বিচারপতিদের আচরণবিধির পুনরুজ্জীবন প্রয়োজন

.
.

বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আইন কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে যে সংবিধানের বিলুপ্ত হওয়া সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল যে আচরণবিধি করেছিল, সেটা ষোড়শ সংশোধনীর কারণে বাতিল হয়ে গেছে। তার মানে দাঁড়ায়, বাংলাদেশ বর্তমানে এমন একটি রাষ্ট্র, যার উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের জন্য অনুসরণীয় কোনো আচরণবিধি প্রায় ১৮ মাস ধরে নেই। জাতীয় বিচার প্রশাসনে এ রকম একটা শূন্যতা বজায় রাখা ক্ষতিকর, আইন ও নীতিনৈতিকতার নিরিখে অসিদ্ধ। সাধারণভাবে আইন কমিশনের কাজ নয় কোনো আইনের খসড়া প্রস্তুত করে দেওয়া। কিন্তু আইন কমিশন বিচারক অপসারণ আইনের খসড়া করে দিলেও এটা বলেনি যে আচরণবিধি কে প্রণয়ন করবে। তবে এটা আমরা আইন কমিশন, সরকার এমনকি সংসদের কাছ থেকে আশা করি না, আশা করি সুপ্রিম কোর্টের কাছে।
আইন কমিশনের প্রতিবেদন পড়ে মনে হতে পারে, ২০০০ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট প্রথম আচরণবিধি তৈরি করেছেন। কিন্তু সেটা ঠিক নয়। ১৯৭৭ সালে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের করা আচরণবিধির অনুসরণে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আচরণবিধি তৈরি করেছিলেন। তখন আক্ষরিক অর্থেই মাত্র একটি বাক্য পরিবর্তন করে ওই আচরণবিধি কপি করা হয়েছিল। এরপর তা ২০০০ সালে সংশোধন করেছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান, যা ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ষোড়শ সংশোধনীতে বাতিল হয়। জনগণের কাছে এটা প্রতীয়মান হওয়া স্বস্তিকর নয় যে সুপ্রিম কোর্ট তাঁর আচরণবিধির জন্য বিচারক অপসারণ আইন প্রণয়ন হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন। বিচারাঙ্গনে আচরণবিধি নিয়ে সংবেদনশীলতা অপেক্ষাকৃত ঢের কম মনে হয়। ১৯৯৪ সালে এক বিতর্কের পরে সুপ্রিম কোর্ট বার আচরণবিধি তৈরির দাবিতে একটি রেজল্যুশন পাস করেছিল। তখন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ১৭ বছর আগে করা আচরণবিধির একটি কপি তাদের কাছে পাঠিয়েছিলেন। এমনকি একটি রেওয়াজও গড়ে উঠেছিল যে নবনিযুক্ত বিচারকদের শপথ গ্রহণের পরে প্রত্যেককে আচরণবিধির কপি সরবরাহ করা। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১০ জন বিচারক সবশেষ হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে এটা বলা দরকার যে বিশ্বজুড়েই উচ্চ আদালতের বিচারকের জন্য আচরণবিধি বিচার বিভাগই করে থাকে। কারণ, এটা বিচার বিভাগের মর্যাদা ও স্পর্শকাতরতা সুরক্ষার জন্য সংগতিপূর্ণ। এই বিষয়টি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, যাতে বাংলাদেশও পক্ষভুক্ত আছে, তার দ্বারা সমর্থিত। ল্যাটিমার হাউস নীতিমালা তেমনই একটি হাতিয়ার, যাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট অবিলম্বে আচরণবিধি তৈরি করতে পারেন। ব্রিটেনের সাবেক উপনিবেশগুলো, যারা স্বাধীনতা লাভ করেছে, তাদের শীর্ষ সংগঠন হলো কমনওয়েলথ, যার পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান নির্বাচিত নির্বাহী চেয়ারম্যান হলেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। লন্ডনের বাকিংহ্যামশায়ার নামক জায়গায় যেখানে বসে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সরকার, সংসদ ও বিচার বিভাগ-বিষয়ক নানা নীতিমালার খসড়া তৈরি হয়, সেটির নাম ল্যাটিমার হাউস। বিচারকদের নিয়োগ, অপসারণ ও আচরণবিধি বিষয়ে এই ল্যাটিমার হাউসে তৈরি করা একটি খসড়া ২০০৩ সালে কমনওয়েলথ সরকারপ্রধানদের সম্মেলনে গৃহীত হয়েছিল। সে কারণে তা ল্যাটিমার হাউস নীতিমালা হিসেবে পরিচিত।
এই নীতিমালা মানতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একটা বাধ্যবাধকতা নিশ্চয় আছে। আর এই ল্যাটিমার হাউস নীতিমালায় উল্লেখ আছে যে ‘বিচারকদের জবাবদিহির স্বার্থে প্রত্যেক বিচার বিভাগকে একটি “কোড অব এথিক্স অ্যান্ড কনডাক্ট” প্রস্তুত ও তা অনুমোদন করতে হবে।’ সেখানে অবশ্য একই প্যারাগ্রাফে সংসদের জন্যও নির্দেশনা আছে। বলা আছে, প্রত্যেক সাংসদ ও মন্ত্রীদের ‘স্বার্থের সংঘাত’ বিষয়ে গাইডলাইন ও আচরণবিধি থাকবে, যার আওতায় তাঁরা সমাজে তাঁদের আর্থিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থের পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করবেন। ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার সদস্যরা আচরণবিধি লঙ্ঘন বা বিচ্যুতির জন্য তটস্থ থাকেন, আর আমরা এখানে ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের ধারক-বাহক দাবি করি, কিন্তু মন্ত্রীদের জন্য কোনো আচরণবিধি তৈরির কথা মুখেও আনি না। অবশ্য যা আছে তাও-বা মানছে কে। যেমন সংসদীয় কার্যপ্রণালিতে বিচার বিভাগ সম্পর্কে কী বলা যাবে কী বলা যাবে না, সেই বিষয়ে পরিষ্কার বাধানিষেধ আছে, কিন্তু উদ্বেগজনকভাবে তার লঙ্ঘন আমরা লক্ষ করে চলেছি।
যাক বিচারকদের আচরণবিধি প্রসঙ্গেই আসি। আর এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশের প্রধান বিচারপতিদের সম্মেলনে ২০০২ সালে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে গৃহীত মডেল আচরণবিধির কথা উল্লেখ করতে হবে। আমি বিনয়ের সঙ্গে এই নিবেদন করতে চাই যে এই নীতিমালাটা কোনো একটা আটপৌরে হালকা রীতিমালা নয়। এটি একটি আন্তর্জাতিক আইনতুল্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘের আওতাধীন সংস্থার দ্বারা প্রণীত আচরণবিধিসহ বিশ্বের যেখানে যত প্রকারের বিচার বিভাগীয় আচরণবিধি ছিল, (আমাদের ১৯৭৭ সালেরটিসহ) তা বহু বছর ধরে পর্যালোচনা করে এই আচরণবিধি প্রস্তুত করা হয়েছে। এ–সংক্রান্ত প্যানেলে বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান ও বিচারপতি মইনুর রেজা চৌধুরী সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। এই নীতিমালাটি বেঙ্গালুরু নীতিমালা হিসেবে পরিচিত।
আদর্শস্থানীয় এই চমৎকার নীতিমালাটির বাস্তবায়ন বিষয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট সব মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। এতে ‘বাস্তবায়ন’-বিষয়ক একটি আলাদা প্যারাগ্রাফ আছে। এতে বলা আছে, এই নীতিমালায় বর্ণিত নীতিসমূহ যদি কোনো দেশের বিচার বিভাগের না থেকে থাকে, তাহলে জাতীয় বিচার বিভাগীয় প্রশাসনকে এর বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিতে হবে। আর বিচার বিভাগের প্রকৃতির কারণে এই কাজটা যে নির্বাহী বিভাগ বা সরকারের নয়, সেটা যে বিচার বিভাগের তা–ও পরিষ্কার উল্লেখ আছে সেখানে। আমরা অনুমান করতে পারি যে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া আচরণবিধিটি কমবেশি উল্লিখিত বেঙ্গালুরু নীতিমালার শর্তাবলি পূরণ করে চলছিল, কিন্তু ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে সেখানে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং এটা সন্দেহাতীত যে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ২০০২ সালের বেঙ্গালুরু নীতিমালা এবং ২০০৩ সালের ল্যাটিমার হাউস নীতিমালার ভিত্তিতে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে একটি আচরণবিধি প্রণয়ন করবেন।
আর এটাও বলি, সুপ্রিম কোর্ট তাঁর নিজের জন্য একটি আচরণবিধি করবেন, এটা তাঁর অন্তর্গত সাংবিধানিক অধিকার, যা তাঁর স্বাধীনতার রক্ষাকবচও। ভারতে সংসদীয় অপসারণব্যবস্থা সব সময় থাকলেও তাদের সুপ্রিম কোর্ট কিন্তু ১৯৯৯ সালে ‘রিস্টেটমেন্ট অব ভ্যালুজ অব জুডিশিয়াল লাইফ’ শিরোনামে আচরণবিধি করেছেন। ২০১২ সালের ১০ ডিসেম্বরে মাদ্রাজ হাইকোর্টের বিচারপতি রমাসুব্রামনিয়াম তাঁর একটি রায়ে বলেছেন, ১৯৯৯ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট আচরণবিধি করতে গিয়ে বাংলাদেশের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের করা আচরণবিধিটি বিবেচনায় নিয়েছিলেন। সুতরাং সরল অবস্থাটা দাঁড়াচ্ছে, আমাদের বিধি দেখে ভারত করল আর আমাদেরটা ‘সংসদের সিদ্ধান্তে’ বাতিল হলো।
এটা কৌতূহলোদ্দীপক যে এক জেলা জজকে মাদ্রাজ হাইকোর্টের বিচারক করার পর একজন আইনজীবী তার বৈধতা প্রশ্নে রিট (কো-ওয়ারেন্টো) করেন। আর সেখানে ওই আইনজীবী ‘বেঙ্গালুরু আচরণবিধি’ লঙ্ঘনের দায়ে ওই বিচারপতির অপসারণ চেয়েছিলেন। অভিযোগ হলো, ওই বিচারক জেলা জজ থাকতে ছেলের বিয়েতে মুখ্যমন্ত্রী এবং বর-বধূর সঙ্গে সস্ত্রীক নিজের ছবি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন হিসেবে ছাপিয়েছিলেন। আর সেটা বেঙ্গালুরু আচরণবিধিকে আহত করেছে। টেকনিক্যাল বিষয়ের কারণে এই প্রশ্নের ফয়সালা আমরা দেখতে পাইনি। কারণ, ওই রায়ে বিচারক হওয়ার ‘যোগ্যতা’ ও ‘উপযুক্ততার’ মধ্যে পার্থক্য আনা হয়। বলা হয়, ‘নিয়োগের পরে “উপযুক্ততা” (সুইটিবিলিটি) বিচার্য, “যোগ্যতা” (এলিজিবিলিটি) নয়। তাই এখন কো-ওয়ারেন্টো রিট চলবে না, বিধায় বিষয়টি বেঙ্গালুরু নীতিমালার আলোকে যাচাই করা গেল না।’ এই রায় থেকে আমরা আরেকটি নতুন তথ্য পেলাম, যা আমাদের বিচার বিভাগ কেন বেঙ্গালুরুর আচরণবিধি গ্রহণ করবে, সেই যুক্তিকেই আরও জোরালো করে।
২০০৬ সালে ভিয়েনায় জাতিসংঘের কমিশন অন ক্রাইম প্রিভেনশন অ্যান্ড কমার্শিয়াল জাস্টিসের ১৫তম অধিবেশনে গৃহীত রেজল্যুশনের শিরোনাম ছিল ‘বিচারকদের আচরণবিধির মৌলিক নীতি শক্তিশালীকরণ’। এতে জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিলকে জাতিসংঘ সদস্যরাষ্ট্রগুলোর ‘বিচার বিভাগ যাতে বেঙ্গালুরু নীতি গ্রহণ করার বিষয় বিবেচনায় নেয়’, সে জন্য সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোকে উৎসাহিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। কেউ আবার বলতে পারেন, এটা তো হাইকোর্টের কথা, বেঙ্গালুরুর বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট কিছু বলেছেন কি?
আমাদের বিচারব্যবস্থা থেকে উদাহরণ টানতে পারলে খুশি হতাম। ২০১৫ সালের ১৬ অক্টোবরে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট যে রায়ে বিচারক নিয়োগ–সংক্রান্ত সংবিধানের ৯৯তম সংশোধনী বাতিল করেছেন, সেই রায়ে বলা আছে, ‘জাতিসংঘের বেঙ্গালুরু নীতি আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত’। আমাদের হাইকোর্টের ২০১২ সালের একটি রায়ে বলা আছে, কোনো বিচারপতির আচরণের বিষয়ে প্রশ্ন উঠলে কী করণীয় তা নির্ধারণ করবেন প্রধান বিচারপতি।’ (৬৪ডিএলআর৫০৮)। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি কতিপয় ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য সংস্কার এনেছেন। আশা করব উচ্চ আদালতের জন্য অনুসরণীয় আচরণবিধি বাতিল হওয়ার কারণে যে শূন্যতা, তা পূরণে তিনি উদ্যোগী হবেন।
স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরুর অল্প আগে ঢাকায় হাইকোর্টের বিচারপতি শওকত আলীর বিরুদ্ধে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ উঠেছিল। স্ত্রীর নামে অর্ধডজন মার্সিডিজ আমদানিসহ ১০টি গুরুতর কারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল তদন্ত শুরু করেছিল। তখন তিনি যুক্তি দেন যে নিয়োগের সময় আমাকে আচরণবিধির কপি দেওয়া হয়নি। পরে কাউন্সিল সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারকে তদন্তের নির্দেশ দিলে তাঁর দাবি অসত্য বলে প্রমাণিত হয়। সুতরাং অভিজ্ঞতাও নির্দেশ করে আচরণবিধিশূন্য একটা অবস্থা পরিহার করাই শ্রেয়।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
[email protected]