুষ। তিনি ছিলেন দৃষ্টিভঙ্গিতে বৈশ্বিক ও মননে খাঁটি বাঙালি।
বাংলাদেশ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক হিসেবে ড. মাহবুব নিজে যেমন অনেক গবেষণা করেছেন, তেমনি অন্যদের দিয়ে অনেক গবেষণা করিয়েছেন। মাত্র ৪১ বছর বয়সে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান হয়েছেন। তাঁর যে এমএইচ তথ্যভান্ডার, যা লঙ্গডিটুনিয়াল গবেষণার শস্য ফসল, এই পদ্ধতি সাধারণত চিকিৎসাশাস্ত্র ও মনোবিজ্ঞানে ব্যবহৃত হয়, তা তিনি সফলভাবে অর্থনীতিতে প্রয়োগ করেছেন। পেশাগত কারণে বিদেশে থাকার সময়েও ১৯৯৮ সালে বন্যায় দেশে ছুটে এসেছেন কৃষকদের দুর্দশা লাঘবে। তাঁর গবেষণার ফলে বাংলাদেশে বীজ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে (ইরি) তাঁর সহকর্মী অধ্যাপক জারিয়ার মতে, ‘বাংলাদেশের কৃষকদের সহায়তা করার জন্য ড. হোসেন নিবিড় গবেষণার পাশাপাশি ১৯৯৮-৯৯ সালে বোরো মৌসুমের জন্য ধানবীজ সরবরাহের নিমিত্তে কয়েকটি কোম্পানির সঙ্গে কথা বলেন। কারণ, বর্ষা মৌসুমের ধান ১৯৯৮ সালে বিধ্বংসী বন্যায় নষ্ট হয়ে যায়। যদিও বন্যার পরপরই বাংলাদেশে বীজ সহজলভ্য হয়। এটা তাঁর চাষি সম্প্রদায়ের প্রতি অঙ্গীকার ও উৎকণ্ঠার একটি প্রমাণ।’
মাহবুব হোসেন ১৬ বছর কাটিয়েছেন ইরিতে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ও কিছুদিন গবেষণা মহাপরিচালক হিসেবে। সেখানে আন্তর্জাতিক কৃষি গবেষণার জন্য পরামর্শমূলক গোষ্ঠী (CGIAR)-এর বিকাশে প্রাগ্রসর ভূমিকা নেন। তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র ছিল প্রতিকূল পরিবেশ ও প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং কৃষকদের কাছে তাঁর প্রায়োগিক পরীক্ষাসহ ভিয়েতনামের লাল নদী উপত্যকার অদম্য কৃষক; ইন্দোনেশিয়ার লম্বক আর দুর্যোগ আক্রান্ত এলাকার বিরুদ্ধ পরিবেশের সংগ্রামী মানুষ সুলাইসিদের জীবনসংগ্রাম; পিছিয়ে পড়া পূর্ব ভারতের পরিশ্রমী কিষান ও কিষানি। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, চীনসহ পুরো এশিয়ার কৃষি ও কৃষক।
বেসরকারি সাহায্য সংস্থা বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটির (ব্র্যাক) চেয়ারপারসন ফজলে হাসান আবেদের আমন্ত্রণে তিনি সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক পদে যোগ দেন ২০০৭ সালে। এখানে বিশ্বব্যাংকের আদলে তিনি এমন একটি উন্নয়ন মডেল তৈরি করেন, যাতে অতি দরিদ্র মানুষ বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে পায়। এ ছাড়া নৌকায় শিক্ষাসহ নগরে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মৌলিক শিক্ষাসহ সংস্কৃতি শিক্ষা চালু করেন মাহবুব হোসেন।
ড. মাহবুব মনে করতেন, জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যে একটি ইতিবাচক দিক আছে, এতে আমাদের শস্য চাষব্যবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে এবং তিন ফসলের দিকে যাচ্ছে। তবে চাষের জমি কমে যাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন তিনি এবং চাষিদের প্রযুক্তি ব্যবহারে আরও সচেতন থাকার কথা বলতেন। তিনি মাঠে-ঘাটে কৃষকের সঙ্গে কথা বলতেন এবং যারা কাজ করতে চায়, তাদের উৎসাহ দিতেন। অনেক ছাত্রকে তিনি বৃত্তি দিয়েছেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ ছিল ‘এখন নারীপ্রধান পরিবার বাড়ছে এবং উচ্চশিক্ষিত মেয়ের সঙ্গে স্বল্পশিক্ষিত ছেলেদের বিয়ে হচ্ছে, এটাও একটি ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে।’ উল্লেখ্য, তিনি ইরিতে থাকাকালীন নারী নিয়োগ সূচক করেছিলেন, যা পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী গৃহীত হয়েছে সামান্য সংশোধনীসহ।
শিক্ষা অন্তঃপ্রাণ ড. মাহবুব প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের একজন এবং আশির দশকে এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর আত্মজা বা ছোট মেয়ে শারমিন হোসেন তপতী বাবার স্মৃতিধন্য কাপাসডাঙ্গা নিয়ে বেশ উৎসাহী এবং সেখানকার সাধারণ মানুষকে নিয়ে কিছু করতে চান বলে আলাপ প্রসঙ্গে জানান।
কোনো সৃষ্টিই হারায় না। কালের প্রেরণায় ও পটে আরও উজ্জ্বল ও শাণিত হয়। কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে এই ভূমিপুত্রের অদম্য আগ্রহ ও সাধনা নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে এবং বাংলাদেশের কৃষিকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নেবে। তাঁর প্রতি রইল শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আসাদুজ্জামান: সাংবাদিক ও লেখক।
[email protected]