জাসদে গৃহদাহ

জাসদ আবার ব্র্যাকেটবন্দী হলো। কয়েক দিন আগে আয়োজিত দলের কাউন্সিল সভায় কমিটি তৈরি করা নিয়ে দলটি দুই ভাগ হয়। তাদের পরিচিতি এখন জাসদ (ইনু) ও জাসদ (আম্বিয়া)। আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে জাসদের একটা গ্রুপ অনেক আগেই আলাদা হয়ে গেছে। দলের নামও বদলে ফেলেছে তারা। রবের দল এখন জাসদ নয়, জেএসডি নামে পরিচিত। তাদের মার্কা আলাদা।
কিছুদিন আগে প্রথমা প্রকাশন আমার একটা বই ছেপেছে—জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি। তখন জাসদের কয়েকজন বন্ধু অনুযোগ করেছিলেন, পতন লিখলেন কেন? আমরা তো এখনো আছি। আমি জবাবে বলেছিলাম, যে জাসদকে আমরা চিনতাম, এখন তার কঙ্কালটাই অবশিষ্ট আছে। এটাকে পতন বলব না তো কী বলব?
দলটি ভাঙতে ভাঙতে খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ ভাঙন নিয়ে মুখরোচক আলোচনা হচ্ছে—এই গৃহদাহ কেন? কাকে নিয়ে? জাসদকে নিয়ে এখনো আলোচনা হয়। কেননা, দলটি একসময় এ দেশের রাজনীতিতে ঝড় তুলেছিল, স্বপ্ন দেখিয়েছিল। একটা প্রজন্মকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তাই জাসদ নিয়ে আবেগ থাকাটা স্বাভাবিক।
জাসদের জন্ম ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর। ‘প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদীদের ক্রীড়নক পুতুল সরকারকে উৎখাত করার’ আহ্বান জানিয়ে দলটি যাত্রা শুরু করে। ওই সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সরকার দেশ চালাচ্ছিল। বিরোধী দল বলতে তেমন কিছু ছিল না। ন্যাপ (মোজাফফর) ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ছিল খুবই সংগঠিত দল। তারা প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে গণতন্ত্রের পথচলা সহজ করতে পারত। কিন্তু তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য নষ্ট করেছিল। জাসদ ওই শূন্যতা পূরণ করেছিল। জাসদ খুব দ্রুত আওয়ামী লীগবিরোধী বিশাল এক প্ল্যাটফর্ম হয়ে দাঁড়ায়।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগের রাজনীতি দারুণভাবে হোঁচট খায় এবং জাসদ অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। ৭ নভেম্বরের সিপাহি বিদ্রোহের অনুঘটক হলেও ক্ষমতার লড়াইয়ে জাসদ জিয়াউর রহমানের সামরিক-অসামরিক সম্মিলিত শক্তির কাছে হেরে যায়। জাসদ চলে যায় হিমঘরে। এরপর জাসদ সশস্ত্র ধারা ছেড়ে সাংবিধানিক ধারার রাজনীতিতে ফিরে আসার চেষ্টা করে। এ নিয়ে দলে বিতর্ক হয় অনেক। ফলে দলে ভাঙন ধরে। নীতিগত অনেক প্রশ্নের মীমাংসা না হওয়ায় জাসদ থেকে একটা গ্রুপ বেরিয়ে গিয়ে তৈরি করে বাসদ। তারা পুঁথিগত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আদর্শ আঁকড়ে থাকে।
জাসদে তখন থাকে দুটি ধারা। একটি ধারা শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সহাবস্থানের মাধ্যমে ক্ষমতার ভাগীদার হতে চেয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে একটা গ্রুপ আলাদা হয়ে যায়। অন্য গ্রুপটি মির্জা সুলতান রাজা ও শাজাহান সিরাজের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে স্বৈরাচারবিরোধী রাজনীতিতে সক্রিয় থাকে। কিন্তু ১৯৮৫ সালে নির্বাচনের প্রশ্নে মতভিন্নতার কারণে শাজাহান সিরাজের গ্রুপ আলাদা দল তৈরি করে। এসব ভাঙনের পেছনে আদর্শের ব্যাপার-স্যাপার তেমন ছিল না। শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে আঁতাত করে ক্ষমতার ভাগ নিতে দাঁড় করানো হয়েছিল নানা যুক্তি ও তত্ত্ব।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর জাসদ ক্ষমতার কার্নিশে দাঁড়ানোর একটু সুযোগ পায়। জাতীয় সংসদে ন্যূনতম সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় শেখ হাসিনা আ স ম আবদুর রবকে মন্ত্রিসভায় জায়গা দেন। এরপরই কাজী আরেফ আহমদ ও হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদ রব-জাসদের সঙ্গে একীভূত হয়। সরকারের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা আঠার মতো একে অপরের সঙ্গে লেগে থাকে। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে ছিটকে পড়লে অবধারিতভাবে রব ক্ষমতার কার্নিশ থেকে ভূপাতিত হন। ফলে জাসদ আবার ভাঙে। আরেফ-ইনুর সঙ্গে রবের মধুচন্দ্রিমা পর্ব সাঙ্গ হয়। ওই নির্বাচনে জাসদ কোনো আসন পায়নি। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ রবের বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়েছিল। রব ও ইনু দুজনেই নির্বাচনে পরাজিত হন। এরপর জাসদের পক্ষে আর একক শক্তিতে রাজনীতি করা সম্ভব ছিল না। শাজাহান সিরাজ আগেই বিএনপিতে যোগ দিয়ে থিতু হয়েছিলেন। তিনি বিএনপির মন্ত্রিসভায় জায়গা পান।
পঁচাত্তর সাল পর্যন্ত জাসদ ‘রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের’ উদ্দেশ্যে রাজনীতি করেছে। নতুন বাস্তবতায় তা আর সম্ভব ছিল না। সময় ও প্রেক্ষিত আমূল বদলে গিয়েছিল। এরপর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির দুই পরাশক্তি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কক্ষপথে ছোট দলগুলো ঘুরপাক খেতে শুরু করে। জাসদ একসময় পাঁচদলীয় জোটের অংশীদার ছিল। তারা শাটল কর্কের মতো কখনো আওয়ামী নেতৃত্বের আটদলীয় জোট এবং কখনো বিএনপির নেতৃত্বে সাতদলীয় জোটের কাছে ছুটে গিয়েছিল। আসন ভাগাভাগি নিয়ে সমঝোতা না হওয়ায় তারা নির্বাচনের রাজনীতিতে কিছুই করতে পারেনি। এর ফলে অস্তিত্বের সংকটে পড়ে দলটি। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর দলটি সিদ্ধান্ত নেয়, আওয়ামী লীগ বিএনপির তুলনায় ‘মন্দের ভালো’। সুতরাং এর সঙ্গেই থাকা যাক। এই উপলব্ধি থেকে জাসদ আরও অনেকের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪-দলীয় জোটে শামিল হয়। তারা বেরিয়ে আসে পাঁচদলীয় জোটের নিষ্ফলা রাজনীতি থেকে।

>জাসদের এবারের ভাঙনের অভিঘাত কেমন হবে, তা নিয়ে নানা রকম জল্পনা-কল্পনা হচ্ছে। নিঃসন্দেহে বলা চলে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে দর-কষাকষির ক্ষমতা হারাল জাসদ। উভয় গ্রুপের জন্যই এটা আত্মহত্যার শামিল। রাজনীতি না থাকলে দল ভাঙে। মুসলিম লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি এভাবেই ভেঙেচুরে খানখান হয়ে গেছে। জাসদ কি সেই পথে যাচ্ছে?

২০০৮ সালের নির্বাচনে জাসদ নৌকা মার্কা নিয়ে চারটি আসনে প্রার্থী দিয়ে তিনটিতে জয় পায়। জাসদের সভাপতি ইনু ভেবেছিলেন, তিনি মন্ত্রিসভায় জায়গা পাবেন। প্রথম দিকে তা হয়নি। শেষমেশ তিনি সরকারের অংশ হলেন। জাসদ হলো রাষ্ট্রক্ষমতার ভাগীদার। এরপর থেকে জাসদকে আলাদা করে চেনা মুশকিল।
সংসদীয় গণতন্ত্রে জাতীয় সংসদ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। সংসদ ভবনের ভেতরে না ঢুকতে পারলে মান-মর্যাদা থাকে না। পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, সামরিক-বেসামরিক আমলা, রাজনীতিবিদ—সবার একটাই গন্তব্য—কীভাবে সংসদ ভবনে ঢোকা যায়। এ জন্য দরকার ক্ষমতায় যেতে পারে এমন একটি দলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা। অনেক দাম দিয়ে জাসদ এটা বুঝেছে। জাসদের নীতি-আদর্শ-তত্ত্ব এখন একটা বাক্যে এসে দাঁড়িয়েছে—গণতন্ত্র, উন্নয়ন এবং জঙ্গিবাদ ঠেকানোর জন্য শেখ হাসিনার হাতকে মজবুত করতে হবে। কৌশল হিসেবে এটা বলা যেতেই পারে। কিন্তু এটাই যদি জাসদের রাজনীতির সারকথা হয়, তাহলে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করার জন্য একজন তরুণ জাসদ করবেন কেন? তিনি তো সরাসরি আওয়ামী লীগেই যেতে পারেন। এর ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। ১৯৭২-৭৫ সালে ন্যাপ ও সিপিবি যেমন করে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য নির্বাসনে পাঠিয়েছিল, জাসদ তার পুনরাবৃত্তি করল। দেশের সাধারণ মানুষ ‘বি-টিম’ পছন্দ করে না। জাসদকে নিয়ে এখন লোকে হাসি-তামাশা করে। জাসদের প্রতি ষাঠোর্ধ্ব বয়সী অনেকের অভ্যাসজনিত আনুগত্য রয়ে গেছে। নতুনরা এই দলে আসেন না। কেন আসবেন? মূল অবয়ব ছেড়ে ছায়ার পেছনে কে দৌড়ায়?
প্রশ্ন হলো, জাসদের ভবিষ্যৎ কী? একটা মত হলো, যেহেতু জাসদের আলাদা কোনো দর্শন নেই, আওয়ামী লীগের ঢেঁড়া পেটানোই তার কাজ, তাহলে জাসদের উচিত আওয়ামী লীগে লীন হয়ে যাওয়া। ন্যাপ ও সিপিবির অনেকেই এ কাজটি করেছেন। তাঁরা কিন্তু আওয়ামী লীগের দুর্দিনে তার সঙ্গী হয়েছেন। ফলে আওয়ামী লীগে তাঁদের কিছুটা কদর আছে। এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ বেশ মজবুত। সুতরাং সেখানে নবাগতদের বাজারদর কম হবে, এই আশঙ্কা আছে। আরেকটি মত হলো, স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিয়ে সত্যিকার বিরোধী দল হয়ে ওঠার রাজনীতি। কিন্তু বয়স হয়ে গেলে এবং ইহজাগতিক ব্যাপারগুলোর প্রতি মোহ তৈরি হলে ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। জাসদ নেতারা তাই শঙ্কিত, আওয়ামী লীগের বৃত্তের বাইরে গেলে তাঁরা না রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েন।
১৪-দলীয় জোট করে এবং এটাকে টিকিয়ে রেখে আওয়ামী লীগ তার প্রভাববলয় বিস্তৃত করেছে, শত্রুর সংখ্যা কমিয়েছে। জাতীয়
পার্টিকে মহাজোটে নিয়ে হু মু এরশাদকে নির্বিষ করা গেছে। সবই সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার কুশলী ও দূরদর্শী নেতৃত্বের গুণে। শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ জোটের রাজনীতিতে লাভবান হয়েছে।
কিন্তু জাসদ কী পেয়েছে? ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জাসদসহ পাঁচদলীয় জোট যদি আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকত, তাহলে ওই নির্বাচনের ফল অন্য রকম হতে পারত। ’৯১-এর বিপর্যয়ের পর ‘বাকশাল’ আওয়ামী লীগে ফিরে গেছে। পাঁচদলীয় জোট ছেড়ে পরে জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছে। জাসদের জোটের রাজনীতির সমীকরণ বুঝতে সময় লেগেছে দেড় দশক। দেরিতে উদয়
হওয়া এই ‘শুভবুদ্ধি’ দেখে প্রচলিত বচনটির কথা মনে পড়ে—সেই তো নথ খসালি, তবে কেন লোক হাসালি।
জাসদ এখন সরকারের অংশ। দলে ছয়জন সাংসদ। এঁদের মধ্যে দুজন নির্বাচিত হয়েছেন দলীয় পরিচয়ে, মশাল মার্কা নিয়ে। জোটের ছোট তরফ হিসেবে জাসদ রাষ্ট্রক্ষমতার একটা ভগ্নাংশ ভোগ করছে। অন্যান্য প্রাপ্তিও জুটেছে অল্প-বিস্তর। দলে অনেক নেতা। চাহিদার তুলনায় ‘সুযোগ-সুবিধার’ সরবরাহ কম। ফলে দলের মধ্যে অস্বস্তি, ক্ষোভ ও দলাদলি বেড়েছে। পদ-পদবি নিয়ে কামড়া-কামড়ি করতে গিয়ে জাসদ আবার দুই টুকরা হলো।
জাসদের যুযুধান দুই পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে এখন বেশ সরব। সভাপতির বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে। আমাদের দেশে এই হলো সমস্যা। দল বড় হোক ছোট হোক, সব জায়গায় প্রশ্নহীন আনুগত্য চাওয়া হয়। এখন ইনু আর আম্বিয়া পরস্পরের কাছে ‘প্রিন্সিপাল কন্ট্রাডিকশন’। মুখ ফসকে তাঁরা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অনেক কথাই বলছেন। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতা, ষড়যন্ত্র—এই সব কথা উঠে আসছে। প্রতিদ্বন্দ্বীর চরিত্র হনন করে আমাদের দেশের রাজনীতিকেরা স্যাডিস্ট আনন্দ পান। ফলে সমঝোতার পথ বন্ধ হয়ে যায়।
জাসদের এবারের ভাঙনের অভিঘাত কেমন হবে, তা নিয়ে নানা রকম জল্পনা-কল্পনা হচ্ছে। নিঃসন্দেহে বলা চলে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে দর-কষাকষির ক্ষমতা হারাল জাসদ। উভয় গ্রুপের জন্যই এটা আত্মহত্যার শামিল।
রাজনীতি না থাকলে দল ভাঙে। মুসলিম লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি এভাবেই ভেঙেচুরে খানখান হয়ে গেছে। জাসদ কি সেই পথে যাচ্ছে?
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক-গবেষক।
[email protected]