শুধু বিএনপির নয়, বিদ্রোহী প্রার্থীরাও ভয় পেয়েছেন!

.
.

পৌরসভা নির্বাচনের পরদিন লিখেছিলাম, আমাদের সমাজে একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক রূপান্তর ঘটতে যাচ্ছে কি না? এই প্রশ্ন এখন আরও জোরালো হলো ৭১টি ইউনিয়ন পরিষদে বিএনপির প্রার্থী দিতে না পারা এবং ২৫টিতে আওয়ামী লীগ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার পথে থাকার ঘটনায়। মনে হচ্ছে, আরও বহু জায়গায় প্রকৃত নির্বাচন হবে না। গোপন সমঝোতা, চাপ ও ‘স্বপ্রণোদিতভাবে’ নির্বাচনে থেকেও কৌশলগতভাবে সরে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটবে। তিন স্তরে নির্বাচন হবে। কিন্তু নির্বাচনী আত্মা থাকবে না।
এমনিতে আমরা সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন ও সামাজিক ফোরামগুলোতে বিভক্তি দেখতে পাই। এমন একটি উদাহরণও আমাদের সামনে নেই, যেখানে আগে দুই বড় দলের সমর্থক গ্রুপ ছিল, সেখানে আর কোনো দলাদলি নেই। সাদা কি নীলের ভাগাভাগি আর নেই। সাদা ও নীল মিলে এখন একটি রং ধারণ করেছে। এটা কোথাও শুনি না। বরং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির মতো বিভক্ত সংগঠনগুলোর বিভক্তি আগের মতোই রয়ে গেছে। যেকোনো বেসরকারি জরিপে এই ইঙ্গিত অত্যন্ত স্পষ্ট যে বিভক্তিটা বজায় আছে। বাংলাদেশ আগের মতোই দুটি প্রধান মতাদর্শগত জায়গায় ভাগ হয়ে আছে। তার থেকেও বড় কথা হলো, এখন পর্যন্ত যেকোনো অনানুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনায় যখন প্রশ্ন ওঠে যে এখনই যদি নির্দলীয় সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন হয়, তাহলে তার সম্ভাব্য ফল কী হবে। এর যে উত্তর তা নিয়ে নানাজন নানা মত দেবেন। কিন্তু অনুমান করি কেউ হয়তো এমন চিত্র তুলে ধরবেন না, যা কিনা আমরা গত পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফলে ফুটে উঠতে দেখেছি। আমরা দেখলাম বিএনপি শুধু ভেসেই যায়নি, তারা ক্ষমতাসীন দলের বিজয়ী প্রার্থীর চেয়ে এতটা কম ভোট পেয়েছে, যা অভাবনীয়। কোনো একটি শহরে যদি কারা বিএনপির সমর্থক আছেন, তাঁদের প্রকাশ্যে হাত তুলতে বলা হয়, তাহলেও বিএনপির পরাজিত মেয়র প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে সেই সংখ্যাটা বেশি হওয়ার কথা। এখন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ফলাফলের আগেই সম্ভাব্য ফল কী হতে যাচ্ছে, সেটা আর কষ্টসাধ্য অনুমান নয়।
আমাদের দেশের মানুষ কি সত্যিই ভোটের হাতিয়ার ব্যবহার করে রাজনীতিকদের শাস্তি দিতে শিখে গেছে? বাগেরহাটের ৭৪টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে ১৯টিতেই বিএনপির প্রার্থী নেই। এই জেলার আওয়ামী লীগের সভাপতির বরাতে ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় এর একটি ব্যাখ্যা ছাপা হয়েছে। তাতে তিনি বলেছেন, ‘এই জেলায় বিএনপির সাংগঠনিক ভিত্তি খুবই দুর্বল। এসব ইউপিতে তাঁরা প্রার্থী দেওয়ার মতো লোক খুঁজে পাননি। এ জন্যই আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা এসব জায়গায় জেতার পথে।’ প্রথম কথা হলো, ইউনিয়ন পর্যায়ে সাধারণভাবে কোনো বড় দলেরই তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য সাংগঠনিক তৎপরতা কখনো ছিল না। আর গ্রামীণ ব্যবস্থার নির্বাচনে সব থেকে কম প্রভাব বিস্তার করে রাজনৈতিক মতাদর্শ। এখানে গোষ্ঠী, পাড়া, গ্রাম, কোন্দল ইত্যাদি যেকোনো নির্বাচনে অনুঘটকের কাজ করে। সুতরাং প্রার্থী পাওয়া না-পাওয়ার সঙ্গে তথাকথিত সাংগঠনিক শক্তির সম্পর্ক আলগা হতে বাধ্য।
উপরন্তু, আমরা মনে রাখব যে দুই বড় দলই তৃণমূলে সংঠনগতভাবে ইতিহাসের যেকোনো পর্যায়ের তুলনায় দুর্বল এবং কম গণতান্ত্রিক। এর বড় প্রমাণ হলো বিপুলসংখ্যক সাংগঠনিক জেলায় তারা বছরের পর বছর ধরে পকেট কমিটি করে রেখেছে। আগের চেয়ে অবস্থার আরও অবনতি ঘটার আরও প্রমাণ হলো, তারা আগে কাউন্সিল করে পূর্ণাঙ্গ পকেট কমিটি ঘোষণা দিতে পারত। এখন তারা তা পারে না। কেবল সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের, আবার কোথাও আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে চালায়। সব থেকে উদ্বেগজনক হলো তারা এসব কমিটি গঠনে ব্যালট বা অধিকতর প্রতিনিধিত্বশীল কোনো ব্যবস্থায় যাওয়ার প্রবণতা দেখাচ্ছে না। এই ব্যর্থতার জন্য আমরা নির্বাচন কমিশনের একগুঁয়েমিকে বহুলাংশে দায়ী করতে পারি। এটা যে একটা বৃহত্তর প্রক্রিয়া এবং সেটা যে দলের হিসাব নিরীক্ষা ও তার কমিটি ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও গতিশীলতার প্রশ্ন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, তা তারা বুঝতে চাইছে না।
আমরা লক্ষ করব নির্বাচন কমিশন বিএনপি নামের সংগঠনটির রাজনৈতিক শুদ্ধতার প্রশ্ন তুলছে না। অথচ তাদের সেটা করা উচিত। এই রকমের একটি অগণতান্ত্রিক ও ভাঙাচোরা দল দিয়ে তারা কী করে মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে। আমরা এমন কোনো দলীয় গঠনতন্ত্র কল্পনা করতে পারি না, যেটি আমাদের সংবিধানে স্বীকৃত ‘পিপলস রিপাবলিক’–এর মূল চেতনাকে আঘাত করে। বিএনপিকে তারা যে এসব বিষয়ে কিছু বলছে না, সেটা বিএনপির প্রতি তাদের কোনো সুচিন্তিত অনুকম্পা নয়, এখানে তারা স্থিতাবস্থা বজায় রাখছে কারণ তারা অত্যন্ত সংবেদনশীল, যাতে তাদের কোনো ‘অপরিণামদর্শী’ পদক্ষেপের ফলে প্যান্ডোরার বাক্সটা উন্মুক্ত না হয়ে পড়ে। বিএনপিকে উন্মুক্ত করলে অন্যান্য দলও উন্মোচিত হবে।
সুতরাং আমরা দেখি দেশব্যাপী ইউপি নির্বাচন নিয়ে এত বড় একটা বিশাল রাজনৈতিক যজ্ঞ ঘটে গেল, চার হাজারের বেশি ব্যক্তি প্রথমবারের মতো ‘দলীয়ভাবে’ মনোনীত হলেন, কিন্তু তা নিয়ে কোথাও কোনো উৎসবের আমেজ নেই। সরকারি দলের টিকিটধারীরা বলছেন, একেই আমরা বিজয় হিসেবে দেখি। কিন্তু তার কোনো উত্তাপ নেই। কর্মী ও সমর্থকদের মনে আনন্দের বন্যা নেই। তার মানে দলীয়ভাবে ইউপি নির্বাচন করে আমরা সমাজে কী নতুন উপাদান যুক্ত করলাম। তৃণমূলে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির নবজাগরণ কোথায়? নাকি দলীয় নির্বাচনের নামে নতুন করে ভয়ের সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটে গেল? এই আশঙ্কা যদি অমূলক না হয়, তাহলে আমরা কি ভাবব না যে শতাব্দী প্রাচীন সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ সমাজে যে অবস্থান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিল, তা ধীরে ধীরে ভেঙে যাবে। সে জন্য এখনই উচিত হবে রাষ্ট্র গঠনের প্রধান শর্ত ক্ষমতার পৃথক্করণ বা সেপারেশন অব পাওয়ারকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত এবং তার প্রয়োগের দিকে নজর দেওয়া। বিচার বিভাগ পৃথক্করণের শর্তেই চেয়ারম্যানকে আর গ্রাম আদালতের প্রধান বিচারক রাখা যাবে না।
পৌরসভা ও ইউপি যেন দলীয় অফিসে পরিণত না হয়। এটা করতে ব্যর্থ হলে গুরুতর সামাজিক বিপর্যয় দেখা দেবে। চেয়ারম্যান ও মেয়ররা আগেও দল করতেন। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পরে তাঁরা যতটা সম্ভব একটা নির্দলীয় চরিত্র বজায় রাখতেন। এটা ভেঙে দিলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে আরও বেশি হিমশিম খাবেন। আমাদের দরকার এমন একটি গ্রামীণ অবকাঠামো, যেখানে আদালতের বাইরে বিরোধ মেটানো যাবে। এখন অস্বচ্ছতার সঙ্গে মনোনয়নপত্রপ্রাপ্ত দলীয় চেয়ারম্যানরা গ্রাম আদালতকে আরও বেশি কলুষিত করতে পারেন। সুতরাং গ্রাম আদালতের পুনর্গঠন দরকার। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদের সুপারিশ অনুযায়ী উপজেলায় বিচার বিভাগকে নিতে হবে।
কৌতূহলবশত গতকাল কথা বলেছি প্রথম আলোর বাগেরহাট সংবাদদাতা আহাদ হায়দারের সঙ্গে। বড় বিস্ময় হলো যে সেখানে ক্ষমতাসীন দলের পূর্ণাঙ্গ পকেট কমিটি তিন বছরেও অনুমোদন পায়নি। সেখানে বিদ্রোহী প্রার্থীর গর্জন নেই। অথচ এর আগে মানুষ বিএনপির নির্বাচিত মেয়র এবং বিদ্রোহীদের পরিণতি দেখেছে। বাগেরহাটের ৭৪টি ইউপির মধ্যে ক্ষমতাসীন চেয়ারম্যানরাই সিংহভাগ পুনরায় প্রার্থী। মাত্র ২১টিতে নতুন মুখ এসেছে। গোপন ব্যালটে বাছাই হলে এর চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় নতুন মুখ দেখা যেত। তবে অনুমান করি, এবার বিএনপির তো বটেই, ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহীরাও নিজ কাণ্ডজ্ঞান গুণে নিজেদের সংযত করে থাকবেন। তদুপরি বিদ্রোহী হয়তো মিলবে, আগামী কয়েক দিনে এই চিত্রটি পরিষ্কার হবে।
বাগেরহাটে একজনও বিদ্রোহী নেই, কেন? সম্ভবত অন্যতম বড় কারণ গত মেয়র নির্বাচনে দলের বিদ্রোহীদের করুণ পরিণতি। সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মেয়র পদে মাত্র ১৪৪ ভোটে হারেন। সেখানে ভালো ভোট হয়েছিল। বিএনপি প্রার্থীর ১ হাজার ১০০ ভোট পাওয়া দেখে অনেকের সন্দেহ বিএনপি-জামায়াতের ভোট তাঁর বাক্সে পড়েছিল। তো ফল ঘোষণার রাতেই বিস্ফোরক মামলায় বিদ্রোহী প্রার্থী গ্রেপ্তার ও তাঁর বাড়িতে হামলা হয়। সেই থেকে তিনি জেলে (সম্প্রতি তাঁর কারণে সদর থানা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সম্পাদকও জেলে গেছেন) আর তাঁর সমর্থক নেতা-কর্মীদের অন্তত ৪০ জন এলাকাছাড়া। পৌর ছাত্রলীগের সভাপতি ও সম্পাদকও তাঁর কারণে বহিষ্কৃত হন, বাড়িতে হামলা চলে। এসব সহিংস হামলার ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। বিদ্রোহী প্রার্থীর পৃষ্ঠপোষক স্থানীয় সাংসদও কোণঠাসা। সুতরাং শুধু বিএনপির নয়, এটা বিশ্বাস করার কারণ থাকবে যে বিদ্রোহী প্রার্থীরাও ভয় পেয়েছেন।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক
[email protected]