দুর্নীতির ধারণাসূচকে বাংলাদেশ: অগ্রগতি হবে কি?

.
.

২৭ জানুয়ারি ২০১৬ প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণাসূচক ২০১৫ সালের ০-১০০ স্কেলে বাংলাদেশের স্কোর ২০১৪-এর মতো ২৫ পেয়ে অপরিবর্তিত রয়েছে। ১৬৮টি দেশের মধ্যে উচ্চক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশ ১৩৯তম, যা ২০১৪-এর তুলনায় ছয় ধাপ ওপরে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ১৭৫টি দেশের মধ্যে ১৪৫তম অবস্থান পেয়েছিল। ছয় ধাপ অগ্রগতি কিছুটা সন্তোষজনক মনে হতে পারে, যদিও বাস্তবে তা হয়েছে এ জন্য যে, যে সাতটি দেশ এবার জরিপের আওতাভুক্ত হয়নি, তারা সব সময় বাংলাদেশের তুলনায় বেশি স্কোর পেয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের মধ্যে এবারও আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বনিম্ন অবস্থান বাংলাদেশের। ভুটান, শ্রীলঙ্কা, ভারত, নেপাল ও পাকিস্তান বাংলাদেশের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে। নিম্নক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশ এবার ২০১৪ সালের ১৪তম অবস্থানের এক ধাপ নিচে ১৩তম, যা ২০১৩ সালের তুলনায় তিন ধাপ নিচে ও দুই পয়েন্ট কম। অর্থাৎ সার্বিক বিবেচনায় এবারও আমাদের অগ্রগতি হলো না।
দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ভুটান, ৬৫ স্কোর পেয়ে উচ্চক্রম অনুযায়ী ২৭তম; এরপর ভারত, ৩৮ স্কোর পেয়ে ৭৬তম; শ্রীলঙ্কা ৩৭ পেয়ে ৮৩তম, পাকিস্তান ৩০ পেয়ে ১১৭তম, নেপাল ২৭ পেয়ে ১৩০তম এবং আফগানিস্তান ১১ পেয়ে ১৬৬তম। বৈশ্বিক তালিকায় সর্বনিম্ন স্কোর ও অবস্থান পেয়েছে উত্তর কোরিয়া ও সোমালিয়া, ৮ পয়েন্ট। ভুটান ছাড়া দক্ষিণ এশীয় সব দেশেরই স্কোর সূচকের গড় ৪৩-এর নিচে, অর্থাৎ এই অঞ্চলে দুর্নীতির ব্যাপকতা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক।
১৯৯৫ সাল থেকে প্রণীত দুর্নীতির ধারণাসূচক বা সিপিআই সরকারি খাতে, বিশেষ করে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতির ব্যাপকতা সম্পর্কে ধারণার বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দেশের তুলনামূলক চিত্র প্রদান করে থাকে। সূচকে ১২টি আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত জরিপের তথ্যের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে এমন জরিপের তথ্যই ব্যবহৃত হয়, যার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা সম্ভব। টিআইবি বা অন্য কোনো দেশের টিআই চ্যাপ্টারের গবেষণা বা জরিপলব্ধ কোনো তথ্য এ সূচকে বিবেচিত হয় না। অন্যদিকে সূচকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য কোনো দেশ সম্পর্কে কমপক্ষে তিনটি আন্তর্জাতিক জরিপ থাকতে হয়। ফলে প্রায় প্রতিবছরই জরিপে অন্তর্ভুক্ত দেশের সংখ্যার হেরফের হয়। এ কারণে এই অঞ্চলের দেশ মালদ্বীপ গত কয়েক বছরের মতো এবারও সূচকে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। একইভাবে ২০১৪ সালে জরিপকৃত যে সাতটি দেশ ২০১৫ সূচকে অন্তর্ভুক্ত হয়নি, তারা হলো বার্বাডোজ (২০১৪-এ স্কোর ৭৪), বাহামাস (৭১), সেন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড গ্রেনাডা (৬৭), পুয়োর্তো রিকো (৬৩), ডোমিনিকা (৫৮), সামোয়া (৫২) ও সোয়াজিল্যান্ড (৪৩)।
সূচকটি টিআইয়ের বার্লিনভিত্তিক সচিবালয়ের গবেষণা বিভাগ কর্তৃক প্রণীত হয়। জার্মান ইনস্টিটিউট অব ইকোনমিক রিসার্চ সূচকের স্কোর পর্যালোচনা ও তথ্যের যথার্থতা যাচাই করে থাকে। পদ্ধতি ও বিশ্লেষণে উৎকর্ষ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিবছর আন্তর্জাতিকভাবে সুখ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন। এ বছর এ রকম পরামর্শ দিয়েছেন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের সরকার বিভাগ ও গবেষণা পদ্ধতি ইনস্টিটিউট এবং হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল, ডাও জোন্স ও স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর-এর বিশেষজ্ঞরা।
যে সাতটি সূত্র থেকে বাংলাদেশের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, সেগুলো হলো ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের কান্ট্রি রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এক্সিকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে, বার্টলসম্যান ফাউন্ডেশন ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স, গ্লোবাল ইনসাইট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস, পলিটিক্যাল রিস্ক সার্ভিসেস ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রির রিস্ক গাইড, বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি পলিসি অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল অ্যাসেসমেন্ট এবং ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের রুল অব ল ইনডেক্স। তথ্য সংগ্রহের মেয়াদ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ থেকে আগস্ট ২০১৫ পর্যন্ত।
যেসব দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা সবচেয়ে কম বলে নিরূপিত হয়েছে, তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ৯১ স্কোর পেয়ে পরপর দ্বিতীয়বারের মতো ডেনমার্ক ও ৯০ পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে ফিনল্যান্ড। এরপর নিউজিল্যান্ড (৮৯), নেদারল্যান্ডস ও নরওয়ে (৮৭), সুইজারল্যান্ড (৮৬), সিঙ্গাপুর (৮৫), কানাডা (৮৩), জার্মানি, ইউকে ও লুক্সেমবুর্গ (৮১)। এশীয় অঞ্চলে সিঙ্গাপুর ছাড়া তুলনামূলকভাবে উচ্চতর অবস্থানে রয়েছে হংকং ও জাপান (৭৫), কাতার (৭১) ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (৭০)।
কোনো দেশই শতভাগ স্কোর পায়নি। বিশ্বের সর্বোচ্চ উন্নত দেশসমূহের অনেকেই, যেমন অস্ট্রেলিয়া, আইসল্যান্ড, বেলজিয়াম, জাপান, অস্ট্রিয়া, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি ইত্যাদি ৮০ শতাংশের কম পেয়েছে। ১৬৮টি দেশের মধ্যে ১১৪টি, অর্থাৎ ৬৮ শতাংশ দেশ ৫০-এর কম স্কোর পেয়েছে। ১০৩টি দেশ সূচকের গড় স্কোর ৪৩-এর চেয়ে কম পেয়েছে। ৫৪টি দেশের স্কোর অপরিবর্তিত রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের মতো ভুটান ও ভারতের স্কোর অপরিবর্তিত রয়েছে; শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও আফগানিস্তানের স্কোর কমেছে। পাকিস্তানের স্কোর ১ পয়েন্ট বেড়েছে। ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫-এর বৈশ্বিক সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ২০১৪ সালে ৯২টি দেশের স্কোর বেড়েছিল, ২০১৫ সালে সেখানে ৬৫টি। অন্যদিকে ২০১৪ সালে ৩৬টির তুলনায় ২০১৫ সালে ৪৯টি দেশের স্কোরে অবনতি হয়েছে। উন্নয়নশীল অনেক দেশের পাশাপাশি যেসব উন্নত দেশে অবনতি হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে নিউজিল্যান্ড, যার তিন পয়েন্ট কমেছে। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া, লুক্সেমবুর্গ, এমনকি এবারের শীর্ষ স্থানপ্রাপ্ত ডেনমার্কেরও ১ পয়েন্ট কমেছে। সবচেয়ে বেশি কমেছে ব্রাজিল ও লেসোথো, উভয়েই গতবারের তুলনায় ৫ পয়েন্ট কম পেয়েছে। সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছে কুয়েত ও রুয়ান্ডা (৫) এবং চেক রিপাবলিক, অস্ট্রিয়া, নামিবিয়া, জর্ডান ও নেদারল্যান্ডস (৪)।
সার্বিক বিবেচনায় এটি পরিষ্কার যে দুর্নীতি একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যদিও আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে দুর্নীতির চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি উদ্বেগের কারণ। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত পরপর পাঁচবার বাংলাদেশ সর্বনিম্ন স্থানে ছিল। সোমালিয়া এ বছরসহ পরপর নয়বার শীর্ষে অবস্থান পাওয়ার ফলে আমাদের সেই গ্লানির কিছুটা লাঘব হতে পারে। পরে বাংলাদেশ ২০০৬ সালে তৃতীয়, ২০০৭ সালে সপ্তম, ২০০৮ সালে দশম, ২০০৯ সালে ত্রয়োদশ, ২০১০ সালে দ্বাদশ, ২০১১ ও ২০১২ সালে ত্রয়োদশ, ২০১৩ সালে ১৬তম এবং ২০১৪ সালে ১৪তম স্থান পাওয়ায় কিছুটা সার্বিক অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়। এবার একদিকে স্কোর অপরিবর্তিত থেকে উচ্চক্রমে ছয় ধাপ ওপরে এবং অন্যদিকে নিম্নক্রমে এক ধাপ অবনতি হওয়ায় ঊর্ধ্বগতি ধরে রাখা সম্ভব হলো না।
যেসব কারণে অগ্রগতি হচ্ছে না, তার মধ্যে রয়েছে, সরকার ও সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কিছু কিছু দুর্নীতিবিরোধী উদ্যোগ সত্ত্বেও প্রয়োগ ও চর্চার ঘাটতির ফলে প্রকটতর হয়েছে কার্যকরভাবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের দৃষ্টান্তের সংকট। দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমনের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান দুদকের কার্যকরতা ও স্বাধীনতা খর্ব করার অপপ্রয়াস যেমন অব্যাহত রয়েছে, তেমনি দুদকের নিজস্ব সক্রিয়তা, দৃঢ়তা ও নিরপেক্ষতার ঘাটতি রয়েছে চলমান। সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, শেয়ারবাজার ও ডেসটিনির মতো ‘রুই-কাতলা’ শ্রেণির দুর্নীতির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও সরকারি প্রভাবমুক্ত হয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা যাবে, এমন ধারণা সৃষ্টি হয়নি।
দুর্নীতির অভিযোগের অস্বীকৃতির মানসিকতার প্রসার ঘটেছে। ক্ষমতাবানদের একাংশের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগসাজশে ভূমি-বনাঞ্চল-নদী-জলাশয় দখলসহ আইনের শাসন পরিপন্থী কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বেই রয়ে গেছে। জনপ্রতিনিধিদের একাংশের বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন সম্পদের পরিসংখ্যান প্রকাশের ক্ষেত্রে দুদক বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে—এমনটি বিশ্বাস করা কঠিন। সরকারের দায়িত্বশীল অবস্থান থেকে প্রকাশ্যেই বলা হয়েছে, ক্ষমতায় থাকলে সম্পদ বাড়বেই, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই; ঘুষ লেনদেনকে দুর্নীতি বলা যাবে না ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার জন্য বিদেশি সহযোদ্ধাদের সম্মান প্রদর্শনে উপহার হিসেবে প্রদত্ত স্বর্ণের ক্রেস্ট জালিয়াতির ঘটনায় পদক্ষেপ গ্রহণ স্বার্থের দ্বন্দ্বের হাতে জিম্মি হয়েছে। অবৈধ অর্থের পাচারের বৈশ্বিক তালিকায় বাংলাদেশিরা প্রাধান্য পেয়েছে। কালোটাকা অর্জনকে পুরস্কৃত করা অব্যাহত রয়েছে। সরকারের নীতি–কাঠামো দুর্নীতি সহায়ক, দুর্নীতিতে লাভবান ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয়দানকারী মহলের করাভূত হওয়ার ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছে।
তবু আশাবাদী হতে চাই। দুর্নীতিবিরোধী আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো সৃষ্টিতে যে অগ্রগতি ইতিমধ্যে হয়েছে, তার চর্চা ও প্রয়োগের ঘাটতি পূরণে সরকারসহ সব অংশীজনকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দুর্নীতি যে বাস্তবেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ, সব প্রকার ভয় বা করুণার ঊর্ধ্বে গিয়ে তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। এ জন্য চাই কার্যকর দুদকের পাশাপাশি অন্যান্য জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থায় পেশাদারি ও দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের পরিবেশ। সর্বোপরি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণ, গণমাধ্যম ও বেসরকারি সংগঠনের সোচ্চার ভূমিকা অপরিহার্য, যার পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। জনগণ যত বেশি সোচ্চার ও তাদের চাহিদা যত বেশি সরকার তথা ক্ষমতাবানদের প্রভাবিত করতে পারবে, তত বেশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি প্রতিরোধে অগ্রগতি হবে; দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের উন্নতিও হবে ততটুকুই।
ইফতেখারুজ্জামান: নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।