আজন্ম পাপ এবং 'হলদে গোলাপ'

মানবাধিকার বাংলাদেশ ২০১৪ বইটি আইন ও সালিশ কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত হয়েছে ২০১৫ সালে। বইটিতে ‘যৌনগত সংখ্যালঘুর অধিকার’ শিরোনামের একটি লেখায় আমরিন খান লিখেছেন, ‘...ফারসি ভাষায় হিজড়া শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো “সম্মানিত ব্যক্তি”। আক্ষরিক অর্থে সম্মানিত ব্যক্তি হলেও তাদের ভিন্ন শরীরী উপস্থাপনার কারণে বৃহত্তর জনজীবন থেকে তারা ছিল অদৃশ্য ও অস্পৃশ্য। তাদের এই অদৃশ্য-অস্পৃশ্য হওয়ার ইতিহাস শুরু ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলে, যখন “ক্রিমিনাল ট্রাইব” হিসেবে আখ্যা দিয়ে ফৌজদারি আইনের আওতায় এনে তাদের চলাফেরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারিতে আনা হয়। এর অব্যবহিত পূর্বে মোগল রাজা-বাদশাহদের খাসমহল ও শাসনকার্য উভয় ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ছিল তাদের। রামায়ণ-মহাভারতের মতো ঐতিহাসিক পৌরাণিক কাহিনিতে তাদের উল্লেখ আছে।...হিজড়া ও সমপ্রেমীদের মধ্যে পার্থক্য হলো, প্রায় সব হিজড়া মানসিকভাবে নিজেদের মেয়ে মনে করে। তাদের নিয়ে গবেষক Serana Nanda’র বিখ্যাত উক্তি “Female soul entrapped in a mail body” (নারীর আত্মা পুরুষের শরীরের খাঁচায় বন্দী)।’
গবেষকেরা যতই গবেষণা করুন না কেন, কিংবা বিজ্ঞানমনস্ক মস্তিষ্কের বোধে তাদের জন্য মানবিক অনুভূতি সমাজের যতটুকু অংশেই থাকুক না কেন, এখানে-ওখানে হিজড়া সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষগুলো নিন্দিতই হয় কমবেশি। জন্মের পরপরই একটি হিজড়া শিশু নির্মম সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবীর কোলে ঠাঁই পায়। এ যেন তার আজন্ম পাপ। যদিও চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, এক্স-এক্স প্যাটার্ন ক্রোমোজমে মেয়েশিশু আর এক্স-ওয়াই প্যাটার্ন ক্রোমোজমে ছেলেশিশু জন্ম নেয়। নারীরা এক্স–এক্স এবং ছেলেরা এক্স–ওয়াই ক্রোমোজম ধারণ করে। ভ্রূণের পূর্ণতার নানা স্তরে ক্রোমোজম প্যাটার্নের প্রভাবে ছেলেশিশুর মধ্যে অণ্ডকোষ আর কন্যাশিশুর মধ্যে ডিম্বকোষ জন্ম নেয়। অণ্ডকোষ থেকে নিঃসৃত হয় পুরুষ হরমোন এন্ড্রোজেন এবং ডিম্বকোষ থেকে নিঃসৃত হয় এস্ট্রোজেন। কখনো কখনো ভ্রূণের বিকাশের সময়ে নিষিক্তকরণ ও বিভাজনের ফলে বেশ কিছু অস্বাভাবিক প্যাটার্নের সৃষ্টি হয়। যেমন এক্স-এক্স-ওয়াই অথবা এক্স-ওয়াই-ওয়াই এবং এ কারণেই বিভিন্ন গঠনের হিজড়া শিশুকে আমরা জন্ম নিতে দেখি। কোনো হিজড়া শিশু জন্মমাত্রই কিংবা আবিষ্কৃত হওয়ার পর যদি যথাযথ চিকিৎসাসেবা পায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাকে স্বাভাবিক করে তোলা সম্ভব বলে মনে করে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান। পৃথিবীর কোথাও কোথাও এ রকম যে ঘটছে না, তা তো নয়।
অগ্রগণ্য পৃথিবীর প্রতি মুহূর্তের যে ঘূর্ণমান গতি সূর্যকে কেন্দ্র করে, সেখানে থেমে থাকার কোনো অবকাশ নেই। জ্ঞানবিজ্ঞানের নানা শাখায় প্রতিদিন কত শত অনুসন্ধান, নতুন নতুন ভাবনা, আবার পরমুহূর্তেই তা হয়ে উঠছে পুরোনো। পুরোনো এসে চলার পথ আগলে ধরতেই তাকে অতিক্রম করতে চেয়ে আবার নতুন আকাশ দেখার জন্য বন্ধ জানালা খুলে দেওয়া। বিচিত্র ধারায় প্রবাহিত জীবন-জিজ্ঞাসা মানব জাতিকে এনে দিয়েছে সভ্যতা, আমরা হয়ে উঠেছি ক্রমশ অধিকতর সৃজনশীল। পরাজিত হয়েছে পূর্বনির্ধারিত ধারণা কূপমণ্ডূকতা ও অন্ধবিশ্বাস। আমরাই উচ্চারণ করতে শিখেছি, ‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে, আসে নাই কেহ অবনী ’পরে/ সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’। এমন উচ্চারণ ও ভাবনা যখন আমাদের চেতনায় বসত করে, তখন আমরা মনুষ্যত্বকে ছুঁই। আমাদের সচেতন ও স্বতঃস্ফূর্ত নির্মাণে রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার ও ব্যক্তিমানসে সৃজনশীলতার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে ওঠে। শিল্পকলায়, সাহিত্যে, সংগীতে আমাদের সেসব রংধনু বাঙ্ময় হয়েছে বহুবার। আমরা ভাষার জন্য, স্বাধীনতার জন্য, একটি পতাকা ও একটি জাতীয় সংগীতের জন্য, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছি বলেই জাতীয় সংগীতের বাণী ও সুর কিংবা একুশের প্রভাতফেরির রক্তে রাঙানো গুমরে ওঠা কষ্ট আমাদের সজল করে।
আমরা ভাষার লড়াই নিয়ে অতীতের আবেগ অনেক ফেনায়িত করতে ভালোবাসি, কিন্তু ভাবতে পারি না সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে বাধা আসলে কোথা থেকে আসে স্বাধীন দেশে। একই কথা খাটে মুক্তিযুদ্ধের বেলায়ও। আবেগে থই থই মস্তিষ্ক সচেতনভাবে সেই ভাবনার উপাদান দূরে রাখে যে লক্ষ প্রাণ বিসর্জনে যে স্বদেশ ও সমাজ আমরা চেয়েছিলাম, তা কেন চুয়াল্লিশ বছরেও হলো না। এ রকম শত-হাজারটা অসংগতিতে ভরে আছে চারপাশ। কিন্তু আমরা প্রশ্নহীন। সেই অর্থে ভাবনাহীন। আমরা কি তবে স্পর্শকাতরতা হারালাম? না, মোটেই তা নয়। এই যে পথচলতি সময়ে নুলো ভিখিরি, ভ্রাম্যমাণ হকার ও ফেরিঅলা এবং হিজড়া কাছে আসে, উপায়হীন হাত মেলে ধরে সামনে, আমরা তাড়িত হই তো! আনন্দে নয়, ক্ষোভে।
‘উপদ্রব’ শব্দটি ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন হয় না। মশা, তেলাপোকা, ছারপোকা, ফুটপাতের হকার এবং সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য চাঁদাবাজদের উপদ্রবের কথা শোনা যায়। মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীর উপদ্রব থেকে মুক্তির জন্য নানা রকমের ওষুধ পাওয়া যায়। সেগুলো কখনো কার্যকর, কখনো নয়। সমাজে ময়লা আছে, তাই আমাদের মন ময়লা, তাই রাস্তাঘাট ময়লা—এই বোধ যদি আমাদের একমত করে, তাহলে এ–ও তো সত্যি যে দেশে অভাব আছে, দারিদ্র্য আছে, উপায়হীনতা আছে। তাই উপায়সর্বস্বদের সামনে উপায়হীনদের শূন্য, রিক্ত করতল প্রসারিত হয় সাহায্যের আশায়। সারা দেশে বসবাসকারী হিজড়া সম্প্রদায়ও তো উপায়হীন। ভিক্ষুকদের কেউ ঘৃণা করে না। বড়জোর পিতৃসুলভ উপদেশ দেয়। কাজ করে খাও। যদিও উপদেশদাতা কাজের সন্ধানটি দিতে পারেন না। কিন্তু হিজড়া? আমাদের কৌতূহলী অ-জ্ঞান চোখে তারা সম্পূর্ণ মানুষ নয়, তামাশার উপাদান অথবা বিকৃত যৌনাচারের সঙ্গী। দেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম সাম্প্রতিক সময়ে হিজড়া সম্প্রদায় নিয়ে, বিশেষ করে তাদের ‘উপদ্রব’ নিয়ে সরব হয়ে উঠেছে। ফলাফলও হয়েছে ত্বরিত। কদিন ধরে ঢাকা শহরের পথে বা সিগন্যালে তাদের উপস্থিতি অদৃশ্য। রাষ্ট্র বা প্রশাসন চাইলে কী না হয়। এরা অনাচার-অত্যাচার-জবরদস্তির চূড়ান্ত করে ছাড়ত পথচলতি কিংবা গৃহবাসী সুধীজনকে। হাঁফ ছেড়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছি নিশ্চয়ই সবাই।
মনে পড়ে যায়, আরও একবার হাঁফ ছাড়া স্বস্তির নিশ্বাস এনে দিয়েছিলেন একজন হিজড়া। ২০১৫ সালের ৩০ মার্চ রাজধানীর বেগুনবাড়ীতে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে চাপাতি দিয়ে খুন করে যখন ধর্মান্ধ জঙ্গিদের দলটি পালাচ্ছিল, ভীত-হতবিহ্বল অথবা দায়হীন পথিকেরা দাঁড়িয়ে পড়ছিল ক্রিয়াহীন, তখন হত্যাকারী দুই তরুণকে প্রায় একাই ধরে ফেলেছিলেন লাবণ্য নামের এক হিজড়া। ‘সাবাস সাবাস’ রব উঠেছিল সেদিন। আমরা ফিসফিস বলাবলি করেছিলাম, একজন হিজড়া ওদের দুজনকে ধরে ফেলল। অন্য অনেকের চেয়ে বেশি সাহসী হয়েও লাবণ্য সেদিনও আমাদের অভিজাত চোখে হিজড়ার বাইরে ঠিক মানুষ হয়ে উঠতে পারেননি। আমাদের বিস্ময় সেদিন প্রধানত এ কারণে তৈরি হয়নি যে একজন মানুষ কীভাবে ছুটন্ত দুজন মানুষকে ধরে ফেললেন। আমরা বিস্মিত হয়েছিলাম এই অনুভূতি নিয়ে, একজন হিজড়া দুজন জঙ্গিকে ধরে ফেলেছে। যদিও পরবর্তী সময়ে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না পেয়ে লাবণ্য ওই এলাকা ছেড়ে চলে যান। আমরা কেউ তাঁর খবর রাখিনি।
মানবাধিকার বাংলাদেশ ২০১৪ বইটির তথ্যে জানা যাচ্ছে, ২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দান করা হয়। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ২০১৫ সালের ২৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বলেছেন, ‘হিজড়ারা এই সমাজেরই অংশ। এ দেশের নাগরিক হিসেবে তাদের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।’ ভারতেও ঘটেছে একই ঘটনা। তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার রক্ষার্থে ২০১৫ সালের ২৪ এপ্রিল অনুমোদিত হয় রাজ্যসভা বিল। কিন্তু তারও আগে থেকে ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে এর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলটি চোখে পড়ে। তৃতীয় লিঙ্গের মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের কৃষ্ণনগর সরকারি মহিলা কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেবেন—এই সিদ্ধান্ত দিয়েছে ‘কলেজ সার্ভিস কমিশন’। ঘোষণার সময়টিতে মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় বিবেকানন্দ শতবার্ষিকী মহাবিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছিলেন। (সূত্র: আমরিন খান)
দুই বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার স্বীকৃতি হিসেবে আনন্দ পুরস্কারের সুখ্যাতি আছে। ১৪২১ বঙ্গাব্দের আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন স্বপ্নময় চক্রবর্তী তাঁর হলদে গোলাপ উপন্যাসের জন্য। তথ্যটি প্রথম জেনেছি নাট্যজন ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদের কাছ থেকে। উপন্যাসের ক্যানভাসে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের যাপিত জীবনের টানাপোড়েন এঁকেছেন ঔপন্যাসিক। পুরস্কার প্রদানের সময় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘লেখকের কাজ জীবনের আনাচে-কানাচে অতি তুচ্ছ বর্জ্যগুলো জোগাড় করে, তার মধ্য দিয়ে সত্য আবিষ্কার।’ আর লেখককে দেওয়া মানপত্রে বলা হয়েছে, ‘প্রসঙ্গটি বাংলা কথাসাহিত্যে হয় নৈঃশব্দ দ্বারা অথবা উনকথনে আবৃত ছিল।’
আমাদের এখানে ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার উত্তরায় টাকা তোলা নিয়ে দ্বন্দ্বের জের হিসেবে একদল তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ আরেক দলের একজনকে গুলি করেছে। জানি, এ নিয়ে এখনই কোনো সাহিত্য উপাদান আমাদের ভোগী চোখে ধরা পড়বে না। কিন্তু কয়েকটা প্রশ্ন কি নিজেকে করব আমরা? কেন এরা পথে নামে, জবরদস্তি করে, মুখে রং মাখে, আবার মোটরসাইকেল পায়, গুলিও করে? আমাদের তো লিঙ্গগর্ব আছে। পুরুষ লিঙ্গ। নারী লিঙ্গ। কী হচ্ছে তাতে?
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
[email protected]