অমঙ্গলের পূর্বাভাস নিয়ে শঙ্কা

অলংকরণ : তুলি
অলংকরণ : তুলি

স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের ৪৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে। সময়টি খুব কম নয়। ১৯৭২ সালে যাঁদের জন্ম, আজ তাঁরা প্রৌঢ়। তাঁদের কেউ কেউ আজ নানা-নানি, দাদা-দাদি হয়েছেন। অনেকে কর্মজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। এই সময়ে দেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। তার জন্য নির্বাচিত এবং অনির্বাচিত সব সরকারেরই বেশি হোক অথবা কম হোক অবদান রয়েছে। বেসরকারি উদ্যোগের ভূমিকাই বেশি।
সত্তরের শেষ দিক থেকে বাংলাদেশে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিও কার্যক্রম ব্যাপকভাবে কাজ করতে শুরু করে। ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ, গ্রামীণ দরিদ্র নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করা, স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়ানো, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার হার বাড়া এবং অন্যান্য অপ্রথাগত উন্নয়ন তৎপরতার ফলে গ্রামীণ দারিদ্র্য কমে আসতে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক স্থাপিত হওয়ায় বিপুল অদক্ষ শ্রমিক পাঠানো হতে থাকে। তাতে বেকারত্ব কমে এবং বৈদেশিক মুদ্রা আসতে থাকে। আশির দশকের গোড়া থেকে তৈরি পোশাকশিল্পের বাজার বাংলাদেশের জন্য খুলে যায়। অর্জিত হয় বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা।
নতুন নতুন প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার করতে থাকে বাংলাদেশের মানুষ। ষাটের দশকে কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক চাষবাসের যে সূচনা, তা গত ৪৫ বছরে অভাবিত সাফল্য অর্জন করেছে। তার জন্য সরকারের কৃষি বিভাগের যেমন কৃতিত্ব, তেমনি কৃষকের কৃতিত্ব বহু গুণ বেশি। বাংলাদেশ শাকসবজি রপ্তানি করে অর্জন করছে শত শত কোটি বৈদেশিক মুদ্রা। রেল দুর্নীতি ও অদক্ষতায় বিপর্যস্ত হয়ে গেলেও সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কার পরেই সবচেয়ে ভালো। সব দিক বিবেচনা করলে সাড়ে চার দশকে বাংলাদেশের অর্জন অহংকার করার মতো। সে অহংকার নেতারা বিরামহীনভাবে প্রতিদিন করছেনও। জনগণ গর্ব করে সব ব্যাপারেই মনে মনে, প্রকাশ্যে মাইক্রোফোনের সামনে নয়। নেতারা বুকে আঙুল ঠুকে ও তর্জনী উঁচিয়ে বলছেন: বাংলাদেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে, তার অগ্রগতিতে বাধা দেওয়ার সাধ্যি পৃথিবীর কারও নেই। নেতাদের কথা জনগণ পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করছে।
মুসলমানপ্রধান বাংলাদেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাবে, তা দেখে পৃথিবীর সব দেশের মানুষ দাঁত বের করে হাসবে—তা যাঁরা মনে করেন, তাঁদের সারল্যের প্রশংসা করতে হয়, কিন্তু তাঁদের বাস্তব জ্ঞান সম্পর্কে সন্দেহ জাগে। মালয়েশিয়ার মার খাওয়া শুরু হয়েছে। তাকে বেশি উঠতে দেওয়া হবে না। সে জন্য সে দেশের শাসকেরাও কম দায়ী নন। মানুষ হিসেবে মালয়েশিয়ার নেতারা উন্নত চরিত্রের অধিকারী—সে পরিচয় তাঁরা দিতে পারেননি। মালয়েশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতিতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের অবদান বিরাট, কিন্তু তাদের থেকে সে প্রতিদান পাওয়া যাচ্ছে না। তার বিপরীতে বাংলাদেশের সঙ্গে মালয়েশিয়ার সরকার যে ব্যবহার করছে, তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। কেন করছে তা তারাই ভালো বলতে পারবে। আগের দিন বাংলাদেশ থেকে ১৫ লাখ শ্রমিক নেওয়ার চুক্তি স্বাক্ষর করে পরদিনই শ্রমিক নেওয়া বন্ধের ঘোষণা কোন সভ্য দেশের মানুষ করে? বাংলাদেশ নিশ্চুপ।
মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারও বাংলাদেশিদের জন্য সংকুচিত হয়ে আসছে। কোনো কোনো দেশ বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ রেখেছে অথবা কমিয়ে দিয়েছে। পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের শ্রমিক সস্তা। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিচ্ছে না। তাতে লাভবান হবে পাকিস্তান ও ভারত বেশি, কিছুটা নেপাল ও শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে হবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া।
রাষ্ট্রীয় নীতির কারণে দেশের সম্পদের সার্বভৌমত্ব জনগণের থাকছে না। সব বিদেশি কোম্পানির হাতে চলে যাচ্ছে। বিস্ময়কর ব্যাপার, যে দেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ বিদেশে কর্মরত, যাঁরা বছর বছর দেশে আসা-যাওয়া করেন, সে দেশের জাতীয় এয়ারলাইনস লোকসান দেয়—পৃথিবীর কেউ বিশ্বাস করবে? আমাদের নাগরিকদের আনা-নেওয়া করে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো টাকার পাহাড় গড়ছে, আমরা হচ্ছি ফতুর। এর জন্য কি জনগণ দায়ী?
বাংলাদেশে কিছুকাল যাবৎ একটি বড় উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসা, প্রমোদ ভ্রমণ প্রভৃতি প্রয়োজনে তাদের বিভিন্ন দেশ সফর করতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য বিদেশ ভ্রমণ কঠিন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের নাগরিকদের ভিসা দেওয়া নিয়ে বিভিন্ন দেশ অসম্মানজনক আচরণ করছে। কোনো কোনো দেশের ভিসা অফিসই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ঢাকা থেকে দিল্লিতে। কেউ সাত দিনের জন্য লন্ডন যাবেন, সেখান থেকে এসেই এক সপ্তাহ পরে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম যাবেন, সে উপায় নেই। যুক্তরাজ্যের ভিসার জন্য পাসপোর্ট জমা দিলে সে পাসপোর্ট চলে যাবে দিল্লি। সেটা ফেরত এলে থাইল্যান্ডের ভিসার জন্য আবেদন করলে পাসপোর্ট কবে ফেরত পাওয়া যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বর্তমানের এই অবস্থাটা খুবই অমর্যাদাকর একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের জন্য। অতীতে কখনো বাংলাদেশিদের এ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়নি। এমনকি স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেও নয়, যখন বহু দেশের স্বীকৃতি পায়নি বাংলাদেশ।
কমনওয়েলথের ৫৩ দেশের মধ্যে মাত্র চারজনকে দেওয়া হয়েছে এ বছর ‘কমনওয়েলথ ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড’। তাঁদের একজন ময়মনসিংহ জেলার সওগাত নাজবিন খান। পুরস্কার গ্রহণের জন্য তাঁর লন্ডনে যাওয়া প্রয়োজন। দিল্লির ব্রিটিশ ভিসা অফিস দুই দফায় তাঁর ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। এ অপমান সাড়ে ১৬ কোটি মানুষকে করা হয়েছে।
গত কয়েক বছরে বিমানের কয়েকটি আন্তর্জাতিক রুট বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে নিরাপত্তা ঘাটতি থাকায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সরাসরি পণ্য পরিবহনে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাজ্য। বাংলাদেশ বিমানের যুক্তরাজ্যগামী সরাসরি যাত্রীবাহী ফ্লাইটও নিষেধাজ্ঞায় পড়তে পারে। এর আগে গত নভেম্বরে ঢাকা থেকে সরাসরি পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে অস্ট্রেলিয়া। ব্রিটেনের পরে নিষেধাজ্ঞা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য দেশও আরোপ করতে পারে। এসব নিষেধাজ্ঞার ফলে বাংলাদেশ বিরাট অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তার চেয়ে বেশি যা তা হলো দেশের ভাবমূর্তি।
মালয়েশিয়া যে শুধু বাংলাদেশ থেকে ১৫ লাখ কর্মী নেওয়ার চুক্তি বাতিল করেছে তা-ই নয়, উত্তরায় ৮ হাজার ৪০০ ফ্ল্যাট নির্মাণে ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছিল, সেটা থেকেও সরে যাচ্ছে। ২০১১ সালের অক্টোবরে এ প্রকল্প নিয়ে মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কতটা সফল বা অসফল, তা প্রাজ্ঞ কূটনীতিবিদেরা বলতে পারবেন। আমরা সাধারণ নাগরিকেরা চোখ দিয়ে যা দেখি তাতে হতাশার কারণ ঘটে বৈকি। কোনো গণতান্ত্রিক দেশের পার্লামেন্টই স্তাবকতা করার জায়গা নয়। সেখানে জনস্বার্থে ও দেশের স্বার্থে বিতর্ক হয় এবং জনস্বার্থেই আইন প্রণীত হয়। এমনকি যদি বিরোধী দল অনুপস্থিত থাকে, তবু। পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে তো আলোচনা হয়ই। সৌদি আরব বাংলাদেশ থেকে নতুন কর্মী নিচ্ছে না। তার সঙ্গে ইসলামি সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী জোটে ধাঁ করে যোগ দেওয়ার যৌক্তিকতা কোথায়? কারা আছে ওই জোটে? সুদান, চাদ, সোমালিয়া, মালদ্বীপ, টোগো, গ্যাবন, বেনিন, সিয়েরা লিওন, গিনি কমোরোস প্রভৃতি ব্যর্থ রাষ্ট্র এবং সন্ত্রাস দমনের লেশমাত্র অভিজ্ঞতা যাদের নেই।
গত কয়েক দশকে এশিয়ার কয়েকটি দেশ শিল্পক্ষেত্রে অসামান্য উন্নতি করেছিল। তাদের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ওই সব দেশ উন্নতি করেছিল অর্থনৈতিকভাবে, কিন্তু তাতে গণতন্ত্রের অভাব ছিল। সেই অভাব তারা পুষিয়ে দিতে চেয়েছিল মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটিয়ে। বাংলাদেশে সেটা সম্ভব হবে না। একমাত্র ইন্দোনেশিয়া ছাড়া আর যেকোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশ জনবহুল ও ঘনবসতিপূর্ণ। জমি কম, মানুষ বেশি। যেখানে–সেখানে ফসলের জমি ও নদনদী, খালবিল নষ্ট করে কলকারখানা স্থাপন হবে আত্মঘাতী। পরিবেশ এতটাই বিপর্যস্ত হবে যে মানুষ বসবাস করতে পারবে না। জিডিপির চেয়ে জীবন বড়। জিডিপি এক-দেড় শতাংশ বাড়াতে গিয়ে আট-দশ কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন করার মধ্যে নির্বুদ্ধিতা ছাড়া দূরদৃষ্টিতার পরিচয় নেই। বিদেশি স্বার্থে এমন কিছু প্রকল্প জনমত উপেক্ষা করে নেওয়া হয়েছে, যা আত্মঘাতী।
একটি বিষয় আমরা ভুলে থাকা পছন্দ করি অথবা গোপন করতে চাই। ফিলিপাইন বা মালয়েশিয়ার অর্থনীতি অনেক উঁচুতে উঠে যাওয়ার পর এখন সংকটের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। বাংলাদেশ উঁচুতে ওঠার অপেক্ষায়। এই অবস্থায় অর্থাৎ আধা পথে সে যদি আটকে যায়, তার পক্ষে সে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী ও স্থিতিশীল না করে অর্থনীতিকে সুদৃঢ় ও স্থিতিশীল করা অসম্ভব। যাঁরা মনে করেন সম্ভব, তাঁরা ভ্রান্ত। ব্যাংকগুলোতে যা ঘটছে তা অবিশ্বাস্য।
শুধু সরকারকে দোষ দেওয়া যাবে না। সরকারের বাইরে যেসব প্রসিদ্ধ ব্যক্তি আছেন, জাতির এই দুঃসময়ে তাঁরাও কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না। কারণ, তাঁদের জীবনেতিহাস প্রাঞ্জল নয়। জীবনে তাঁদের ত্যাগ নেই। অতীত তাঁদের স্বচ্ছ নয়। তাঁরা সুবিধাবাদী।
৪৫ বছর আগে এই মার্চ ছিল অসহযোগের মাস। পাকিস্তানিদের অন্যায়, অবিচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ছিল আমাদের অসহযোগ। আমাদের সেই অসহযোগে সারা দুনিয়া ছিল আমাদের পক্ষে। আজ বিভিন্ন রাষ্ট্র করছে আমাদের সঙ্গে অসহযোগ। ফলে সবুজ ও শস্য-শ্যামল বাংলার আকাশে দেখা দিয়েছে কালো মেঘ।
সিরাজউদ্দৌলা নাটকের একটি সংলাপ মনে পড়ে। সিরাজ বলছেন তাঁর বিশ্বস্ত ভৃত্যকে: ‘বাংলার আকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা, উপায় নাই গোলাম হোসেন।’ সরকারের যারা প্রতিপক্ষ বা শত্রু, তারা এই পরিস্থিতিটা উপভোগ করতে পারে, কিন্তু সাধারণ মানুষ পায় কষ্ট। আমার বিশ্বাস, এই অবস্থাটা থাকবে না। সংকট কেটে যাবে, তবে তখন খুব দেরি হয়ে যাবে।
ষাটের দশকে যাঁরা বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা চেয়েছিলেন শুধু পাকিস্তানিদের বিতাড়ন নয়, স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ, তাঁদের কাছে বর্তমান পরিস্থিতিটা বেদনাদায়ক। মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার চেয়ে মর্যাদাবান জাতি হওয়া বেশি গৌরবের। নিম্নমানের প্রশাসন ও অদক্ষ কূটনীতি দিয়ে সমৃদ্ধ দেশ গঠন সম্ভব নয়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।