নগরের দেশে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ

বাংলাদেশের নগরায়ণ বিষয়ে লেখালেখি ও গবেষণা দীর্ঘকাল সময় ধরেই চলছে। গবেষণা ও গবেষক এবং লেখকের সংখ্যাও কম নয়। আমিও তাঁদের একজন। ঢাকার ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গ্রন্থ রচনা, যৌথভাবে ঢাকার ওপর সেমিনার, সম্মেলন এবং সর্বশেষ ঢাকার ৪০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ১৯ খণ্ড ঢাকাবিষয়ক গ্রন্থের সম্পাদনা আমার কাজের সাক্ষী। এসব কাজের উদ্দেশ্য শুধু ইতিহাসচর্চাই নয়—এর ভিত্তিতে ঢাকা মহানগরের বিদ্যমান অবস্থার পরিবর্তন আনাও ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। কেননা, ঢাকা যতই বিস্তৃতি লাভ করছে, ততই সমস্যাও বাড়ছে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯০ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির উদ্যোগে ঢাকা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ (ঢাকা পাস্ট প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচার বা DPPF শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন এবং পরবর্তী সময়ে এর ভিত্তিতে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এতে দুটি বিষয় বিশেষভাবে আলোচিত হয়—এক, ঢাকা শহরে বহুতলবিশিষ্ট বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট তৈরির সমস্যা ও সমাধান এবং দুই, ঢাকার বস্তির সংখ্যা বৃদ্ধি এবং তা থেকে উদ্ভূত সমস্যা।
তবে মনে হয় না তখন ঢাকা নগরের দেখভালের দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা গ্রন্থটি পড়েছেন বা গ্রন্থটিতে ঢাকা শহরের উন্নয়নের ও বিকাশের যে সুপারিশ ছিল, তা কাজে লাগিয়েছিলেন। ফলে ঢাকার অব্যবস্থা বাড়তে বাড়তে আজকের অবস্থায় এসেছে, যখন এর খেতাব মিলেছে বিশ্বের সবচেয়ে আবাসযোগ্য নগর।
গবেষকদের মতে, দেশ এখন দ্রুত নগরায়ণের দিকে এগোচ্ছে। গ্রামীণ অবস্থান থেকে নাগরিক জীবনে উত্তরণের পেছনে বহু উপাদান কাজ করছে। আগামী তিন দশকের মধ্যে বাংলাদেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ নগরে বাস করবে। বর্তমানে জনসংখ্যার ২৮.৪ দশমিক নগরবাসী। প্রতিবছর ২.৯৬ দশমিক হারে বৃদ্ধি পেলে অচিরেই বাংলাদেশ নাগরিক সভ্যতার দেশে পরিণত হবে। তখন কেমন হবে বাংলাদেশের চেহারা?
যদি রাজধানী ঢাকার ভবিষ্যৎ ছবি আঁকি, তাহলে ভয়ে আঁতকে ওঠা ছাড়া উপায় নেই। ঢাকার বাইরের ছবি কী? সাম্প্রতিক সময়ে মফস্বল অঞ্চলের তিনটি শহর দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। এর মধ্যে দিনাজপুর শহর, যা ব্রিটিশ আমলে একটি প্রশাসনিক শহর হিসেবে গড়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে এর নাগরিক বৈশিষ্ট্য বৃদ্ধি পায়। ১৮৬৯ সালে এটিকে মিউনিসিপ্যালিটি করা হয় এবং এটি হয়ে ওঠে বাংলাদেশের মফস্বল অঞ্চলের একটি পরিচ্ছন্ন শহর, যেখানে সরকারি কর্মকাণ্ড ছাড়াও শিক্ষা, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের ফলে অর্থনৈতিকভাবেও শক্তিশালী হয়ে ওঠে, যা কিনা নগরায়ণের আসল রূপ। ১৯৯৫ সালে আমরা দিনাজপুরের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে দিনাজপুর শহরে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করি। তখন দিনাজপুর ছিল উঠতি নগর ও অপার সম্ভাবনার শহর।
কিন্তু ২০ বছর পর ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে গিয়ে দেখলাম শহরের ওপর দানবের তাণ্ডবলীলা চলছে। প্রথমেই নজর পড়ে শহরের জনসংখ্যা ও বিস্মৃতি: ২০১১তে জনসংখ্যা ছিল ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭২৭, যা বর্তমানে দুই লাখে উপনীত হয়েছে। শহরটি ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে, এমনকি এর অভ্যন্তর ভাগে, যেখানে আগে খোলা প্রান্তর ছিল, খাল ছিল, নদী ছিল তা ভরাট করে বসতি গড়ে উঠেছে। বর্তমানে পৌরসভাটি ২৪ দশমিক ৫০ বর্গকিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত। শহরের দোকানপাট, অটোরিকশা, রাস্তার পাশ ধরে বাজার, দোকান, হোটেল, রেস্তোরাঁ, স্কুল–কলেজ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। এসবই হয়েছে বা হচ্ছে কোনো চিন্তাভাবনা বা পরিকল্পনা ছাড়াই। দিনাজপুর পুরোনো পৌরসভা, যা স্থানীয় সরকার হিসেবে এর এখন গুরুত্ব আরও বেশি। অথচ পৌর কর্তৃপক্ষের এ ব্যাপারে কোনো দায়িত্ব বা কর্তব্য আছে বলে মনে হয় না। শহরে যে অসংখ্য অটোরিকশা এখন চলছে, সেগুলোর নিবন্ধনও করা হয়নি। দিনাজপুর এখন যানজটের শহর; পূতিগন্ধময় নোংরা শহর। এই হচ্ছে একদা অতি সুন্দর পরিচ্ছন্ন শহরের বর্তমান হাল। নগর জীবন যে সভ্যতা, রুচি ও নান্দনিক বিষয়—তা কারও ধারণায় নেই।
উঠতি নগর জীবনের আরেকটি দৃষ্টান্ত পীরগঞ্জ শহর বা পৌরসভা। ঠাকুরগাঁও জেলার অন্তর্ভুক্ত পীরগঞ্জ থানা একসময় রেলস্টেশন হিসেবে খ্যাত ছিল। এই রেলস্টেশনকে ঘিরে একটি বাজার গড়ে ওঠে আর এই বাজারই এখন শহর তথা পৌরসভা। এলাকাজুড়ে যত্রতত্র বাড়িঘর, দোকান গড়ে উঠছে। ফলে কৃষিজমি ধ্বংস হচ্ছে। অথচ এই বেড়ে ওঠা জনপদের কোনো বিশেষ অর্থনৈতিক ক্ষমতা বাড়াচ্ছে না। শহরটি বেড়ে উঠছে রাস্তার ধারে, তার পেছন আছে বাড়িঘর, দোকান, ছোট কারখানা ইত্যাদি। শহর বেড়ে উঠছে অথচ সড়ক, সেবামূলক কোনো ব্যবস্থা বা স্কুল, কলেজ, ডাক্তারখানা, হোটেল, রেস্তোরাঁর স্থান পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে না। ছোট্ট এলাকায় অপরিচ্ছন্ন ও অপরিকল্পিত জনপদ গড়ে উঠছে। অথচ আধুনিকতার নামে এখানে দোকানপাট, হোটেল, রেস্তোরাঁর আপাত চাকচিক্য নজরে পড়ে। এখানে পৌর মেয়র বা কর্মকর্তাদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না।
একবিংশ শতাব্দীর নগরায়ণের প্রতীক হতে পারে ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলা বা পৌরসভা শহর। অতীতে এটি ছিল ছোট্ট একটি বসতি, কয়েকটি বড় রাস্তার সংযোগ স্থান। অবশ্য স্থানটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। এর কাছেই কুলিক নদীর পাড়ে ছিল বিখ্যাত জমিদার রাজা টঙ্ক নাথের বাসভূমি ও জমিদারির পীঠস্থান। ধ্বংসপ্রাপ্ত অবহেলিত রাজবাড়ী এখনো সবার দৃষ্টি কাড়ে। কিন্তু শহরটি শ্রীহীন। এখানে গড়ে উঠেছে সারি সারি দোকানপাট, রেস্তোরাঁ, স্কুল, কোচিং সেন্টার, বিউটি পারলার, সিনেমা হল, ডাক্তারখানা ইত্যাদি। কোথাও পরিকল্পনা নেই। সাইকেল, মোটরসাইকেল, রিকশা, গাড়ি, ঠেলাগাড়ি ইত্যাদির ভিড়ে প্রধান রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করা কষ্টকর ও বিপজ্জনক, এর ওপরই বাস, মাইক্রোবাস, ট্রাক্টর ইত্যাদির আনাগোনা। পুরো পৌরসভা এলাকায় চলছে স্থাপনা নির্মাণ। বড় পণ্য বিক্রেতাদের শোরুম তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে রয়েছে কবরস্থান, মসজিদ, মন্দির। এই লোকালয়ের না আছে সৌন্দর্য, না আছে বাসিন্দাদের স্বস্তি-শান্তি।
আমার জানামতে, অতীতে বিভিন্ন পৌরসভার ভবিষ্যৎ বিস্তৃতি এবং সুযোগ-সুবিধা প্রদানের জন্য বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় কিছু শহর-পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সেই পরিকল্পনার কী হলো? সারা বাংলাদেশে তথাকথিত নগরায়ণের বিস্তৃতি ঘটছে। হাজার হাজার মানুষ ছুটছে এই শহরগুলোর দিকে নানা প্রয়োজনে। এই নগরায়ণের বহু ইতিবাচক দিক আছে। প্রশ্ন হলো এই নগরায়ণের বিষয়টিকে আমরা কীভাবে পরিচালনা করছি? বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হয়, এগুলো লাগামহীনভাবে চলছে। এ রকম চলতে থাকলে ভয়াবহ অবস্থা হতে পারে।
এই সন্ধিক্ষণে আমাদের পৌরসভাগুলোর নির্বাচন হয়ে গেল। পৌরসভার মেয়র, কাউন্সিলররা তাঁদের নিজ নিজ স্থানের উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েই দায়িত্ব নিয়েছে। হয়তো অনেকেই তাঁরা যে বাংলাদেশের জীবনের এক মৌলিক পরিবর্তনের অর্থাৎ নগরায়ণ প্রক্রিয়ার অভিভাবক হয়ে উঠেছেন, সে সম্পর্কে সজাগ বা সচেতন নন। কিন্তু তাঁদের সক্রিয়তা ও অব্যাহত প্রয়াস নগরায়ণকে নাগরিক বান্ধব করতে পারে।
শরীফ উদ্দিন আহমেদ: চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক, ইতিহাস ও দর্শন বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।